প্রথম পর্ব...
বেশ কিছুদিন হলো মকবুল চৌধুরীকে পাড়ার ঘটক খুব বিরক্ত করছে। কারণ, তার ঘরে একাদশ শ্রেণির প্রথম বর্ষে পড়ুয়া একটি মেয়ে আছে।
মকবুল চৌধুরী বাজারে চালের ব্যবসা করেন। নির্ভেজাল, সৎ মানুষ। তার পরিবারে আছেন স্ত্রী রাবেয়া চৌধুরী, একমাত্র মেয়ে তানিশা চৌধুরী এবং ছোট ছেলে সৈকত চৌধুরী।
মেয়ে কলেজে পড়ে, একাদশ শ্রেণির প্রথম বর্ষে। আর ছেলে এ বছর অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে।
ঘটক জানিয়েছে, একটি ভালো পরিবারের ছেলে আছে—ডিগ্রি পাস করা, বাবার সঙ্গে মাছের আরৎ-এর বড় ব্যবসা সামলায়। তারা শিক্ষিতা ও সুন্দরী মেয়ে চায়। পাশের গ্রামেই তাদের বাড়ি। আপাতত তারা শুধু আংটি বদল করতে চায়।
কিন্তু মকবুল চৌধুরী কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। তার ইচ্ছে, মেয়ে যেন অনার্স পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করে তবেই বিয়ে নিয়ে ভাবা যায়।
ঘটক নাছোড়বান্দা। বারবার এসে অনুরোধ করে যাচ্ছে। অতিষ্ঠ হয়ে মকবুল চৌধুরী একদিন বলেন,
“আমার মেয়ে যদি রাজি হয়, তাহলে ভাবা যেতে পারে। পাত্রপক্ষের সামনে আসতে চাইলে তবেই সিদ্ধান্ত।”
সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তিনি স্ত্রী রাবেয়া চৌধুরীকে সব কিছু খুলে বলেন। রাবেয়া রীতিমতো অবাক।
“মেয়ে তো এখনো কলেজেই! এখনি এসব আলোচনা কেন? তাছাড়া, আমাদের তো কিছুর অভাব নেই... এত অল্প বয়সে বিয়ে দিতে হবে কেন?”
তবুও মকবুল চৌধুরী বোঝাতে থাকেন,
“শুধু আংটি বদল করে রাখবে। পড়াশোনায় কোনো বাধা দেবে না। ছেলেও শিক্ষিত।”
তাদের বাড়ি একতলা। দক্ষিণে বারান্দা ঘেঁষে দুটি ঘর। একটিতে তানিশা, আরেকটিতে সৈকত থাকে। ভেতরের ঘরে মকবুল ও রাবেয়া থাকেন।
বাড়ির পাশ দিয়েই সরু পথ চলে গেছে—গ্রামের বাড়ির মতোই।
সেই রাতে রাবেয়া চৌধুরী মেয়ের ঘরে আসেন।
তানিশা তখন আয়নার সামনে বসে চুলে বিনুনি করছে।
“তোকে একটা কথা বলার ছিল মা,” বললেন মা।
“কি বলবে, তাড়াতাড়ি বলো মা। কাল সকালে একটা জরুরি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে।”
রাবেয়া ধীরে বলেন,
“তোর বাবা বলছিলেন, আমাদের বাসায় মেহমান আসতে চায়।”
“মেহমান আসুক, আমাকে বলছো কেন?”
রাবেয়া এবার একটু দ্বিধা নিয়ে বলেন,
“তোকে বরপক্ষ দেখতে আসতে চায়।”
তানিশা থমকে যায়। যেন মাথায় বজ্রাঘাত!
“মা, বলছো কি! এখনো তো কলেজই শেষ করিনি, আর এখনই বিয়ে?”
“না মা, এসব ভেবো না। ওরা শুধু দেখে যাবে। পছন্দ হলে আংটি বদল হবে। তুই তো পড়াশোনা চালিয়ে যাবি। বিয়ের কথাই এখন হচ্ছে না।”
তানিশা কিছুতেই রাজি হয় না। সাফ জানিয়ে দেয় — এখন এসব সম্ভব নয়।
পরদিন মকবুল চৌধুরী ঘটককে জানিয়ে দেন — তার মেয়ে রাজি না, সুতরাং তিনি-ও আগ্রহী নন। ঘটক মর্মাহত হয়ে পাত্রপক্ষকে না করে দেন।
পরদিনের মতোই তানিশা কলেজে যায়, সৈকত স্কুলে।
তানিশা প্রতিদিন দুপুর আড়াইটার দিকে ফিরে, সৈকত একটু আগে—দুটোয়।
বেশ কিছুদিন এভাবেই কেটে যায়।
একদিন বৃহস্পতিবার, কলেজ থেকে ফিরে তানিশা ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় ফুলগাছ দেখতে যায়। হঠাৎ চোখে পড়ে আধফোটা একটি গোলাপ আর ছোট্ট একটি চিরকুট।
চিরকুটে লেখা:
" এই নাম না জানা মেয়ে আপনি কেমন আছেন..? "
তানিশা অবাক! কে রেখে যেতে পারে এসব? হাতের লেখা পরিচিত নয়। সন্দেহ করতেও পারছে না কাউকে।
চিরকুট আর গোলাপ ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রেখে খেতে চলে যায়।
পরের বৃহস্পতিবার, ঠিক একইভাবে আবার একটানা গোলাপ আর নতুন চিরকুট: কি হলো বললেন না তো আপনি কেমন আছেন..?
এবার একটু চিন্তায় পড়ে যায় তানিশা।
মা তো সারাদিন বাসাতেই থাকেন, তাহলে কে এসে রেখে যায়?
এভাবে প্রত্যেক বৃহস্পতিবার নিয়ম করে একটি গোলাপ আর একটি চিরকুট আসে।
প্রতিটি চিরকুটে ভিন্ন ভিন্ন লেখা। কিন্তু একই হাতের লেখা।
এখন তানিশা আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষা করে প্রতি বৃহস্পতিবারের। তার ড্রয়ারে জমেছে একুশ টি গোলাপ আর চিরকুট..
আজ বৃহস্পতিবার।
মকবুল চৌধুরী আজ একটু আগেই বাড়ি ফিরেছেন।
বড় রাস্তার মোড়ে একটি দুর্ঘটনা ঘটে—একটি ছেলে বাইকসহ বাসের নিচে চাপা পড়ে। হাত-পা ভেঙে গেছে।
মকবুলসহ অন্যরা ছেলেটিকে হাসপাতালে পাঠান।
তানিশা ফেরার সময় রাস্তায় কাঁচ ভাঙা আর ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখে।
কিন্তু একটি বিষয় তার চোখে পড়ে না—বাসের চাকায় পিষে যাওয়া একটি রক্ত মাখা গোলাপ...
তানিশা কিন্তু কিছুই জানে না। বরং সে বাড়ি ফিরছে প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে।
আজও যে বারান্দায় "নাম না জানা কেউ " তার জন্য গোলাপ আর চিরকুট রেখে গেছে কিনা... সেই অপেক্ষায়।