তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অথচ উপেক্ষিত নায়ক। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা ও আত্মত্যাগ দেখিয়েছেন, তা এই দেশের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির কাঠামোতে অতি-সীমিতভাবে মূল্যায়িত হয়েছে। আর এখন তো একেবারেই অনুচ্চারিত নাম।
যুদ্ধশেষে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে আসেন এবং সতীর্থ খন্দকার মোশতাক গংদের কানপড়ায় ধীরে ধীরে তাজউদ্দীনকে রাজনীতি থেকে কার্যত নির্বাসিত করে দেওয়া হয়। শেখ মুজিবের পারিবারিক বলয়ের রাজনীতিকদের দ্বারা তিনি প্রতিনিয়ত অবহেলিত হন। তাজউদ্দীন নিজের জন্য কোনো রাজনৈতিক দল বা বলয় গড়েননি -এটাই ছিল তাঁর নৈতিকতা এবং যা শেষ পর্যন্ত তাঁকে বিপদে ফেলেছে।
১৯৭৫ সালে জেলখানায় জাতীয় চার নেতার সঙ্গে তাঁকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অথচ এই হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ দায় রাষ্ট্র আজও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি। ইতিহাসের বইয়ে, পাঠ্যপুস্তকে, রাজনৈতিক দলগুলোর চর্চায় তাঁর নাম প্রায় অনুল্লেখিত থেকেছে।
শেখ মুজিবের ছায়ায় থেকেও তিনি স্বাধীন চিন্তার নেতা ছিলেন, যার কারণে দলীয় বলয়ে তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখা হতো। অমিত ব্যাকরণহীন শ্রদ্ধা যেটা এ দেশের রাজনীতিতে প্রয়োজন মনে করে প্রায় সবাই, সেটি তিনি কখনও চাইতেন না বা কুড়োতে যাননি।
তাজউদ্দীন আহমদ একজন ন্যায়নিষ্ঠ, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক, যিনি ব্যক্তি গৌরব নয়, বরং রাষ্ট্র বিনির্মাণে মনোনিবেশ করেছিলেন। বাংলাদেশ এনে দিয়েছেন। তাঁর রাজনীতি ছিল দায়িত্বশীলতার, আত্মত্যাগের ও ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতায় মোড়ানো।
তাঁর জন্মশতবর্ষ যদি এই দেশ যথাযথভাবে না উদযাপন করে, সেটি চলমান ইতিহাসকে অসম্পূর্ণ ও বিকৃত করবারই নামান্তর হয়। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বলতে যদি কেবল একক ব্যক্তি বন্দনা হয়, তবে সেই ইতিহাসের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। উপরন্তু রাষ্ট্র যদি জাতির সূর্যসন্তান দেশ বিনির্মাণকারীদেরকে সজ্ঞানে ভুলে যেতে চায় এবং এই জাতিকে ভুলিয়ে দিতে চায় সেটি অতি অবশ্যই নিজের পায়ে কুঠারাঘাতের শামিল। আঘাতের যেই দাগ কখনোই মুছে যাবে না। কাল থেকে কালান্তরে ওই ক্ষতচিহ্ন সবাইকে বয়ে বেড়াতে হবে। খেসারতও দিতে হবে।
তাজউদ্দীন আহমদের জন্মশতবর্ষে তাঁকে প্রাণান্ত সালাম ও শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক: সাংবাদিক
২৩ জুলাই ২০২৫