শহরে আজ বৃষ্টি নামল। বহুল প্রতীক্ষিত, কাঙ্খিত বৃষ্টি। ঈদের দিন পাওয়া সালামির মত শিল পড়ল বৃষ্টির সাথে। পীচঢালা কালো রাস্তা শিলায় সাদা হয়ে রইল অনেকক্ষণ। জলমগ্ন ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় মনের বদ্ধ কপাট গুলো খুলে গেল। বুক ভরে ঠান্ডা, সতেজ বাতাস টেনে নেয়া। ক্রোধ, নিরাশা, গ্লানি, হীনমন্যতার হাওয়ায় উড়ে যাওয়া। বৃষ্টি সুস্থ্য হয়ে ওঠার তাগিদ নিয়ে এল। বললো ভালো থাকতে।
'নীল রং' আকাশ আর সমুদ্রের, এভাবে ভালো থাকতে বলতে পারে। সবুজ উপত্যকা, পর্বত চূড়ার বরফ এভাবে ভালো থাকতে বলে। মেঘনা নদী, যার পাড়ে দাঁড়ালে ওপাড়ে শুধু পানিতে নুয়ে পড়া আকাশ দেখা যায়, এভাবে ভালো থাকতে বলে। দ্বীপ গুলোর, নদী কি সমুদ্রের, ক্ষমতা আছে মানুষকে শুভ কামনা জানানোর। এরকম ক্ষমতা আছে আরও বহু কিছুর।
আজকের কালবৈশাখী, সুন্দর জীবনকে মনে করিয়ে দিল।
এক সময় ভারী বৃষ্টি হালকা হয়ে ঝিরঝির করে ঝরতে থাকে। এরপর বৃষ্টি থেমে যায়। আমি আবার ইব্রাহিমের ছোট্ট হাতটি মুঠোবন্দি করে রাস্তায় হাঁটতে থাকি। একটি বিপণিবিতাণ পিতা-পুত্রের গন্তব্য।
স্যান্ডেলের ফাঁক গলে বরফ গলা ঠান্ডা পানির গোড়ালিতে শীতল স্পর্শ। আমার নাকে মুখে ভেজা বাতাসের প্রশান্তি। রাস্তার পীচ উঠে গিয়ে তৈরি হওয়া গর্তে বৃষ্টির পানি জমে থাকে। ঘন সুপারি বাগানের মাঝে লুকিয়ে থাকা একটি ডোবার কথা আমার মনে পড়ে যায়। জমে থাকা বৃষ্টিতে ইব্রাহিম তার প্রতিচ্ছবি দেখে খুশি হয়ে ওঠে। আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে ঐ পানিতে নেমে লাফাতে থাকে। আমি জোর করে আবার তাকে মুঠোবন্দি করে হাঁটতে লাগলাম।
একসময় আমরা বড় রাস্তার ফুটপাতে উঠে আসি। রাস্তার দুই দিকে আলো ঝলমলে কাঁচের দোকানঘর। তারা জ্বলা আকাশের মত। মনে হয় যেন ছায়াপথ ধরে হাঁটছি। রাস্তায় মোটরগাড়ির ভীর। ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে হর্ণ বেজে ওঠে। ক্রিং ক্রিং শব্দে রিকশা বাজে। দোকানের সাইনবোর্ড গুলো জোনাকির মতো জ্বলে-নেভে। বাতাসে ভাজা মাংসের ঘ্রাণ। বিষ্মিত ইব্রাহিম জোরে জোরে হাঁটে। সবচেয়ে উজ্জ্বল দুটি তারার মত, তার চোখ খুশিতে জ্বল জ্বল করে।
জীব জন্তুর বেলুন, বাঁশি আর হাওয়াই মিঠাইয়ের ভ্রাম্যমাণ হকাররা ইব্রাহিমকে চুম্বকের মত টানে। সে আমাকেও তাদের কাছে টেনে আনে। একটি হাওয়াই মিঠাই কিনে দিলে সে কিছুটা শান্ত হয়।
হাতের মুঠোয় ইব্রাহিমকে নিয়ে আমি বড় রাস্তাটি সাবধানে অতিক্রম করি। আমাদের গন্তব্য, বিপণিবিতাণটিতে এসে পৌঁছাই। প্রবেশ করি আলোর সমুদ্রে।
আমার হাতের মুঠোয় ইব্রাহিমের উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বিস্মিত চোখে সে চতুর্দিকে দেখে।
মোবাইল ফোনের দোকানে একই রকম টি-শার্ট গায়ে কিছু ঝলমলে তরুণী সেট গুলোকে ক্রেতার কাছে উপস্থাপন করে। তাদের ঠোঁটে চাঁদের মত হাসি লেগে থাকে। গয়নার দোকানগুলো উজ্জ্বল শিল্পের মত জ্বলে। শাড়ি আর ওড়না গুলো ক্যানভাসের মত। কোনটিতে ইশ্বর তার প্রকৃতির প্রতিলিপি এঁকেছেন, কোনটিতে শিল্পী তার কল্পনা। শার্ট, প্যান্ট, সেলোয়ার, কামিজ গায়ে মানুষের ডামি সত্যিকার মানুষের কল্পনার খোরাক যোগায়। সহস্র পণ্যের অজস্র বর্ণে, নকশায়, আলোয় এক নতুন পৃথিবী তৈরি হয়। ইব্রাহিম তার বিমুগ্ধ দর্শক।
