আজ থেকে বহুবছর আগে, ইংল্যান্ডে জন নামে এক ছেলে স্কুলে পড়তো। স্কুলে বাচ্চারা পড়ালেখা শিখলেও জনের এই কাজে খুব দক্ষ হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। সে ছিল ডিসলেক্সিক। এই সমস্যায় যারা আক্রান্ত হয়, তারা ঠিক করে কোনো কিছু পড়তে পারে না। এর সাথে, নিয়মিত সহপাঠীদের দ্বারা ব্যুলির শিকার হওয়া জন স্কুল ছাড়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে।
কাট টু ১৯৮৪। না, জর্জ অরওয়েলের ডিসটোপিয়ান উপন্যাসের জগতে নয়। বরং, আমাদেরই এই পৃথিবীর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায়, জন নামেরই এক ছেলে গান শুনতে শুনতে নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করে৷ সে কার গান শুনছিল জানেন? আমাদের সেই ঠিকমতো লেখা পড়তে না পারা জন-এর। যদিও, বিশ্ব তাকে চেনে অজি অজবর্ন নামে। সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে যিনি হেভি মেটালের গডফাদার।
তার এই অজি নামটা নিয়েও একটা ঘটনা আছে। এই নামে তাকে তার স্কুলের সহপাঠীরা ব্যুলি করতো। অন্য স্বাভাবিক মানুষ হলে যে কেউই এটা ভুলে যেতে চাইতো। কিন্তু, অজি ছিলেন আলাদা। তিনি বরং এই নামটিকেই ব্যবহার করেছেন। হয়ে উঠেছেন সঙ্গীতের এক মহিরুহ। শেষে এমন অবস্থা হলো যে, জন নামে তাকে কেউ ডাকলে আর সে উত্তরই পেতো না।
স্কুল ছাড়ার পর নানা জায়গায় কাজ করতে করতে ১৯৬৭ সালে রেয়ার ব্রিড ব্যান্ডে গায়ক হিসেবে যোগ দেন। এবং পরের বছর ১৯৬৮ সালে ব্ল্যাক সাবাথ ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠা করেন অজি। যদিও, প্রথমে ব্যান্ডের নাম ঠিক করা হয় আর্থ কিন্তু একই নামে আরেকটি ব্যান্ড থাকায় এক ইতালিয়ান সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দলের নামকরণ করা হয় ব্ল্যাক সাবাথ।
অতিরিক্ত পরিমাণে মদ্যপান ও নেশাদ্রব্য গ্রহণের অভিযোগে ১৯৭৯ সালে তারই প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ড থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। অন্যান্য সদস্যদের মত ছিল যে অজির সাথে নাকি কাজ করা যায় না। এরপর তিনি সোলো করতে শুরু করেন।
ডার্ক ঘরানার গা ছিমছিমে সুরে তিনি গানের মাঝে তুলে ধরেন যুদ্ধাপরাধী বার্তা৷ প্রশ্ন করতে থাকেন ধর্মকে নিয়ে। গানের মাঝে চলে আসে মানসিক টানাপোড়েন। সাথে থাকে অবধারিতভাবে মৃত্যু নিয়ে দার্শনিক ভাবনা। অজির গানে মৃত্যু অবধারিতভাবে কেন আসে জানেন? নিজের বয়স আঠারো হওয়ার আগেই, অর্থাৎ, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই আমাদের অজি অজবর্ন কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। অবশ্যই তিনি সফল হতে পারেননি। ভাগ্যিস, সেই বালকের প্রচেষ্টাগুলো তার জীবন একেবারে কেড়ে নিতে সক্ষম হয়নি। যদি হতো, তবে ৭৬ বছর বয়সে, এই জুলাই মাসের শুরুতে, নিজের জীবনের শেষ কনসার্টে, মামা আই এম কামিং হোম গেয়ে কখনো মানুষকে কাঁদাতে পারতেন না।
