জিম্মিদশা ও একজন শিক্ষক--
সুন্দর এক সকাল। দুটো মেঘের মধ্যে যেন সূর্য তার সুন্দর কিরণ ছড়াচ্ছে। আর শীতকাল হওয়ায় সূর্যের আলোটা যেন অনেক মিষ্টি লাগছে। সাততলা বিল্ডিং এর চারতলায় বসে এমনই এক সকাল উপভোগ করছেন রফিক উদ্দিন। চারতলার জানালার পাশে বসে রোদ পোহাতে পোহাতে খবরের কাগজটা হাতে নিলেন রফিক। প্রথম পাতায়েই যেন আশ্চর্যকর খবরে ঠাসা। কুখ্যাত সন্ত্রাসীর দল জেল ভেঙ্গে অস্ত্র লুট করে পালিয়েছে। দিনের শীর্ষ খবর এই। খবরের কাগজটা রেখে চাতে এক চুমুক লাগিয়ে স্কুলে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন রফিক উদ্দিন। ছাত্র হিসেবে নয় শিক্ষক হিসেবে রওনা হলেন স্কুলের দিকে। বাসা থেকে বেশি দূরে নয়। বোধয় ১০ মিনিটের রাস্তা। হেটেই রওনা হলেন রফিক উদ্দিন। স্কুলে পৌঁছেই দেখলেন সকল শিক্ষার্থী প্রতিদিনকার মতো ক্লাসের দিকে রওনা হচ্ছে। সেও অফিসের দিকে রওনা হলেন। কিছুক্ষণ পর ক্লাস শুরুর ঘন্টা বাজলো। সবাই নিজেদের ক্লাসে চলে গেল।রফিক ও বসে রইলেন না দশমের ক্লাসে অংক নিতে চলে গেলেন। কেবলই উপস্থিতির খাতাটা খুলেছেন তিনি। হঠাৎ কি যেন মাথার মধ্যে ঠেকানো হল। সকল শিক্ষার্থীও তার দিকে হা করে চেয়ে আছে। রফিক তাদের চোখ দেখেই বুঝতে পারলেন যে সবাই ভয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাথার ডান পাশে যেন কি একটা ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে তা দেখার জন্যই ডান দিকে মাথাটা ঘোরাতেই দেখতে পায় গালে সেলাই করা বিচ্ছিরি চেহারার এক ব্যক্তি তার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়েছে। তবে মুখ পুরোটা বোঝা যাচ্ছে না শুধু গাল আর নাকটুকুই বোঝা যাচ্ছে বাকিটুকু টুপিতে ঢাকা। ‘কি চাও তুমি’ -রফিক উদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন। কর্কট ভাষায় লোকটি উত্তর দিলেন ‘চুপ একদম চুপ বেশি বুঝলে কিন্তু একেবারে এইডা দিয়া মাথাটা একেবারে উড়িয়া দিমু’। কিছুক্ষণের মধ্যে আরো কয়েকজন বন্দুকধারী ক্লাসে এসে উপস্থিত হল। একজন রফিকের পাশে এসে দাঁড়িয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল- ‘এই পুরো স্কুল আমরা দখল করে নিয়েছি যতক্ষণ পর্যন্ত না সরকার আমাদের সকল মামলা উঠিয়ে নিয়ে আমাদেরকে ৫০০ কোটি টাকা নগদ দিবে ততক্ষণ পুরো স্কুলের সবাইকে আমরা জিম্মি করে রাখবো ও পুরো স্কুল দখল করে রাখবো কেউ এখানে ঢুকতেও পারবে না বের হতেও পারবেনা’।
ওদের মধ্যে পাঁচজন সন্ত্রাসী দশমের ক্লাসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। তারপর যখন তাদের বস তাদের সকলকে একত্রিত হতে বলে তখন ওই পাঁচজনও ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায় এবং রফিকের মোবাইলটি নিয়ে ক্লাসের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে যায়। রফিক নিজের মনকে বোঝালো সে নিজে যদি ভয় পায় তাহলে তার শিক্ষার্থীদের কে সাহস দেবে। তাই রফিক নিজের মনকে শক্ত করে তার সকল শিক্ষার্থীদের কে বলতে শুরু করল –‘তোমরা ভয় পেয়ো না ওরা মনে হয়না আমাদের কোন ক্ষতি করবে আমরা নিশ্চয়ই এই বিপদ থেকে খুব তাড়াতাড়ি মুক্ত হব’। রফিকের ক্লাসে প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থী আছে। মাথার ওপরে ফ্যান চলছে তারপরও প্রতিটা শিক্ষার্থী ঘেমে যাচ্ছে। রফিক বুঝতে পারল তারা সবাই ভয়ে ঘামছে। এরকম পরিস্থিতিতেও রফিক মনে মনে পরিকল্পনা করতে লাগলো কিভাবে এই বিপদ থেকে সবাইকে বাঁচানো যায় তারা সবাই নিরস্ত্র সন্ত্রাসীরা তো অনেক আধুনিক অস্ত্র ও বন্দুক নিয়ে এসেছে। ভাবনা চিন্তার মধ্যে রফিক ক্লাসের বাইরে কার যেন কথা বলার শব্দ শুনতে পেল। হাতে বন্ধুক পিঠে একটি ব্যাগ ও আরেক হাত দিয়ে কানে মোবাইল লাগিয়ে কি যেন বলছে। রফিক দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।