ইব্রাহিমের ছোট ছোট পদক্ষেপ হঠাৎ থেমে যায়। হাতের মুঠোয় টের পাই। সে একটি খেলনার দোকানের দিকে তাকিয়ে আছে। খেলাঘর লেখা সাইনবোর্ডটি জ্বলছে। আব্বু ওই দোকানে যাব, বলে সে খেলাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। আমরা দরজার সামনে দাঁড়ানো মাত্র, কাঁচের দুটি কপাট সয়ংক্রিয়ভাবে দুদিকে সরে যায়। ইব্রাহিম এক আশ্চর্য জগতে প্রবেশ করে।
ইব্রাহিমের অবাক চোখে তখন নক্ষত্রের দীপ্তি। কাঁচের দেয়ালের আড়ালে এক পুরো সেনাবাহিনী। রাজা, রানী, সেনাপতি। বিকট হা করে থাকা সিংহ। ভালুক ঢোল বাজায়। রেলগাড়ি এখনই ছেড়ে যাবে বোধহয়। ছক কাটা দালান কোঠা। এরোপ্লেন যেন এখনই উড়াল দেবে পাখির মত। হরিণের দলের পাশে অভিজাত বাঘ। মোটরগাড়ি যার দরজা খোলে। হাসপাতাল, এম্বুলেন্স, দমকল বাহিনী। নৃত্যরত রাজকন্যা। আরও অসংখ্য খেলনা। ইব্রাহিম এখনও চেনে না এমন। সে কাঁচের দেয়ালে নাক ঘষে, চোখ জোড়া চেপে ধরে। বিক্রেতাগণ ইব্রাহিমের খুশি দেখে আনন্দিত হয়। একটি বিক্রেতা মেয়ে তার হাত ধরে আরও খেলনা দেখাতে নিয়ে যায়। আরবী ঘোড়া, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, মোটরগাড়ি। ইব্রাহিম ওসবে আরোহণ করে। মেয়েটি তাকে ওগুলো চালাতে সাহায্য করে। ইব্রাহিমের আরবী ঘোড়াটি পছন্দ হয়। আব্বু এটা কিনা দিবা? বলে সে আমার দিকে তাকায়। বিক্রেতা মেয়েটির কাছ থেকে ঘোড়াটির মূল্য আট হাজার টাকা জানা যায়। আমি ইব্রাহিমকে জানাই টাকা নিয়ে আসা হয়নি। পরে কিনে দেব। ওকে মুঠোয় নিয়ে আমি খেলাঘর থেকে বেরিয়ে আসি। চোখের কোণে বিক্রেতাগণের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি দেখি। ইব্রাহিমের হাঁটার গতি ক্রমশ কমে আসে।
হাতের মুঠোয় ইব্রাহিমকে নিয়ে আমি দ্রুত আমার গন্তব্যে যেতে থাকি। একটি চলন্ত সিঁড়িতে আমরা আরোহণ করি। সিঁড়িটি আমাদের আরেক তলায় পৌঁছে দেয়। অভিজ্ঞতাটি ইব্রাহিমের কাছে অভিনব। তাকে অভিভূত, আনন্দিত করে। আলোর বন্যায় আমরা হাঁটি। একটি তরুণী, তাজা রজনীগন্ধার মত, আমাদের পেরিয়ে যায়। নাকে অনেকক্ষণ তার সৌরভ লেগে থাকে। একজোড়া তরুণ-তরুণী হাত ধরে হাঁটে। একটি লোক, দুহাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে হনহন করে চলে। তার পেছনে তার স্ত্রী এখনও কেনা হয়নি সেসব পন্য কাঁচের দেয়ালের ওপাড়ে খোঁজে। পুতুলের মত একটি মেয়ে আইসক্রিম হাতে বাবার পাঞ্জাবির ঝুল ধরে হাঁটে। এসব ব্যাস্ততার একটি মাত্র মূহুর্তই ইব্রাহিমকে সন্ত্রস্ত করে তোলে।
আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে থামি। গৃহস্হালিতে ব্যবহৃত তৈজসপত্রের দোকান। উজ্জ্বল আলো - চকচকে কাঁচে, চীনে মাটির গায়ে পিছলে যায়। উজ্জ্বল আলো - এলমুনিয়ামে, পীতলে প্রতিফলিত হয়। ফুল, পাতা, ফল, লতা, প্রানী, বেলুন, বৃত্ত, শুভ জন্মদিন চতুর্দিকে ফুটে থাকে। আমি ছয়টি নকশা কাটা জাম বাটি কিনি। দোকানটি থেকে আমরা বেরিয়ে আসি। যেন পুনরায় একটি নক্ষত্র থেকে ছায়াপথে নেমে আসা।
আমরা দোতলার গ্যালারিতে এসে দাড়াই। এখান থেকে পুরো বিপনিবিতাণটি চোখে পড়ে। বৃত্তাকার দালানটি দশতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। ছাদটি একটি কাঁচের গম্বুজ। উপরে তাকালে আকাশ চোখে পড়ে। আমরা বিকেলে বাড়ি থেকে বেড়োই। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। রাতের আকাশ মেঘে অন্ধকার হয়ে আছে।
ইব্রাহিমকে জিজ্ঞেস করলাম সে বাড়ি যেতে চায় কিনা। ইব্রাহিম মাথা নেড়ে না বলে।
- আরও ঘুরবা?
- হুম।
- চল, তোমাকে উপরে নিয়ে যাই।
- না।
- তাহলে কোনদিকে যাবা?
- খেলনার দোকান।
- দোকানটার নাম কি জান?
