রুমজুড়ে একটা গভীর নিস্তব্ধতা। জানালার পাশ দিয়ে বাতাস এসে পর্দা হালকা দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তৃষা এক কোণে বসে আছে, চোখে জল ধরে রাখা সেই চেনা কাঠিন্য, আরিয়ান দাঁড়িয়ে সামনে, দু’হাত শূন্য—যেন কিছু বোঝাতে চাইছে।
আরিয়ান নরম গলায় বললো,
— “তুমি কিছুই বলবে না, তৃষা? আমি জানি, আমি অনেক বড় ভুল করেছি। কিন্তু প্লিজ… কিছু তো বলো।”
তৃষা ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকালো। তার দৃষ্টিতে অনুরাগ আর অভিমানের মিশ্র ছায়া। তারপর নিচু গলায় বললো,
— “তোমার একটু ভুল… শুধু একটা ভুল, আর আমি আজ কোথায় দাঁড়িয়ে… দেখতে পাচ্ছো, আরিয়ান?”
তৃষার গলা কেঁপে ওঠে,
— “আজ আমি অন্যের ঘরের বউ। আমি কারো বৌমা, কারো পুত্রবধূ… অথচ আমার আত্মা—আমার মন, আজও তোমার জন্য কাঁদে। কিন্তু তাতে কী আসে যায়?”
এই বলে চোখ থেকে নীরব অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। আরিয়ান এগিয়ে এসে কিছুটা কাছে আসতে চায়, কিন্তু তৃষা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয়।
— “এই অধিকার তোমার নেই আর, আরিয়ান। তুমি সেটা অনেক আগেই হারিয়েছো।”
আরিয়ান থেমে যায়। মুহূর্তটা যেন স্তব্ধ হয়ে থাকে।
তৃষা এবার এক গভীর নিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করে,
— “একটা কথা বলো আমাকে… কে এই হেনা? তোমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক কী?”
আরিয়ান কিছু বলতে যায়,
— “আমি তো বললাম…”
— “যা বলেছ, তাই যেনো সত্যি হয়,” তৃষা ঠান্ডা গলায় বলে, “আর যদি সেটা সত্যি না হয়, তাহলে…”
আরিয়ান তৎক্ষণাৎ কথার মাঝেই বলে ওঠে,
— “তাহলে কী?”
তৃষা একটু চুপ করে, মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ধীরে বলে,
— “তাহলে আমি তোমাকে কোনো দিন ক্ষমা করবো না।”
ঘরে আবার নীরবতা। কয়েক মুহূর্ত পর হঠাৎ আরিয়ান হেসে ফেলে। সেই চিরচেনা হাসি, তৃষার হৃদয় কাঁপানো হাসি।
আর বলল,
— “তার মানে… এখন তুমি আমাকে মাফ করে দিয়েছো।”
তৃষা একটু বিস্ময়ে তাকায়। তার ঠোঁটের কোণে এক বিন্দু নরম হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
— “হ্যাঁ…”
আরিয়ান তখন চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে বলে ওঠে,
— “তৃষা! আজ আমি অনেক, অনেক খুশি…”
তার গলার কাঁপন, চোখে জল, আর মুখে হাসি—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবেগপূর্ণ মুহূর্ত তৈরি হলো।
তৃষা বললো,
— “আস্তে… একটু আস্তে বলো, কেউ শুনে ফেলবে।”
ওই দিকটায়, করিডোরের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিস্টার আমান। কথা বলছিলেন না, কিন্তু তার দৃষ্টি ঘরের ভিতরকার দৃশ্য গিলে নিচ্ছিলো এক নিঃশব্দ যন্ত্রণায়।
