ঘরজুড়ে ভারী হয়ে থাকা নীরবতা একটু একটু করে হালকা হচ্ছিল।
তবুও কারও মুখে কোনো স্বস্তির ছায়া নেই—
তৃষার চোখে অভিমান, হেনার চোখে আতঙ্ক আর কৃতজ্ঞতা,
আর আরিয়ানের চোখে শুধুই ক্লান্তি।
আরিয়ান আস্তে করে সামনে এগিয়ে এসে মিস্টার আমানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মিস্টার আমান, আমি একটা অনুরোধ করতে চাই…
হেনা এখন খুব বিপদে আছে।
আমি ওর থাকার স্থায়ী ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি,
কিন্তু ততদিন যদি ওকে আপনার কাছে কিছুদিন রাখতেন…
আমি খুব কৃতজ্ঞ হতাম।”
মিস্টার আমান কিছু বলার আগে একবার তৃষার দিকে তাকালেন।
তৃষা তখন চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো—
না রাজি, না অরাজি—
শুধু একটা বোবা অভিমান জমে আছে তার চোখের কোণায়।
আমান বুঝে গেলেন তার সম্মতির অর্থ কী।
তৃষা মুখে কিছু না বললেও, চোখে রাজি না থাকার মতো কিছু ছিল না।
তাই আমান আস্তে করে বললেন—
“ঠিক আছে, অসুবিধা নেই।
তবে যদি আপত্তি না থাকে, হেনা এই বাংলো বাড়িতেই থাকুক।
এখানে নির্জনতা আছে, নিরাপত্তা আছে।
আর শহর থেকেও একটু দূরে—
যেকোনো সমস্যার থেকে দূরে রাখা সহজ হবে।”
আরিয়ান একটু ভেবে বললো—
“চলবে, অসুবিধা নেই।
তাছাড়া আমি জানি আপনি এখানে রাখলে ওর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা থাকবে না।
আমি তাহলে অন্তত নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো।”
এই কথার মাঝে হেনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল,
কোনো শব্দ করছিল না,
তবে তার চোখে তখন অশ্রু আর কৃতজ্ঞতার এক অপূর্ব মিল।
আরিয়ান চোখের কোন দিয়ে তাকাল ওর দিকে—
হেনা ওর দৃষ্টি টের পেয়ে আস্তে করে চোখ নামিয়ে ফেলল।
মিস্টার আমান আবার সার্ভেন্টকে ডেকে বললেন—
“এই মেয়েটার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করো।
শান্ত, পরিষ্কার যেন হয়।
ও যেন কোনো কষ্ট না পায়।”
সার্ভেন্ট সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো।
তৃষা তখনো নীরব।
তবুও চোখের দৃষ্টিতে চলছিল এক অজানা যুদ্ধ।
হেনা একটু বিচলিত হয়ে পড়লো। চোখে এক অজানা ভয়, শরীরটা যেন কেঁপে উঠছে বারবার। আরিয়ান সেটা এক পলকেই বুঝে ফেললো।
সে একটু এগিয়ে এসে হেনার কাঁধে হাত রাখলো, তারপর অস্থির ভাবে বললো,
— “তুই…”
ততক্ষণে নিজের ভুল বুঝে নিয়ে তাড়াতাড়ি নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললো,
— “তুমি চিন্তা করো না… এখানে কোনো সমস্যা হবে না। কেউ তোমাকে কষ্ট দিতে পারবে না। আমি আছি।”
হেনা চোখ নামিয়ে ফেলে। তার ভিতর কৃতজ্ঞতা, লজ্জা, আর একরাশ অস্বস্তি…
আরিয়ানও অনুভব করলো কিছু, চোখ সরিয়ে নিলো।
ঠিক তখনই মিস্টার আমান এসে বললেন,
— “আসুন আরিয়ান, আমরা যে কারণে আজ দেখা করতে চেয়েছি, সেটা আলোচনা করি।”
আরিয়ান মাথা নাড়ল সম্মতির ভঙ্গিতে।
তারপর মিস্টার আমান হেনার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “মিস হেনা, আসুন আমি আপনার রুমটা দেখিয়ে দেই।”
এরপর তৃষার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বললেন,
— “আপনারা দুইজন কথা বলে নিন।”
মিস্টার আমান হেনাকে নিয়ে চলে গেলেন। করিডোর দিয়ে যেতে যেতে সার্ভেন্টকে বললেন,
— “এই মেয়েটি আমার অতিথি। কিছুদিন এখানে থাকবে। তার যত্নে যেনো কোনো ত্রুটি না হয়।”
হেনার জন্য নির্দিষ্ট একটি অতিথি ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। ঘরটা ছোট হলেও গুছানো, শান্ত আর নিরাপদ। হেনা চারদিকে তাকিয়ে কিছুটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
এইদিকে মিস্টার আমান চলে এলেন গার্ডেন এরিয়াতে। সেখানে একটা কাঠের বেঞ্চে বসে পড়লেন। মন যেন খুব ভারী, চুপচাপ। পেছনের সব ঘটনা, এখনকার জটিলতা, আর ভবিষ্যতের দ্বিধা—সব মিলিয়ে মাথার ভিতর একটা চাপা কুয়াশা।
নিজেকে একটু স্থির রাখার চেষ্টা করছেন, যাতে আরিয়ান আর তৃষা শান্তভাবে তাদের কথাগুলো শেষ করতে পারে।
অন্যদিকে বাংলোর ভিতরের রুমে, তৃষা জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলো। কিছু না বলেও অনেক কিছু বোঝা যায় তার শরীরী ভাষা থেকে। তখনই আরিয়ান উঠে এসে তার পাশে বসলো। কিন্তু তৃষা অল্প করে একটু সরে গেলো।
এই ক্ষণিকের দূরত্ব যেন হাজার মাইলের।
দুই জনেই বুঝে ফেললো—এই কয়েক দিনের ব্যবধানে তাদের মাঝে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে। অথচ কিছুদিন আগেও যেখানে ভালোবাসা ছিলো সবচেয়ে কাছের অনুভূতি, সেখানে আজ নীরবতা, অভিমান আর একরাশ কষ্ট।
আরিয়ান চুপ করে তৃষার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, কিছু বলার চেষ্টা করলো না।
তৃষাও তাকাল না… শুধু বুকের গভীরে জমে থাকা কষ্টটাকে চেপে রাখলো। যেন কিছু বললেই অঝোরে কেঁদে ফেলবে।
বাতাস ভারী হয়ে উঠলো…
শান্ত রুমটার ভিতরে, শুধু বোঝা গেলো—ভালোবাসা এখন আর কেবল হৃদয়ের শব্দ নয়, বরং অজস্র ভুল বোঝাবুঝির মধ্যে পথ খুঁজে ফিরছে।
চলবে......