- খেলনার দোকান।
- না, খেলাঘর। বল কি?
- নাখেলাঘর।
আমি হেসে ফেলি।' বল খেলা..ঘর..'
- খেলা ঘর!
ইব্রাহিমকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আমি চলন্ত সিঁড়িতে দাঁড়াই, নীচে নেমে আসি এবং পুনরায় খেলাঘর নামক দোকানটিতে প্রবেশ করি।
বিক্রেতাগণ আমাদের চিনতে পারে। তাদের মুখে নিরাশক্তির ছায়া পরে। সম্ভবত তারা বুঝতে পারে, আমাদের ক্রয়ক্ষমতা নেই।
ইব্রাহিম আবার চঞ্চল হয়ে ওঠে। ওর চোখ জোড়া নক্ষত্রের মত জ্বলতে থাকে। আমার হাত ছাড়িয়ে সে বিক্রেতা মেয়েটির হাত ধরে। মেয়েটিকে টেনে আরও ভেতরে নিয়ে যায়। ওখানে আরোহণ করা যায় এমন মোটরগাড়ি ও ডানাওয়ালা ঘোড়া অপেক্ষা করে। সে পুনরায় ওসবে আরোহণ করে। মেয়েটি বিব্রত বোধ করে। তার আচরণে কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ পায়। ইব্রাহিম ছুটে এসে আমার হাত ধরে। আমাকে পক্ষীরাজ ঘোড়াটি কিনে দিতে বলে। আজ টাকা আনিনি এই বাক্যটি আমি পুনরাবৃত্তি করি। সে পুনরায় কাঁচের দেয়ালের দিকে ছুটৈ যায়। কাঁচের গায়ে ওর নাক মুখ চেপে ধরে। কাঁচের ওপাশে সিংহ আর জলহস্তী বিকট হা করে আছে। আছে অভিজাত বাঘ, হরিণের দল, বানর, শূড় উঁচিয়ে থাকা হাতির পাল। পাশার বোর্ড, গুলিভরা পিস্তল, মহাকাশযান, আকাশযান, জলযান, মোটরগাড়ি ইত্যাদি। একটি রাজকন্যা ঘুরে ঘুরে নাচে...
বিক্রেতাগণ বিব্রত বোধ করে। তাদের আচরনে কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ পায়। মুঠোবন্দী ইব্রাহিমকে নিয়ে আমি খেলাঘর থেকে বেরিয়ে আসি। ছায়াপথ ধরে হাটি। ইব্রাহিমের পা দুটো পাথরের মত ভারী হয়ে ওঠে। টের পাই। ওর চোখ উজ্জ্বলতা হারায়। ছলছল করে।
আমরা বিপণিবিতাণটির শীর্ষ তলায় উঠে আসি। ছোট ছোট টেবিল ঘিরে চেয়ার পেতে বসে থাকা মানুষের জটলা। অনেক মানুষের একসাথে কথা বলার শব্দ,ধাতব কোন যন্ত্রের গুঞ্জনের মত শোনায়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাতাসে ভাজা মাংস আর সেকা রুটির সুবাস ছড়িয়ে পড়ে। ইব্রাহিমকে নিয়ে আমি কোণার দিকে একটি টেবিলে জায়গা পাই। পকেট হাতড়ে যা পাওয়া গেল তা দিয়ে ইব্রাহিমকে একটি আইসক্রিম কিনে দেই।
ইব্রাহিমের চোখে এখনও আঁধার লেগে থাকে।
- আব্বু তোমার আইসক্রিম কই?
- আমার ঠান্ডা লাগছে, আমি খাবনা।
- কফি খাও.... কফি তো তোমার পছন্দ।
- এখানে কফি পাওয়া যায় না।
মিথ্যে বলে আমি ইব্রাহিমকে নিবৃত করার চেষ্টা করি। আশপাশের অনেক টেবিলে ধোঁয়া ওঠা মগ। বাতাসে কফির সুগন্ধ ভাসে। ইব্রাহিম হয়ত ওগুলোকে কফির মগ বলে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। ওর মুখে আইসক্রিমটি গলে যেতে থাকে। চোখের ছল ছল ভাবটা কিছুতেই কাটেনা। একটি ছোট্ট মেয়ে দৌড়ে আমাদের টেবিল অতিক্রম করে। ওর জুতোয় বাঁশির শব্দে ইব্রাহিম সচকিত হয়ে ওঠে। শিশুটির মা ছুটে এসে শিশুটিকে কোলে তুলে নেয়। কপট তিরষ্কারের পর শিশুটির মুখ চুমুতে ভরিয়ে তোলে। একটি টেবিলে, দুজোড়া চোখ যুগলের, যেন অনন্তকাল ধরে একে অপরের দিকে মেলে আছে। একটি টেবিলে একটি পরিবারের নানান বয়সী সদস্যরা আড্ডা আর খাবারে মগ্ন হয়ে থাকে। একটি টেবিলে একদল নারী-পুরুষ পরিপাটি আড্ডায় মেতে আছে। জীবন এখানে তুমুল ভাবে ফুটে থাকে।
