Posts

চিন্তা

প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত: এই ট্রাজেডির শেষ কোথায়?

July 21, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

76
View

নরকযন্ত্রণা সয়ে দেবশিশুরা যখন বেতাল হয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, ওই দৃশ্য চোখে সয় না। চোখের জল আজ খা খা মরু। হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়। ভাঙা হৃদয় আর জোড়া লাগবে কীসে! সকালে মা কত যত্ন করেই না প্রিয় সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। সেই প্রাণের জাদুধন স্বজনের কাছে ফিরল বটে। তবে তা নিকষ কালো অঙ্গার হয়ে। এই মর্মন্তুদ বেদনার কোনো তুলনা হয় না। কাকে দায়ী করব আমরা নিজের কপাল ছাড়া!

উত্তরার মাইলস্টোন কলেজে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত। হতাহতদের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানাই। দেশের জন্য এ এক বিরাট বিপর্যয়। এই ট্রাজেডি একেবারেই নেয়া যায় না। আহারে ছোট্ট সোনা পবিত্র বাবুরা আমাদের! জীবনদাতা কেন এমন বিপদ আমাদেরকেই দেন? বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকায় হতে হবে? বিকেন্দ্রীকরণের কথা কারোরই মাথায় আসে না কেন? এত এত দেবশিশু ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরের মতো মেধাবী একজন পাইলট আমরা আর কোথায় গেলে পাবো? নিশ্চিতই জাতি একজন নিষ্ঠাবান সমরসেবক হারাল! অপার সম্ভাবনাময় শিশুদের খোয়ালো।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির আজ তার সলো ফ্লাইট ট্রেনিংয়ে অংশ নেন, যা একজন ফাইটার পাইলটের ট্রেনিংয়ের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এ ধাপে পাইলটকে একাই বিমান পরিচালনা করতে হয়, যা তার দক্ষতা প্রমাণ করে। তৌকির তার এফ-৭ বিমান নিয়ে কুর্মিটোলা পুরাতন এয়ারফোর্স বেস থেকে উড্ডয়ন করেন এবং রাজধানীর বিভিন্ন আর্বান এরিয়ায় উড়াল দেন। ফ্লাইট চলাকালে তিনি বিমানে কারিগরি ত্রুটি অনুভব করেন এবং কন্ট্রোল রুমে জানিয়ে বিমান বাঁচাতে চেষ্টা চালিয়ে যান। তবে কিছু সময় পর তার সাথে কন্ট্রোল রুমের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলে বিধ্বস্ত হয়। দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আগে হয়ত খোলাসা হবে না।

আজ সোমবার বিকেলে আইএসপিআর জানিয়েছে, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির বিমানটিকে ঘনবসতি থেকে জনবিরল এলাকায় নেওয়ার চেষ্টা করেন।

আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার (২১-৭-২০২৫) দুপুর ১ টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলাস্থ বিমানবাহিনীর এ কে খন্দকার ঘাটি থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। দুর্ঘটনা মোকাবেলায় এবং বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বিমানের বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল এবং কলেজের দোতালা একটি ভবনে অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়। আকস্মিক এ দুর্ঘটনায় বৈমানিকসহ ১৯ জন নিহত এবং ১৬৪ জন আহত হয়েছেন (পরবর্তীতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ জনে এবং আহত ১৭১ জন)।

দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনের জন্য ইতোমধ্যে বিমান বাহিনীর একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।

১৯৬০ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির বহরে সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় উড়তে সক্ষম ও দ্রুতগামী জেট ছিল জে-৭। বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও ইরানের মতো দেশগুলো এখনো চীনের তৈরি এফ-৭এর মতো বিমান প্রশিক্ষণ কাজে ব্যবহার করে। বাকিরা এসব বিমান অনেক আগেই অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে।