আরিয়ান আর তৃষা—দুইজনেই বসে আছেন, মুখোমুখি, চোখে চোখ রেখে আবেগে ডুবে থাকা এক মুহূর্তে। যেন পুরোনো সব ব্যথা, ভুল বোঝাবুঝি, অভিমান সব পেরিয়ে তারা আবার এক হতে চাইছে। হাসিমুখে কথা বলছে, চোখে জল, ঠোঁটে নরম হাসি। তৃষার চোখে যেন এক আশ্বাস—"তুমি ফিরে এসেছো", আর আরিয়ানের মুখে লুকোনো স্বস্তি—"তুমি মাফ করে দিয়েছো"।
এই দৃশ্য দেখতে দেখতে মিস্টার আমান ভেতরে ভেতরে মোচড় খেতে লাগলেন। মনে হচ্ছিলো কেউ যেনো তাঁর বুকের ভেতর থেকে খুব মূল্যবান কিছু ছিনিয়ে নিচ্ছে।
তৃষা—যে মেয়েটিকে তিনি নিঃস্বার্থভাবে ভালবেসে ফেলেছিলেন, যার হাসির জন্য তিনি জীবনের অনেক গোপন ব্যথা চেপে রেখেছিলেন, যার জন্য নিজের অবস্থানকেও উপেক্ষা করেছিলেন, আজ সে তাকেই ভুলে যাচ্ছে।
তাঁর মাথার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো একটাই প্রশ্ন—
"এই আমি, যে ওদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম সব ভুলের সময়, আমি কি সত্যিই কিছুই না?"
হঠাৎই মিস্টার আমান নিজের হাত মুঠো করে ফেললেন। চোখে জল জমেছে, কিন্তু তা কাউকে দেখাননি। ঠোঁটের কোণে এক অসমাপ্ত হাসি—একটা অপূর্ণতা।
ওদিকে, আরেক রুমে বসে আছে হেনা। বিছানার এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে, দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে রেখেছে। চুল এলোমেলো, চোখ অশ্রুতে ভেজা। চারপাশের নীরবতা যেন তাকে আরও চেপে ধরছে।
তার চোখে ভাসছে সেই মুহূর্ত, যখন সে আরিয়ানকে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল… কিন্তু পারেনি।
হেনার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো।
"ও শুধু আমাকে বাঁচাতে চেয়েছে… আমি তো শুধু একটা বোঝা ছিলাম ওর কাছে… আমি তো ওর কিছু নই।"
আর সেই মানুষ, যার স্পর্শ তাকে ভরসা দিয়েছিল, সেই মানুষ আজ অন্য কারো চোখে ডুবে আছে।
হেনা জানে, তার ওপর অন্যায় হয়েছিল, কিন্তু সে চাইছিল না শুধুমাত্র করুণা হয়ে বেঁচে থাকতে।
তার মনে হচ্ছিল, আজ এই ঘরে ওর কোনো অস্তিত্ব নেই।
আরিয়ানকে সে ভালোবেসে ফেলেছিল, অথচ আজ সেই আরিয়ান তার সামনে, তবুও একেবারে দূরের কেউ।
এমন এক রুমে বসে, যেখানে সে অতিথি কিন্তু যেন অবাঞ্ছিত।
আরিয়ান—তৃষার ভালোবাসায় ফিরে গিয়েছে।
আর মিস্টার আমান, যিনি বিপদের দিনে রক্ষক হয়েছিলেন, সেই মানুষটিকে ভুলে গিয়েছে তৃষা।
আজ তৃষা তার সামনে বসে হাসছে, সেই মানুষটির সঙ্গে—যে একদিন তাকে ফেলে গিয়েছিল।
আর হেনা, ভাঙা শরীর আর নিঃশেষ আত্মা নিয়ে বসে আছে নিঃসঙ্গ রুমে।
দুইজন, মিস্টার আমান আর হেনা—দুজনেই আজ কিছু না বলেই কাঁদছে,
যাদের ভালোবাসা ছিল নিঃশব্দ,
আর যাদের হারানোটা কেউ দেখছে না।
চলবে......