হাতের মুঠোয় ইব্রাহিমের ছোট্ট হাতটি নিয়ে আমি হাঁটতে থাকি। ওর পা জোড়া যেন পাথরের মত ভারী হয়ে আছে। ওকে প্রায় টেনে নিয়ে আমি লিফটের সামনে দাঁড়াই। এক সময় লিফটের কপাট সয়ংক্রিয়ভাবে দুদিকে সরে যায়। আমরা ভেতরে প্রবেশ করি। আরও বহুমানুষ প্রবেশ করে। লিফটের বদ্ধ কামরাটি পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সুগন্ধি মাখা মানুষের ঘ্রাণে কামরাটি ভরে ওঠে। একসময় আমরা নীচে নেমে আসি। ইব্রাহিম বুঝতে পারে আমরা পুনরায় খেলাঘরের দিকে যাচ্ছি। তার পা জোড়া জড়তা কাটিয়ে দ্রুত সামনে এগোয়।
দোকানটিতে বেশ ভীড় লেগে আছে। একজন বিক্রেতার সাথে আমার চোখাচোখি হলে সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তাদের আচরণ শীতল হয়ে ওঠে। আমি টের পাই। একটি প্রদর্শনীতে সাজানো লাল একটি গাড়ি আমি এক বিক্রেতাকে দেখাতে বলি। ছেলেটি তাচ্ছিল্যের সাথে খেলনাটি আমার দিকে এগিয়ে দেয়। নেড়েচেড়ে দেখে আমি কাউন্টারের দিকে অগ্রসর হই। কাউন্টারের সামনে বেশ ভীড়। একপর্যায়ে আমি ক্যাশ কাউন্টারে থাকা ছেলেটির মুখোমুখি হই।
প্রাইসট্যাগের মূল্য ছেলেটি কিছুটা তাচ্ছিল্যের সাথে মনে করিয়ে দেয়। নীরবতায় কয়েক মুহুর্ত কাটে। আমার পেছনের ক্রেতাটি অস্হির হয়ে উঠতে থাকে। আমি সরে গিয়ে মেয়েটিকে জায়গা করে দেই। একটি খয়েরী পশমের টেডি, নীল জামা পরা বারবি আর ডানাযুক্ত একটি বোরাক মেয়েটি কাউন্টারে এগিয়ে দেয়। কাউন্টারের ছেলেটি তিনটি খেলনার দাম হিসেব করে জানালে, মেয়েটি কিছুক্ষণ ভাবে। বোরাকটি পাশে সরিয়ে রেখে সে বিল করতে বলে।
ছেলেটি বিল করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মেয়েটি আগ্রহ নিয়ে কাউন্টারে ঝুঁকে থাকে। অন্যান্য বিক্রেতাগণ ক্রেতাদের নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করে। থমকে থাকা মুহুর্তটিতে ইব্রাহিমের স্বপ্ন বোরাকের ক্ষুদে সংস্করণটি সাবধানে আমি পকেটে ঢুকিয়ে ফেলি। কয়েকটি নিস্তব্ধ মুহুর্ত কাটে। আমি নিশ্চিত হই ঘটনাটি সবাই সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইতিমধ্যে ফাঁকা হয়ে যাওয়া ক্যাশ কাউন্টারে আমার ডাক পড়ে। আমি লাল গাড়িটি নড়াচড়া করি।
- এটার দরজা খোলা যায় না?
- না। ওপেন করা যায় এমন আছে.... দাম আরও বেশি পড়বে।
- না, থাক....
আমি ইব্রাহিমকে হাতের মুঠোয় নিয়ে খেলাঘর থেকে বেরিয়ে আসি।
ছায়াপথ ধরে কিছুদূর হটার পর, পকেট থেকে পক্ষীরাজ ঘোড়াটি বের করে আমি ইব্রাহিমকে দেই। ওর চোখে আলো ঝিকমিক করে জ্বলে ওঠে।
- আব্বু তুমি এইটা কিনছ..... এতক্ষণ কেন দেও নাই।
- দেখলাম তুমি কি কর..
আমরা সিদ্ধান্ত নেই আজকের মত এখানেই আমাদের ভ্রমণ শেষ করার। বিপনিবিতাণটির বাহির নির্দেশিত পথ ধরে আমরা এগিয়ে যাই। যখন আমরা দরজাটি পেরিয়ে যাব, ঠিক সেই মুহুর্তে একজন নিরাপত্তাকর্মী আমাদের পথ আগলে দাড়ায়।
- আপনাদের ডাকে।
আমি পেছন ফিরে খেলাঘরের কয়েকজন বিক্রেতাকে ছুটে আসতে দেখি এবং ঐ মুহুর্তে ইব্রাহিমের হাতে থাকা পক্ষীরাজ ঘোড়াটি নিজের হাতে নিয়ে নেই।
একজন আমার হাত থেকে বোরাকটি কেড়ে নেয়, কয়েকজনের কন্ঠে অশ্রাব্য গালিবর্ষন, আমার গালে একটি থাপ্পড় এসে লাগে, মুখের ভেতর নোনা রক্তের স্বাদ পাওয়া যায়, একজন ধাক্কা দিলে আমি মেঝেতে গড়িয়ে পড়ি।
এই পর্যায়ে আমি একজন দেবদূতের কন্ঠস্বর শুনি। তিনি বলেন আমাদের শিক্ষিত মনে হয়। ভদ্রলোকের মত দেখায়। শিশুটির সামনে আর অপমান করার প্রয়োজন নেই। যেহেতু চুরির মাল ফেরত পাওয়া গেছে। সম্মিলিত সিদ্ধান্তে আমার একটি ছবি তোলা হয়। ইব্রাহিমের একটি ছবি তোলা হয়। আমাকে জানিয়ে দেয়া হয় এই ছবি সকল নিরাপত্তারক্ষীকে দেয়া হবে। আমাদের যদি কখনো এই বিপণিবিতাণে দেখা যায়, আমাদের পুলিশে সোপর্দ করা হবে।