এসবের পাশাপাশি, মৃত্যু অজির জীবনে ও গানে প্রভাব ফেলেছিল। একবারের ঘটনা বলি। অজি তখন বিবাহিত। ঘরে আছে সন্তানও। বিয়ে করেছেন নিজের ম্যানেজার শ্যারেনকে। শ্যারেনের বাবাই মূলত অজির ম্যানেজার ছিলেন, পরে হন মেয়ে। বেশ কিছুকাল ধরে দাম্পত্যে কলহ ও বহুবিধ সমস্যার মুখোমুখি হতে হতে এক রাতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অজি মারতে বসেন নিজের স্ত্রীকে। যদিও একেবারে যমের দুয়ারে পাঠাতে পারেননি। কিন্তু, তার বিরুদ্ধে হত্যার চেষ্টা চালানোর মামলা করেন শ্যারেন। এই ঘটনায় বেশ কাঠখড় পোড়াতে হলেও শেষে দুজনের মিল-মহব্বত আবার হয়ে গিয়েছিল। শ্যারেন পাশে ছিলেন অজির জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
নানা সময়ে বিভিন্ন কারণে মামলা হয়েছে অজির বিরুদ্ধে। একেবারে শুরুতে জন নামে এক ছেলের আত্মহত্যার কথা বলেছিলাম মনে আছে? যে অজির গান শুনতে শুনতে এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গুলি করেছিল নিজেকে। তার পরিবার থেকে অজির নামে মামলা করা হয়। যদিও আদালতে প্রমাণ হয়নি কোন দোষ।
অজির যে গানটি জনকে আত্মহত্যার দিকে নিয়ে গিয়েছিল সেটি হলো সুইসাইড সলিউশন। যে গানের এক লাইনে লেখা ছিল, Why try? Get the gun and shoot!
জুলাইয়ে হয়ে যাওয়া যে অজির শেষ কনসার্টে প্রায় ১৯০ মিলিয়ন ডলার (২৩০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ) চ্যারিটি উত্তোলন করা হয়েছিল, মৃত্যুর সময়ে যিনি রেখে গিয়েছিলেন প্রায় ২২০ মিলিয়ন ডলার অর্থমূল্যের সম্পদ, সেই গায়কটিকেই একসময় অর্থের জন্য কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। এমনকি কাজ করেছেন বার্মিংহামের এক কসাইখানাতেও।
অজি তখন কৈশোরে। ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়লেন। কিন্তু, জরিমানা দেওয়ার মতো টাকা নাই। এই কারণেই কয়ে সপ্তাহ জেলে আটকে রাখা হয়েছিল তাকে। যদিও, এই ঘটনাকে নিজের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা বলে ধরতেন অজি।
১০০ মিলিয়নেরও বেশিবার বিক্রি হওয়া অজি অজবর্নের গানে ভক্তরা খুঁজে পায় আত্ম-অনুসন্ধান, দেখতে পায় নির্বিকার সত্যবাদিতা। তার গান ব্যবহৃত হয়েছে সিনেমায়, মিউজিক শো-তে, ভিডিও গেমে-সহ নানা মাধ্যমে।
দীর্ঘদিন ধরে পারকিনসন ডিজিজে ভুগতে থাকার পর অবশেষে ২২ জুলাই হেভি মেটাল দুনিয়ার অন্যতম এই প্রাণপুরুষ দেহত্যাগ করেছেন। আর কোনোদিন অজি অজবর্ন কনসার্ট করবেন না। আর কখনো নেশা করবেন না। আর কখনো তার কোনো গান বের হবে না।
অড সিগনেচার-এর ‘আমার দেহগান’ গানে একটা লাইন আছে এমন,
‘সেই দিনে এক গানে এক গল্পকারের গল্প খুঁজে পাবে,
খুঁজে পাবে না সেই গল্পকার।’
ঠিক এই লাইনগুলোর মতো করে, অজি অসবর্ন চলে গেছেন। যদিও তার গানগুলো রয়ে যাবে চিরকাল, কিন্তু, আর তাকে কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না।