Posts

প্রবন্ধ

দেশের প্রধান সংবাদপত্র থেকে কেন কিছু শিখবেন না?

July 24, 2025

উম্মে রায়হানা

Original Author উম্মে রায়হানা

994
View

ছোটবেলায় স্কুলে আমাদের একটা প্রবন্ধ রচনা আসতো প্রায়ই,সংবাদপত্র। এখন মিডিয়া বা গণমাধ্যম অনেক বিকশিত হয়েছে। এতটাই বিকশিত যে নিউ মিডিয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যা সব পড়েছিলাম সেসবও তামাদি প্রায়। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, এখনকার স্কুলের বাচ্চাদের আর সংবাদপত্র নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করতে হয় না। সংবাদপত্র নিয়ে লিখতে গিয়ে স্কুল বয়সেই জেনেছিলাম সংবাদপত্রের কাজ সত্য ও নিরপেক্ষ তথ্য পরিবেশন ছাড়াও বিনোদন এবং শিক্ষা দান। পাঠককে নানা ভাবে নানা বিষয়ে এডুকেট করাটাও সাংবাদপত্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। 

সংবাদপত্র এখন আর কাগজে সীমাবদ্ধ নেই। এখনও রাত এগারোটায় পেজ মেকআপ হয়ে সারা রাত ধরে প্রেসে ছাপা হয়ে সকালবেলায় হকারের হাতে করে চায়ের টেবিলে পৌঁছায় দৈনিক পত্রিকা। আমাদের আগের প্রজন্ম চায়ের সঙ্গে খবরের কাগজ পড়তে চাইলেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনলাইন নিউজ পাওয়া যায় ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই। ফলে আমরা অনেকেই এখন আর পরের দিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা না করে অনলাইনে নিউজ দেখে নিই। 

আজই সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে খালেদ মহিউদ্দিনের শো দেখছিলাম। খালেদ মহিউদ্দিনের একটি অন্যতম প্রধান গুণ বা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উনি শিশুর মতন সরল ভঙ্গিতে অত্যন্ত জরুরি সব প্রশ্ন করে বসেন। উনার প্রশ্ন শুনে মনে হতে পারে, এত বড় সাংবাদিক এমন বোকার মতন প্রশ্ন কেন করছেন! কিন্তু আমন্ত্রিত অতিথির উত্তর বা পরবর্তী  আলোচনা শুনেই বোঝা যায় প্রশ্নটা মোটেই বোকার মতন ছিলো না বরং ছিলো খুবই সুচিন্তিত। যেমন আজকেই তিনি অতিথিকে প্রশ্ন করলেন, ‘এই যে কিছু নিউজ মিডিয়া এসব ভুয়া নিউজ বা গুজব ছড়ায়, এদের ভয় লাগে না? ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়?’ তাঁর এই প্রশ্নের জবাবে আলোচক ব্যখ্যা করলেন ভুয়া নিউজ এবং পরবর্তীতে ক্লারিফিকেশন কিভাবে পোর্টালগুলোকে ডাবল রোজগার করতে সাহায্য করে।  

সে যা-ই হোক, উপক্রমণিকা যথেষ্ট হলো। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। এই যে একটা ভয়াবহ কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড হয়ে গেলো দেশে, এই ঘটনাতেও সাংবাদিকদের ও সংবাদমাধ্যমগুলোকে নানা রকম তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে। ক্লিকবেইট সাংবাদিকতার মতন পেইনপর্ন সাংবাদিকতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন ও আপত্তি। এরই মধ্যে দেশের প্রধান দৈনিক প্রথম আলোতে একটি সংবাদ শিরোনাম দেখা গেলো – ‘নারী কর্মীদের ছোট হাতা ও দৈর্ঘ্যের পোশাক, লেগিংস পরা বাদ দিতে বলল বাংলাদেশ ব্যাংক।‘ 

একটু পর শিরোনামটা বদলে হলো এরকম - নারী কর্মীদের ছোট হাতা ও স্বল্প দৈর্ঘ্যের পোশাক, লেগিংস পরা বাদ দিতে বলল বাংলাদেশ ব্যাংক।