হাতের মুঠোয় ইব্রাহিমকে নিয়ে আমি আবার হাঁটতে থাকি। রাতের অন্ধকারে ভাসতে থাকা নক্ষত্রমন্ডলীর মত উঁচু দালানটি থেকে বেরিয়ে আসি। ছায়াপথ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাই।
'নীল রং' আকাশ আর সমুদ্রের, এভাবে ভালো থাকতে বলতে পারে। সবুজ উপত্যকা, পর্বত চূড়ার বরফ এভাবে ভালো থাকতে বলে। মেঘনা নদী, যার পাড়ে দাঁড়ালে ওপাড়ে শুধু পানিতে নুয়ে পড়া আকাশ দেখা যায়, এভাবে ভালো থাকতে বলে। দ্বীপ গুলোর, নদী কি সমুদ্রের, ক্ষমতা আছে মানুষকে শুভ কামনা জানানোর। এরকম ক্ষমতা আছে আরও বহু কিছুর।
আজকের কালবৈশাখী, সুন্দর জীবনকে মনে করিয়ে দিল।
এক সময় ভারী বৃষ্টি হালকা হয়ে ঝিরঝির করে ঝরতে থাকে। এরপর বৃষ্টি থেমে যায়। আমি আবার ইব্রাহিমের ছোট্ট হাতটি মুঠোবন্দি করে রাস্তায় হাঁটতে থাকি। একটি বিপণিবিতাণ পিতা-পুত্রের গন্তব্য।
স্যান্ডেলের ফাঁক গলে বরফ গলা ঠান্ডা পানির গোড়ালিতে শীতল স্পর্শ। আমার নাকে মুখে ভেজা বাতাসের প্রশান্তি। রাস্তার পীচ উঠে গিয়ে তৈরি হওয়া গর্তে বৃষ্টির পানি জমে থাকে। ঘন সুপারি বাগানের মাঝে লুকিয়ে থাকা একটি ডোবার কথা আমার মনে পড়ে যায়। জমে থাকা বৃষ্টিতে ইব্রাহিম তার প্রতিচ্ছবি দেখে খুশি হয়ে ওঠে। আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে ঐ পানিতে নেমে লাফাতে থাকে। আমি জোর করে আবার তাকে মুঠোবন্দি করে হাঁটতে লাগলাম।
একসময় আমরা বড় রাস্তার ফুটপাতে উঠে আসি। রাস্তার দুই দিকে আলো ঝলমলে কাঁচের দোকানঘর। তারা জ্বলা আকাশের মত। মনে হয় যেন ছায়াপথ ধরে হাঁটছি। রাস্তায় মোটরগাড়ির ভীর। ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে হর্ণ বেজে ওঠে। ক্রিং ক্রিং শব্দে রিকশা বাজে। দোকানের সাইনবোর্ড গুলো জোনাকির মতো জ্বলে-নেভে। বাতাসে ভাজা মাংসের ঘ্রাণ। বিষ্মিত ইব্রাহিম জোরে জোরে হাঁটে। সবচেয়ে উজ্জ্বল দুটি তারার মত, তার চোখ খুশিতে জ্বল জ্বল করে।
জীব জন্তুর বেলুন, বাঁশি আর হাওয়াই মিঠাইয়ের ভ্রাম্যমাণ হকাররা ইব্রাহিমকে চুম্বকের মত টানে। সে আমাকেও তাদের কাছে টেনে আনে। একটি হাওয়াই মিঠাই কিনে দিলে সে কিছুটা শান্ত হয়।
হাতের মুঠোয় ইব্রাহিমকে নিয়ে আমি বড় রাস্তাটি সাবধানে অতিক্রম করি। আমাদের গন্তব্য, বিপণিবিতাণটিতে এসে পৌঁছাই। প্রবেশ করি আলোর সমুদ্রে।
আমার হাতের মুঠোয় ইব্রাহিমের উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বিস্মিত চোখে সে চতুর্দিকে দেখে।
মোবাইল ফোনের দোকানে একই রকম টি-শার্ট গায়ে কিছু ঝলমলে তরুণী সেট গুলোকে ক্রেতার কাছে উপস্থাপন করে। তাদের ঠোঁটে চাঁদের মত হাসি লেগে থাকে। গয়নার দোকানগুলো উজ্জ্বল শিল্পের মত জ্বলে। শাড়ি আর ওড়না গুলো ক্যানভাসের মত। কোনটিতে ইশ্বর তার প্রকৃতির প্রতিলিপি এঁকেছেন, কোনটিতে শিল্পী তার কল্পনা। শার্ট, প্যান্ট, সেলোয়ার, কামিজ গায়ে মানুষের ডামি সত্যিকার মানুষের কল্পনার খোরাক যোগায়। সহস্র পণ্যের অজস্র বর্ণে, নকশায়, আলোয় এক নতুন পৃথিবী তৈরি হয়। ইব্রাহিম তার বিমুগ্ধ দর্শক।
ইব্রাহিমের ছোট ছোট পদক্ষেপ হঠাৎ থেমে যায়। হাতের মুঠোয় টের পাই। সে একটি খেলনার দোকানের দিকে তাকিয়ে আছে। খেলাঘর লেখা সাইনবোর্ডটি জ্বলছে। আব্বু ওই দোকানে যাব, বলে সে খেলাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। আমরা দরজার সামনে দাঁড়ানো মাত্র, কাঁচের দুটি কপাট সয়ংক্রিয়ভাবে দুদিকে সরে যায়। ইব্রাহিম এক আশ্চর্য জগতে প্রবেশ করে।