যাতে বারান্দায় দাঁড়ানো লোকটা জানালা দিয়ে তাকে না দেখতে পায়। রফিক কান পেতে শুনতে থাকলো লোকটির কথা। ফোনে যেন কাকে বলছে- ‘কি পুলিশ নিয়ে আসবেন সমস্যা নেই স্কুলের সবটিরে খতম কইরা দিমু। শুধু টাকা আর মামলা উঠিয়ে নেওয়ার কাগজ নিয়ে ভেতরে একজন আইবে। সব ঠিক থাকলে আমরা পেছনের গেট দিয়ে চলে যাব। খবরদার পেছনের গেটে যেন পুলিশ গোয়েন্দা না থাকে। থাকলে কিন্তু একেবারে সব খতম আমাদের কাছে কিন্তু রিমোট কন্ট্রোল বোম আছে’। কথাগুলো শুনে রফিক মনের ভিতর আরেক পরিকল্পনা আটলেন। হঠাৎ রফিক তার বুকের বা পাশে হাত দিয়ে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। রফিকের গলার আওয়াজ শুনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি মোবাইল ও বন্দুক পকেটে ভরে ক্লাসের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। লোকটি রফিককে দেখে বুঝতে পারে যে রফিকের হয়তো ভয়ের ফলে হার্টে চাপ পড়েছে এজন্য লোকটি রফিকের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হার্টবিট পরীক্ষা করার জন্য যখনই তার বুকে হাত রাখে রফিক লোকটির হাত ধরে একটা মোচড় দেয় এবং নিজের আরেক হাত দিয়ে লোকটির আরেক হাত একইভাবে মচকে দেয়। তারপর ওই সন্ত্রাসী লোকের দুহাতই পিছনের দিকে নিয়ে লোকটির ঘাড় টাকে মচকে দেয় এবং লোকটির খেলা এখানেই শেষ করে। ঘটনাটি এত তাড়াতাড়ি ঘটে যে ক্লাসের কেউ সেটা বুঝে উঠতে পারেনা। রফিক মেঝেতে বসে পড়ে এবং লাসের দিকে চেয়ে থাকে। নিজের জীবনের প্রথম খুন একটু হলেও নিজেকে দোষী মনে হয়। যাইহোক সবাইকে বাঁচানোর জন্য এটুকু তো করাই যায়। আবার উঠে দাঁড়িয়ে রফিক সন্ত্রাসী লোকটির ব্যাগ চেক করে। ব্যাগে বেশি কিছু নেই শুধু দুই রাউন্ড গুলি ও দুটি গ্রেনেড। রফিক ভেবেছিল রিমোট কন্ট্রোল বোম টি হয়তো বা এই ব্যাগে তেই রয়েছে। তবে আরেকটু খুঁজতেই রফিক একটি আশানুরূপ জিনিস খুঁজে পেল। একটি সাইলেন্সার। যা লাগিয়ে গুলি করলে শব্দ শোনা যায় না। সাইলেন্সার্টি দেখে রফিক একটু খুশি হলো। এদিকে রফিকের এরকম ক্ষমতা দেখে সকল শিক্ষার্থী তাকে জিজ্ঞেস করল- ‘স্যার আপনি এরকম ফাইট কোত্থেকে শিখেছেন’। রফিক বলে- ‘এই স্কুলে চাকরি করার আগে আমি এক বছর সেনাবাহিনীতে ছিলাম।কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার শ্বাসনালীতে একটি রোগ ধরা পড়ে। তাই আমি সেনাবাহিনী ছাড়তে বাধ্য হই’। কথা বলা শেষ করে রফিক সাইলেন্সারটি সন্ত্রাসী লোকের বন্ধুকের সামনে লাগিয়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে সকল শিক্ষার্থীকে বলে যায় ‘ওই লাশটা একদম পিছনে রেখে তোমাদের সবার ব্যাগ দিয়ে ঠেকে ফেলো এবং কেউ আসলে বলবে আমাদের স্যার অসুস্থ হওয়ায় একজন লোক তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে’। এরপর রফিক ক্লাসের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে সামনের দিকে এগোতে থাকে কিছুটা এগোতেই রফিক আরেকটা লোককে দেখেই পাশে থাকা দেয়ালের পেছনে লুকিয়ে পড়ে এবং বন্দুক দিয়ে একদম সন্ত্রাসী লোকটির মাথায় গুলি করে। সাইলেন্সার লাগানো থাকায় গুলির শব্দ শোনা যায়নি। রফিক এগিয়ে গিয়ে দেখতে পায় লোকটির মাথা ভেদ করে গুলি বের হয়ে গেছে। আর চারিদিকে রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। এ দেখে রফিকের বুঝতে দেরি হয়না বন্দুকটা কত আধুনিক। যাইহোক যেহেতু রক্ত অনেকটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে তাই রফিকের অন্য কোনো উপায় খুজতে হয়।