নিউজ এডিটিং করতে গিয়ে শিখেছিলাম শিরোনাম লিখতে হয় আট শব্দের, খুব বেশি হলে দশ। এই শিরোনামে শব্দ সংখ্যা মোট ১৫টি। আমি নিজে সাংবাদিকতার চাকরি ছেড়ে দিয়েছি প্রায় বছর দশেক আগে। কে জানে হয়তো এখন নিয়ম বদলেছে! যেহেতু খবরের জন্য কাগজ এখন আর একমাত্র আশ্রয় নয়, জায়গার টানাটানি নেই, ফলে বেশি শব্দ লেখা যেতেই পারে। 

এবার আসুন দেখি আট/দশ শব্দে কাজ সারতে হলে এই শিরোনামটা আর কী কী ভাবে লেখা যেতো! 

অপশন এক – নারী কর্মীদের পোশাকের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ বাংলাদেশ ব্যাংকের 

অপশন দুই-  বাংলাদেশ ব্যাংকের নারী কর্মীদের পরতে হবে লম্বা পোশাক  

অপশন তিন – বাংলাদেশ ব্যাংকের নারী কর্মীদের পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি 

এমন আরও নানা কিছুই হতে পারে। কিন্তু যেটাই লেখা হোক না কেন, এই শিরোনাম অত্যন্ত একপেশে এবং মিসলিডিং। 

কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংক মোটেই শুধুমাত্র নারীকর্মীদের জন্য ড্রেসকোড প্রণয়ন করেনি, নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই করেছে। অথচ সংবাদ শিরোনামটা পড়লে যে কারোরই মনে হতে পারে যে বাংলাদেশ ব্যাংক নারীকর্মীদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করছে, একপেশেভাবে তাঁদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে বাধ্যবাধকতা।   

নানা প্রতিষ্ঠানে ড্রেসকোড থাকে। বাংলাদেশের অন্যতম বড় একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রাণ। এই কোম্পানিতে যারা কাজ করেন তাঁদের হালকা আকাশী রং এর শার্ট পরতে হয়, তিনি এমডি হোন আর পিওন, এতে কোম্পানির প্রতি ওনারশিপ বাড়ে নিশ্চয়ই । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আপাতদৃষ্টিতে কোনও ড্রেসকোড নেই। কিন্তু আমি আমার শিক্ষকদের সবসময়ই শাড়ি পরে ক্লাসে আসতে দেখেছি, বড়জোর সালোয়ার কামিজ। পুরুষ শিক্ষকরা পরতেন ফরমাল শার্ট বা পাঞ্জাবি পাজামা, বড়জোর ফতুয়া। কোন নারী শিক্ষককে স্কার্ট পরে বা পুরুষ শিক্ষককে টি-শার্ট পরে ক্লাসে আসতে কখনো দেখিনি। আড়ং এ যারা সেলস এসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করেন তাঁদের কালো ও বিস্কুট রং এর সালোয়ার কামিজ বা শার্ট-প্যান্ট পরতে দেখা যায়। সুতরাং ড্রেস কোড প্রণয়ন করা কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অন্যায় বা অন্যায্য কোনকিছুই নয়। বাংলাদেশে এমন অনেক প্রাইভেট ব্যাংক আছে যেখানে নারী কর্মীদের মাথায় হিজাব বা হেডস্কার্ফ পরতে বাধ্য করা হয়। অনেক কিন্ডারগার্ডেন স্কুল আছে যেখানে নারী শিক্ষকরা সালোয়ার কামিজ ও লিপস্টিক পরতে বাধ্য থাকেন। এই যখন পরিস্থিতি তখন এ হেন সংবাদ শিরোনাম করে প্রথম আলো আসলে কী প্রমাণ করতে ব্যস্ত হলো? 