ইব্রাহিমের অবাক চোখে তখন নক্ষত্রের দীপ্তি। কাঁচের দেয়ালের আড়ালে এক পুরো সেনাবাহিনী। রাজা, রানী, সেনাপতি। বিকট হা করে থাকা সিংহ। ভালুক ঢোল বাজায়। রেলগাড়ি এখনই ছেড়ে যাবে বোধহয়। ছক কাটা দালান কোঠা। এরোপ্লেন যেন এখনই উড়াল দেবে পাখির মত। হরিণের দলের পাশে অভিজাত বাঘ। মোটরগাড়ি যার দরজা খোলে। হাসপাতাল, এম্বুলেন্স, দমকল বাহিনী। নৃত্যরত রাজকন্যা। আরও অসংখ্য খেলনা। ইব্রাহিম এখনও চেনে না এমন। সে কাঁচের দেয়ালে নাক ঘষে, চোখ জোড়া চেপে ধরে। বিক্রেতাগণ ইব্রাহিমের খুশি দেখে আনন্দিত হয়। একটি বিক্রেতা মেয়ে তার হাত ধরে আরও খেলনা দেখাতে নিয়ে যায়। আরবী ঘোড়া, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, মোটরগাড়ি। ইব্রাহিম ওসবে আরোহণ করে। মেয়েটি তাকে ওগুলো চালাতে সাহায্য করে। ইব্রাহিমের আরবী ঘোড়াটি পছন্দ হয়। আব্বু এটা কিনা দিবা? বলে সে আমার দিকে তাকায়। বিক্রেতা মেয়েটির কাছ থেকে ঘোড়াটির মূল্য আট হাজার টাকা জানা যায়। আমি ইব্রাহিমকে জানাই টাকা নিয়ে আসা হয়নি। পরে কিনে দেব। ওকে মুঠোয় নিয়ে আমি খেলাঘর থেকে বেরিয়ে আসি। চোখের কোণে বিক্রেতাগণের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি দেখি। ইব্রাহিমের হাঁটার গতি ক্রমশ কমে আসে।
হাতের মুঠোয় ইব্রাহিমকে নিয়ে আমি দ্রুত আমার গন্তব্যে যেতে থাকি। একটি চলন্ত সিঁড়িতে আমরা আরোহণ করি। সিঁড়িটি আমাদের আরেক তলায় পৌঁছে দেয়। অভিজ্ঞতাটি ইব্রাহিমের কাছে অভিনব। তাকে অভিভূত, আনন্দিত করে। আলোর বন্যায় আমরা হাঁটি। একটি তরুণী, তাজা রজনীগন্ধার মত, আমাদের পেরিয়ে যায়। নাকে অনেকক্ষণ তার সৌরভ লেগে থাকে। একজোড়া তরুণ-তরুণী হাত ধরে হাঁটে। একটি লোক, দুহাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে হনহন করে চলে। তার পেছনে তার স্ত্রী এখনও কেনা হয়নি সেসব পন্য কাঁচের দেয়ালের ওপাড়ে খোঁজে। পুতুলের মত একটি মেয়ে আইসক্রিম হাতে বাবার পাঞ্জাবির ঝুল ধরে হাঁটে। এসব ব্যাস্ততার একটি মাত্র মূহুর্তই ইব্রাহিমকে সন্ত্রস্ত করে তোলে।
আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে থামি। গৃহস্হালিতে ব্যবহৃত তৈজসপত্রের দোকান। উজ্জ্বল আলো - চকচকে কাঁচে, চীনে মাটির গায়ে পিছলে যায়। উজ্জ্বল আলো - এলমুনিয়ামে, পীতলে প্রতিফলিত হয়। ফুল, পাতা, ফল, লতা, প্রানী, বেলুন, বৃত্ত, শুভ জন্মদিন চতুর্দিকে ফুটে থাকে। আমি ছয়টি নকশা কাটা জাম বাটি কিনি। দোকানটি থেকে আমরা বেরিয়ে আসি। যেন পুনরায় একটি নক্ষত্র থেকে ছায়াপথে নেমে আসা।
আমরা দোতলার গ্যালারিতে এসে দাড়াই। এখান থেকে পুরো বিপনিবিতাণটি চোখে পড়ে। বৃত্তাকার দালানটি দশতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। ছাদটি একটি কাঁচের গম্বুজ। উপরে তাকালে আকাশ চোখে পড়ে। আমরা বিকেলে বাড়ি থেকে বেড়োই। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। রাতের আকাশ মেঘে অন্ধকার হয়ে আছে।
ইব্রাহিমকে জিজ্ঞেস করলাম সে বাড়ি যেতে চায় কিনা। ইব্রাহিম মাথা নেড়ে না বলে।
- আরও ঘুরবা?
- হুম।
- চল, তোমাকে উপরে নিয়ে যাই।
- না।
- তাহলে কোনদিকে যাবা?
- খেলনার দোকান।
- দোকানটার নাম কি জান?
- খেলনার দোকান।
- না, খেলাঘর। বল কি?
- নাখেলাঘর।
আমি হেসে ফেলি।' বল খেলা..ঘর..'
- খেলা ঘর!