এফ-৭ এর দুর্ঘটনা এবারই প্রথম নয়। তবে আগের দুর্ঘটনাগুলো প্রত্যেকটিই জনবিরল এলাকায় ঘটেছে।
২০০৮ সালের এপ্রিলে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের পাহাড়িপাড়া গ্রামে পাইলটসহ বিধ্বস্ত হয় একটি এফ-৭ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। এতে নিহত হন স্কোয়াড্রন লিডার মোর্শেদ হাসান। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে তখন সম্ভাব্য কারিগরি ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়।

২০১৫ সালের জুনে এফ-৭ এমবি ৪১৬ মডেলের একটি যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বিধ্বস্ত হয়। নিখোঁজ হন পাইলট তাহমিদ রুম্মান। এটি বিমান বাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করেছিল। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কয়েক মিনিট পর যুদ্ধবিমানটি পতেঙ্গা সৈকতের প্রায় ৬ নটিক্যাল মাইল দূরে সাগরে বিধ্বস্ত হয়।

২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রশিক্ষণের সময় টাঙ্গাইলের মধুপুরে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭ বিজি। এতে নিহত হন পাইলট আরিফ আহমেদ। এয়ারক্রাফটটি ঢাকা থেকে উড্ডয়নের ২৫ মিনিটি পর মধুপুরের রসুলপুর এলাকায় বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে যায়।

একটা মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরই আমাদের কানে আসে অনেক বছরের পুরনো লক্করঝক্কর প্লেন দিয়ে প্রশিক্ষণ চলছিল। ভাগ্যের জোরে পাইলট বেঁচে ফিরলেন অথবা প্রয়াত হলেন। এবার আমরা সব হারালাম। কেন ডেট এক্সপায়ার্ড প্লেনগুলোকে এখনি বসিয়ে দিয়ে অতি অবশ্যই লেটেস্ট প্রযুক্তির প্লেনকে প্রশিক্ষণ কাজে নিয়োজিত করা হবে না? মানুষের জীবন চাইলেই দ্বিতীয়টি আর পাওয়া যায় না! তাই জীবন নিয়ে এমন হেলাফেলা চলে না!

এমনকি শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট কিংবা কুর্মিটোলার পুরাতন বিমানবন্দরও ঢাকা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া উচিত। অথবা বিমানবন্দরের আশেপাশে বসতি স্থাপন বন্ধ রাখা উচিত ছিল। এত ঘিঞ্জি একটা রাজধানীতে বিমানবন্দর থাকে কী করে? ভাবেন তো যাত্রীসহ একটা বোয়িং বিমান ক্রাশ করলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে? এক পাইলটের প্রশিক্ষণ ফাইটারের ধকলই তো আমরা সামাল দিতে পারছি না!

দুর্ঘটনার পর আমরা আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ও খামখেয়ালিপনার জাত চিনিয়ে দিচ্ছি। রাজনৈতিক নেতা, ইউটিউবার, টিকটকার এবং উৎসুক জনতা -একটা দেশ একসাথে এত জঞ্জাল কখনোই পায়নি আর! এরা দুর্ঘটনা ও মানবিক বিপর্যয়কেও নিমিষেই তামাশা বানিয়ে ফেলে। আর কবে ভালো হবে এই বঙ্গজ সন্তান! মানুষকে স্বাভাবিক নিঃশ্বাসটুকু নিতে দিন। কারো দম বন্ধ করে ফেলবার অধিকার আত্মস্বার্থনিমগ্ন কারো থাকতে নেই!

আমরা আশা করব মানুষের বানিয়ে রাখা নীতির ভুলে আর যেন কোনো মায়ের কোল খালি না হয়। কোনো স্ত্রী স্বামীহারা না হয়। বারবার এমন ট্রাজেডি আমরা আর নিতে পারি না। যে যুদ্ধবিমান অবসরে থাকবার কথা তাকে আকাশ পাড়ি দিতে বলবার আর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এতদিন আমরা উন্নয়নের অলীক গল্পের সুতো বুনেছি। যেই গল্পের বলি হলেন মিস্টার তৌকির। আর আমাদের বাজে রাজনীতির কড়া জবাব দিয়ে গেল অকালে প্রাণ হারানো দেবশিশুরা।

লেখক: সাংবাদিক 
২১ জুলাই ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login