এই শিরোনাম ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয়েছে। দেশে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি চলছে। ইন্টেরিম সরকারের প্রধান ডঃ মুহম্মদ ইউনুস উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলের ওপর যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ার পর ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ঝলসে যাওয়া শিশুদের ভুলে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হেসে হেসে বৈঠক করছেন, ফেসবুক পেইজে দেশের জনগণের কাছে ত্রাণ সহায়তা চাইছেন, আবার তোপের মুখে সেই পোস্ট সরিয়েও ফেলছেন। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লাশ গুম করার, মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পেটানোর অভিযোগ উঠছে। যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনার পরদিন রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেও স্কুল কলেজ খোলা রাখা হলো ও এইচএসসি পরীক্ষা পেছানোর সিদ্ধান্ত এলো দুর্ঘটনার ১৩ ঘণ্টা পর। সব মিলিয়ে দেশের সব মানুষ একসঙ্গে ভয়াবহ ট্রমায় চলে গেছে। 

এই অবস্থায় নারীর পোশাক নিয়ে এমন একটা ইস্যু সামনে আনার একটাই অর্থ হয় তা হচ্ছে মানুষের মনযোগ সরিয়ে ফেলা। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে মাইলস্টোন কলেজের অগ্নিদগ্ধ শিশুদের সরিয়ে দেওয়া। কেননা, এই ইস্যুটি প্রকৃতপ্রস্তাবে কোন ফেমিনিস্ট ইস্যুই নয়। দেশের প্রধান সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো নারী প্রসঙ্গে যে অবস্থান নেয় তা কোনো রকমভাবেই ফেমিনিস্ট স্ট্যান্স নয়, সেটা স্যুডো ফেমিনিস্ট স্ট্যান্স। 

আপনারা লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, আমি লক্ষ্য করেছি, যে কোনও বস্তি পুড়ে গেলে প্রথম আলো অত্যন্ত চমৎকার কিছু ফটোগ্রাফি ছাপে, কোনও এক বা একাধিক শ্রমজীবি নারী চিৎকার করে, হাহাকার করে কাঁদছেন, সঙ্গে শিরোনাম যায়, ধরা যাক, কথার কথা, পুড়ে গেলো সখিনাদের সংসারের স্বপ্ন বা এই জাতীয় কিছু। যেনবা ঘর কেবল নারীরই পুড়েছে, পুরুষেরা যেন ঘরে থাকেই না! এভাবেই দেশে পেইনপর্ন বা পভার্টিপর্ন জার্নালিজম প্রচলন করে প্রথম আলো। ভয়াবহ এসিড সন্ত্রাসের সময় প্রথম আলো নানা শ্লোগান চালু করেছিলো, তার মধ্যে একটা ছিলো এরকম, কাপুরুষেরাই এসিড ছোড়ে। শ্লোগানটার মধ্যে না-বলা কথাটা হচ্ছে, আসল পুরুষরা এসিড ছোড়ে না। কাপুরুষ শব্দটার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ভীরু। এসিড সন্ত্রাসীদের ভীরু বলে হালকা করে ‘বকে দিয়ে’  প্রথম আলো বিরাট নারীবান্ধব সেজে বসেছিলো সে সময়।   

   

অথচ চিন্তার বিষয় এই যে দেশের প্রায় সকল সংবাদমাধ্যম এই পত্রিকাটিকে অন্ধের মতন ফলো করে। এমনকি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করতে গিয়েও দেখি কোনো শব্দের বানান নিয়ে সন্দিগ্ধ হলে সংসদ বাঙ্গালা অভিধান বা বাংলা একাডেমী অভিধান না দেখে প্রথম আলো দ্যাখে লোকে। এদিকে ফেমিনিজম এবং কনজ্যুমারিস্ট  স্যুডো ফেমিনিজম নিয়ে তাত্ত্বিকরা নানা রকমের কাজ করছেন। সামাজিক মাধ্যমে স্যুডো ফেমিনিস্ট কনটেন্ট কী রকমভাবে ছয়লাপ হয়ে গিয়ে টাকাপয়সা উপার্জন করছে তাই নিয়েও রয়েছে বিস্তর গবেষণা। তাই বলছি কি, বাংলা বানান শিক্ষা বা নারীবাদের শিক্ষা  প্রথম আলোর কাছ থেকে শিখে কাজ নেই। নিজের বুদ্ধি দিয়ে নিজে নিজে বোঝাটাই শ্রেয়।  

Comments

    Please login to post comment. Login