ইব্রাহিমকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আমি চলন্ত সিঁড়িতে দাঁড়াই, নীচে নেমে আসি এবং পুনরায় খেলাঘর নামক দোকানটিতে প্রবেশ করি।
বিক্রেতাগণ আমাদের চিনতে পারে। তাদের মুখে নিরাশক্তির ছায়া পরে। সম্ভবত তারা বুঝতে পারে, আমাদের ক্রয়ক্ষমতা নেই।
ইব্রাহিম আবার চঞ্চল হয়ে ওঠে। ওর চোখ জোড়া নক্ষত্রের মত জ্বলতে থাকে। আমার হাত ছাড়িয়ে সে বিক্রেতা মেয়েটির হাত ধরে। মেয়েটিকে টেনে আরও ভেতরে নিয়ে যায়। ওখানে আরোহণ করা যায় এমন মোটরগাড়ি ও ডানাওয়ালা ঘোড়া অপেক্ষা করে। সে পুনরায় ওসবে আরোহণ করে। মেয়েটি বিব্রত বোধ করে। তার আচরণে কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ পায়। ইব্রাহিম ছুটে এসে আমার হাত ধরে। আমাকে পক্ষীরাজ ঘোড়াটি কিনে দিতে বলে। আজ টাকা আনিনি এই বাক্যটি আমি পুনরাবৃত্তি করি। সে পুনরায় কাঁচের দেয়ালের দিকে ছুটৈ যায়। কাঁচের গায়ে ওর নাক মুখ চেপে ধরে। কাঁচের ওপাশে সিংহ আর জলহস্তী বিকট হা করে আছে। আছে অভিজাত বাঘ, হরিণের দল, বানর, শূড় উঁচিয়ে থাকা হাতির পাল। পাশার বোর্ড, গুলিভরা পিস্তল, মহাকাশযান, আকাশযান, জলযান, মোটরগাড়ি ইত্যাদি। একটি রাজকন্যা ঘুরে ঘুরে নাচে...
বিক্রেতাগণ বিব্রত বোধ করে। তাদের আচরনে কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ পায়। মুঠোবন্দী ইব্রাহিমকে নিয়ে আমি খেলাঘর থেকে বেরিয়ে আসি। ছায়াপথ ধরে হাটি। ইব্রাহিমের পা দুটো পাথরের মত ভারী হয়ে ওঠে। টের পাই। ওর চোখ উজ্জ্বলতা হারায়। ছলছল করে।
আমরা বিপণিবিতাণটির শীর্ষ তলায় উঠে আসি। ছোট ছোট টেবিল ঘিরে চেয়ার পেতে বসে থাকা মানুষের জটলা। অনেক মানুষের একসাথে কথা বলার শব্দ,ধাতব কোন যন্ত্রের গুঞ্জনের মত শোনায়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাতাসে ভাজা মাংস আর সেকা রুটির সুবাস ছড়িয়ে পড়ে। ইব্রাহিমকে নিয়ে আমি কোণার দিকে একটি টেবিলে জায়গা পাই। পকেট হাতড়ে যা পাওয়া গেল তা দিয়ে ইব্রাহিমকে একটি আইসক্রিম কিনে দেই।
ইব্রাহিমের চোখে এখনও আঁধার লেগে থাকে।
- আব্বু তোমার আইসক্রিম কই?
- আমার ঠান্ডা লাগছে, আমি খাবনা।
- কফি খাও.... কফি তো তোমার পছন্দ।
- এখানে কফি পাওয়া যায় না।
মিথ্যে বলে আমি ইব্রাহিমকে নিবৃত করার চেষ্টা করি। আশপাশের অনেক টেবিলে ধোঁয়া ওঠা মগ। বাতাসে কফির সুগন্ধ ভাসে। ইব্রাহিম হয়ত ওগুলোকে কফির মগ বলে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। ওর মুখে আইসক্রিমটি গলে যেতে থাকে। চোখের ছল ছল ভাবটা কিছুতেই কাটেনা। একটি ছোট্ট মেয়ে দৌড়ে আমাদের টেবিল অতিক্রম করে। ওর জুতোয় বাঁশির শব্দে ইব্রাহিম সচকিত হয়ে ওঠে। শিশুটির মা ছুটে এসে শিশুটিকে কোলে তুলে নেয়। কপট তিরষ্কারের পর শিশুটির মুখ চুমুতে ভরিয়ে তোলে। একটি টেবিলে, দুজোড়া চোখ যুগলের, যেন অনন্তকাল ধরে একে অপরের দিকে মেলে আছে। একটি টেবিলে একটি পরিবারের নানান বয়সী সদস্যরা আড্ডা আর খাবারে মগ্ন হয়ে থাকে। একটি টেবিলে একদল নারী-পুরুষ পরিপাটি আড্ডায় মেতে আছে। জীবন এখানে তুমুল ভাবে ফুটে থাকে।
হাতের মুঠোয় ইব্রাহিমের ছোট্ট হাতটি নিয়ে আমি হাঁটতে থাকি। ওর পা জোড়া যেন পাথরের মত ভারী হয়ে আছে। ওকে প্রায় টেনে নিয়ে আমি লিফটের সামনে দাঁড়াই। এক সময় লিফটের কপাট সয়ংক্রিয়ভাবে দুদিকে সরে যায়। আমরা ভেতরে প্রবেশ করি। আরও বহুমানুষ প্রবেশ করে। লিফটের বদ্ধ কামরাটি পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সুগন্ধি মাখা মানুষের ঘ্রাণে কামরাটি ভরে ওঠে। একসময় আমরা নীচে নেমে আসি। ইব্রাহিম বুঝতে পারে আমরা পুনরায় খেলাঘরের দিকে যাচ্ছি। তার পা জোড়া জড়তা কাটিয়ে দ্রুত সামনে এগোয়।