অন্যদিকে যে সন্ত্রাসীকে কেবল মারা হলো তার কাছে একটি রাইফেল ছিল ও একটি বন্দুক ছিল ।রফিক রাইফেল টি হাতে নিয়ে নিল ও আগের বন্দুকটা সহ দুটো বন্ধুকই পকেটে ভরলো। রাইফেলটি অনেক আধুনিক ও এতে যথেষ্ট পরিমাণ গুলি রয়েছে। আর বেশি দেরি না করে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী সে একটি গ্রেনেড তাদের স্কুল মাঠে মেরে দেয় এবং সে একটি দেয়ালের পাশে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তার ভবনটি ছিল চারতলা বিশিষ্ট এবং সে ছিল দ্বিতীয় তলায়। সে সিড়ির দিকে নজর রাখতে শুরু করে ওপর তলাগুলো থেকে কেউ নামছে কিনা সেটা দেখার জন্য। বিকট শব্দে গ্রেনেড ফাটায় সকল সন্ত্রাসী বুঝতে পারে এটা তাদেরি গ্রেনেড। এজন্য সকল সন্ত্রাসী গ্রেনেড যেখানে ফেটেছে সেদিকে রওনা দেয়। তবে প্রশ্ন একটাই রফিক কিভাবে জানল যে সন্ত্রাসের দল মাঠে গ্রেনেড ছুড়লে একত্রিত হবে। আসলে প্রথমে রফিক যাকে মেরেছিল তার ব্যাগে একটি ম্যাপও ছিল। যেই মাপেই বলা ছিল যদি তাদের দল কোন সমস্যার মধ্যে পড়ে তাহলে এই দুই গ্রেনেডের এক গ্রেনেড মাঠের মাঝে ফাঠালে সবাই ওইখানে গিয়ে একত্রিত হবে। তো রফিক তার পরিকল্পনা অনুযায়ী পরের ধাপে যাওয়ার জন্য বাকি থাকা গ্রেনেডটি বের করতে যায়। কিন্তু হঠাৎ একজন সন্ত্রাসী পেছনের দিক থেকে তার গলা আটকে ধরে। কিন্তু লোকটি লম্বায় কম হওয়ায় খুব সহজে রফিক তাকে তুলে আছাড় মারে এবং মাথায় সাইলেন্সার যুক্ত বন্দুক দিয়ে গুলি করে। আর সন্ত্রাসী লোকটির মৃত্যু নিশ্চিত করে। তাও রফিকের ভাগ্য ভালো এই সন্ত্রাসী লোকটি নিরস্ত্র ছিল। এবার একদম পূর্ণ প্রস্তুতিতে গ্রেনেডটি সব গুলো সন্ত্রাসীর ওপর মারে এবং রাইফেলটি হাতে নিয়ে একযোগে ওই জায়গায় গুলি করতে থাকে যাতে সকল সন্ত্রাসীর একেবারে মৃত্যুর নিশ্চিত করা যায়। গুলি করা শেষ করে রফিক তার ক্লাসের দিকে ছুটে গিয়ে ক্লাসের দরজা খুলে দেয় ও সবাইকে বলে সব ক্লাসের রুম যেন খুলে দেয়। কথাটি বলতে বলতে হঠাৎ সে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে এবং মাটিতে পড়ে গিয়ে ছটফট করতে শুরু করে। মূলত তার শ্বাসনালীতে একটি অপারেশন করা ছিল আর ওই যে সন্ত্রাসী লোকটা তার গলার পেছন থেকে চেপে ধরেছিল ঐ সময় রফিকের শ্বাসনালীতে থাকা সেলাই ছুটে যায়। এই কারণে সে শ্বাস নিতে পারছে না। হঠাৎ রফিকের ছটফটানের মধ্যে তার গলা দিয়ে রক্ত পড়া শুরু করে এ দেখে তার সকল ছাত্র-ছাত্রী দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয় কেউ পানি আনতে যায় কেউ তাকে ধরে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকে কেউবা অন্য শিক্ষকদের মুক্ত করে রফিক এর কাছে নিয়ে আসতে চায়। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয় না রফিক ওখানেই তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
গল্পটি সকল আদর্শ শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে যারা আমাদের সব সময় আদর্শ শিক্ষাদান করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে।
সালাম ঐ সকল
আদর্শ শিক্ষকদের
-লেখক মোহাম্মদ লাবীব