দোকানটিতে বেশ ভীড় লেগে আছে। একজন বিক্রেতার সাথে আমার চোখাচোখি হলে সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তাদের আচরণ শীতল হয়ে ওঠে। আমি টের পাই। একটি প্রদর্শনীতে সাজানো লাল একটি গাড়ি আমি এক বিক্রেতাকে দেখাতে বলি। ছেলেটি তাচ্ছিল্যের সাথে খেলনাটি আমার দিকে এগিয়ে দেয়। নেড়েচেড়ে দেখে আমি কাউন্টারের দিকে অগ্রসর হই। কাউন্টারের সামনে বেশ ভীড়। একপর্যায়ে আমি ক্যাশ কাউন্টারে থাকা ছেলেটির মুখোমুখি হই।
প্রাইসট্যাগের মূল্য ছেলেটি কিছুটা তাচ্ছিল্যের সাথে মনে করিয়ে দেয়। নীরবতায় কয়েক মুহুর্ত কাটে। আমার পেছনের ক্রেতাটি অস্হির হয়ে উঠতে থাকে। আমি সরে গিয়ে মেয়েটিকে জায়গা করে দেই। একটি খয়েরী পশমের টেডি, নীল জামা পরা বারবি আর ডানাযুক্ত একটি বোরাক মেয়েটি কাউন্টারে এগিয়ে দেয়। কাউন্টারের ছেলেটি তিনটি খেলনার দাম হিসেব করে জানালে, মেয়েটি কিছুক্ষণ ভাবে। বোরাকটি পাশে সরিয়ে রেখে সে বিল করতে বলে।
ছেলেটি বিল করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মেয়েটি আগ্রহ নিয়ে কাউন্টারে ঝুঁকে থাকে। অন্যান্য বিক্রেতাগণ ক্রেতাদের নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করে। থমকে থাকা মুহুর্তটিতে ইব্রাহিমের স্বপ্ন বোরাকের ক্ষুদে সংস্করণটি সাবধানে আমি পকেটে ঢুকিয়ে ফেলি। কয়েকটি নিস্তব্ধ মুহুর্ত কাটে। আমি নিশ্চিত হই ঘটনাটি সবাই সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইতিমধ্যে ফাঁকা হয়ে যাওয়া ক্যাশ কাউন্টারে আমার ডাক পড়ে। আমি লাল গাড়িটি নড়াচড়া করি।
- এটার দরজা খোলা যায় না?
- না। ওপেন করা যায় এমন আছে.... দাম আরও বেশি পড়বে।
- না, থাক....
আমি ইব্রাহিমকে হাতের মুঠোয় নিয়ে খেলাঘর থেকে বেরিয়ে আসি।
ছায়াপথ ধরে কিছুদূর হটার পর, পকেট থেকে পক্ষীরাজ ঘোড়াটি বের করে আমি ইব্রাহিমকে দেই। ওর চোখে আলো ঝিকমিক করে জ্বলে ওঠে।
- আব্বু তুমি এইটা কিনছ..... এতক্ষণ কেন দেও নাই।
- দেখলাম তুমি কি কর..
আমরা সিদ্ধান্ত নেই আজকের মত এখানেই আমাদের ভ্রমণ শেষ করার। বিপনিবিতাণটির বাহির নির্দেশিত পথ ধরে আমরা এগিয়ে যাই। যখন আমরা দরজাটি পেরিয়ে যাব, ঠিক সেই মুহুর্তে একজন নিরাপত্তাকর্মী আমাদের পথ আগলে দাড়ায়।
- আপনাদের ডাকে।
আমি পেছন ফিরে খেলাঘরের কয়েকজন বিক্রেতাকে ছুটে আসতে দেখি এবং ঐ মুহুর্তে ইব্রাহিমের হাতে থাকা পক্ষীরাজ ঘোড়াটি নিজের হাতে নিয়ে নেই।
একজন আমার হাত থেকে বোরাকটি কেড়ে নেয়, কয়েকজনের কন্ঠে অশ্রাব্য গালিবর্ষন, আমার গালে একটি থাপ্পড় এসে লাগে, মুখের ভেতর নোনা রক্তের স্বাদ পাওয়া যায়, একজন ধাক্কা দিলে আমি মেঝেতে গড়িয়ে পড়ি।
এই পর্যায়ে আমি একজন দেবদূতের কন্ঠস্বর শুনি। তিনি বলেন আমাদের শিক্ষিত মনে হয়। ভদ্রলোকের মত দেখায়। শিশুটির সামনে আর অপমান করার প্রয়োজন নেই। যেহেতু চুরির মাল ফেরত পাওয়া গেছে। সম্মিলিত সিদ্ধান্তে আমার একটি ছবি তোলা হয়। ইব্রাহিমের একটি ছবি তোলা হয়। আমাকে জানিয়ে দেয়া হয় এই ছবি সকল নিরাপত্তারক্ষীকে দেয়া হবে। আমাদের যদি কখনো এই বিপণিবিতাণে দেখা যায়, আমাদের পুলিশে সোপর্দ করা হবে।
হাতের মুঠোয় ইব্রাহিমকে নিয়ে আমি আবার হাঁটতে থাকি। রাতের অন্ধকারে ভাসতে থাকা নক্ষত্রমন্ডলীর মত উঁচু দালানটি থেকে বেরিয়ে আসি। ছায়াপথ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাই।