Posts

নন ফিকশন

জীবনে যেদিন প্রথমবার বড় কিছু হারালাম

July 26, 2025

Mst. Gardenia

78
View

কখনো কখনো মানুষের জীবনে , তার চোখের সামনে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায় যেগুলো সে শুধু চুপচাপ দেখে যেতে পারে  । চাইলেও পারেনা আটকাতে । আমার জীবনে প্রথম যখন এরকম কিছু ঘটে তখন আমার বয়স ছিল নয় বছর । 
আমার বয়স যখন দুই বছর তখন আমার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায় । আমি আমার মায়ের সাথে নানা বাড়িতে থাকতে শুরু করি । বাড়িটা ছিল অনেক বড় । বাড়ি থেকে প্রায় দশ মিনিট পশ্চিমে হাটার পর একটা ব্রীজ ছিল । ব্রীজের নিচটা শুকনো ছিল । আমার মনে পড়ে যখন অনেক ছোট ছিলাম , স্কুল যাওয়া ও শুরু করিনি তখন সেই ব্রীজের নিচে দৌড়াদৌড়ি করে খেলতাম আমরা সমবয়সী পাড়ার ছেলেমেয়েরা । আর ব্রীজের ওপরে আমাদের মায়েরা বসে গল্প করতো । 
সেই ব্রীজ থেকে আরও পশ্চিমে হেঁটে গেলে অনেক বড় যায়গা ( শিশু বয়সে যেমনটি দেখতাম আর বুঝতাম সেভাবে বলছি ) । সেখানে বাদাম বুনতো অনেকেই । যত দূর অবধি চোখ যেত শুধু বাদামের ক্ষেত আরও হয়তো শস্য ছিল কিন্তু আমার শুধু বাদামের কথাই মনে আছে কারণ আমরা মাঝে মধ্যেই সেখানে বসে বাদাম খেতাম । কাচা বাদাম  । মা আর আন্টিরা বসে আড্ডা দিত আর আমরা ছোটরা ছুটাছুটি করতাম তাদের আশেপাশেই। তো সেই জায়গা পেরিয়ে ছিল পদ্মা নদী । আমার ঠিক মনে নেই কতটা দূরে । শুধু মনে আছে অনেক দূরে । নদীর কাছেও মাঝে মধ্যে যেতাম । যখন জাহাজ যেত তখন আনন্দে লাফালাফি করতাম । 
যখন আমার বয়স চার বছর বা তার কাছাকাছি তখন একদিন রাতে সবাই ব্রীজ দেখতে গেল । আমি ছিলাম কোলে । সেখানে গিয়ে যা দেখলাম , ব্রীজের নিচে প্রচন্ড স্রোতে পানি বইছে । আর যতদুর দেখা যাছে শুধু পানি আর পানি । ঢেউসহ পানির উপরে মনে হচ্ছিলো জালের মতো আস্তরণ। ফুলে ফেপে ওঠা নদীর ঢেউ দেখেছিলাম জীবনে প্রথমবারের মতো । ভয় করেনি , কৌতুহলের দৃষ্টিতে সব দেখেছিলাম । সেদিনের পর থেকে আর সেই বাদামের জমি দেখা যায়নি । আমার ভালো লাগতো না । আমি মাকে জিজ্ঞেস করতাম , পানি কবে শুকাবে । মা বলত এই তো শীতকালে শুকাবে , এই তো অমুক ঋতুতে , অমুক সময়ে । আমিও সেটাই বিশ্বাস করতাম । আমার মনে আছে আমি একবার শহরে গিয়েছিলাম এক বোনের বিয়েতে । সেখানে প্রায় আট দিন ছিলাম । কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো অনেক দিন থেকেছি । তাই বাড়ি ফেরার পর মনে হলো এতদিনে হয়তো পানি চলে গিয়েছে । দৌড়ে গিয়েছিলাম সেদিন দেখতে , কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরে এসেছি ।
এভাবে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম পানি আর কোনো দিন ও শুকাবে না , নদী কাছে চলে এসেছে । আর পরে জানতে পেরেছিলাম সেই যে বাদাম ক্ষেতসহ অনেক বড় জায়গা সেটা পুরোটাই ছিল একটা বিশাল আকারের চর ।সেটা সেই নব্বই দশকে জেগেছে আর এতগুলো বছরেও ডোবেনি । মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল এটা আর কোনোদিন ও ডুববে না । আর তাইতো তারা সেখানে চাষাবাদ , এমনকি কেউ কেউ ঘরবাড়ি বানিয়ে থাকতেও শুরু করেছিল । 
এভাবে বছর তিনেক কেটে গেল । সবকিছু আবার ঠিকঠাক চলছে । কিন্তু একদিন রাতে মানুষদের চোখের সামনে সেই ব্রীজটা স্রোতের সাথে লড়তে না পেরে গোড়া থেকে মড়মড় শব্দে খুলে আসলো এবং অক্ষতভাবে পুরো ব্রীজটা পদ্মার পানিতে পড়ে তলিয়ে গেল । এর পর থেকে শুরু হলো মানুষের আর্তনাদের দিন।  অল্প কিছু দিনের মধ্যে আশেপাশে থাকা সব বাড়ি ঘড় আর রইল না । আর জায়গা গুলো চলে গেল পদ্মার দখলে । এভাবে দিন দশেকের মধ্যে নদী বিশাল পরিমাণ একটা জায়গা তার দখলে নিয়ে আমাদের বাড়ির কাছাকাছি চলে এলো । আমাদের বাড়ির পর কয়েকটা বাড়ি পশ্চিমেই পদ্মা । বাসা থেকে বেড়িয়ে পশ্চিমে তাকালেই নদী দেখা যাচ্ছে । জাহাজ দেখার জন্য আর দূরে  যেতে হচ্ছে না । এভাবে  বছর দুয়েক সেখানেই রইল নদী । সবাই ভাবলো আর বোধহয় কাউকে এলাকা ছাড়তে হবে না । কিন্তু পদ্মা আবারও কাছে আসতে শুরু করলো । কিন্তু এবার ধীরে ধীরে । আমাদের বাড়ির আগের বাড়িটার সামনে এসে থামল । ততদিনে আমার নানাও ঘরদোর বিক্রি করে অন্য জায়গায় বাড়ি বানানো শুরু করে দিয়েছে । বাকি ছিল পূর্ব দিকের দুটি ঘর । সেই সময় আমার বাবা ফিরে এলো । সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে এবং সে মাকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে চায় । তো মাস আটেক সেখানেই রইলাম । বাবা কিছুদিন পরপরই আসে আমার জন্য অনেক কিছু নিয়ে । আমাদের মধ্যে ভালো একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছে কয়েকদিনেই । এর মধ্যে সামনের বাসাটা ভেঙ্গে গেল । নদী ধীরে ধীরে আমাদের বাসা ভাঙতে শুরু করলো । আমাদের বাড়িটা যেহেতু ছিল অনেক বড়  তাই যখন দুয়ারের মাঝামাঝিতে নদী অবস্থান করছিল তখনও বাড়ির বাকি অর্ধেক অংশে সহজেই বসবাস করা যাচ্ছিল । 
আমি এর মধ্যে ক্লাস থ্রিতে ফাইনাল এক্সাম দিলাম , রেজাল্ট ও প্রকাশিত হলো । বছরের শুরুতে দাদুবাসায় শিফট হলাম । এখানের স্কুলে ক্লাস ফোরে ভর্তি হলাম । আর এখানে আমার একটু ও মন টিকতো না । প্রতি বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষে আমার আম্মুর আমাকে নিয়ে নানুবাসায় যেতে হতো আমার কান্নাকাটিতে । তারপর শুক্রবার বিকেলে ফিরে আসতাম । এভাবে বছরের অর্ধেক চলে গেল । 
আমরা নানুবাসায় গেলাম আবার । আর সেই বার ঘটলো অপ্রত্যাশিত ঘটনা । এক রাতের মধ্যেই নদীর পানি এমনভাবে আছড়ে পড়তে লাগল আর তীর ভাংতে শুরু করল যে রাতারাতি আশেপাশের আরও মানুষজনসহ সবাই মিলে আমাদের ঘর ভেঙ্গে সরিয়ে ফেলতে হলো । এরপর আমরা সেই রাতে নানাদের পুরনো বাড়িতে গিয়ে  উঠলাম । সেই রাতেই ঘন্টা দুয়েক পর আবার গেলাম আম্মু , আম্মুর ফুপু , তার নাতনি আরও কয়েকজন । দেখলাম ঘন্টা দুয়েক আগেও যেখানে ঘর ছিল সেখানে এখন নদীর পানি । স্রোতগুলো যেন টগবগ করছে । চলে এলাম  । সেদিন খুব একটা খারাপ লাগেনি । কারণ সাথে আম্মুর ফুপুর নাতনি ছিল আমার বয়সী । ওর সাথে ভালোই আগে আগে নেচে ফিরছিলাম । কিন্তু হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে দেখি আম্মু ওড়নায় মুখ ঢেকে কাদতে কাদতে আসছে । আমারও মনটা একটু খারাপ হলো তখন ।
পরের দিন সকালে আমি একা যাই সেখানে । বাড়ি নিয়ে গিয়েছে নদী । বাড়ির পর ছিল পুকুর । অনেক বড় পুকুর ছিল । পুকুরটা নদীর সাথে পুরোপুরি ভাবে মিলিয়ে গেলেই বাড়ির আর কোনো চিহ্ন থাকবে না । পুকুরের অন্য পাড়ে বসে দেখতে লাগলাম । পুকুরে অল্প অল্প করে নদীর পানি ঢুকে দখলে নিয়ে নিচ্ছে পুকুরটাকে । আমার চিরচেনা পুকুর , যে পুকুরটা আমাদের , সেটা আজ নদীর দখলে । সেখানে বাইরের পানি প্রবেশ করছে । পুকুরের রুপটাকে অচেনা বানিয়ে তুলছে ক্রমশ । এই পুকুরটা আমাদের হলেও আজ যেন আর সেটা বলতে পারছি না । সেই অধিকারটা যেন আজ আর নেই । ছোট্ট আমি একা ঘাসের উপরে বসে মনে মনে বলছি , " আরে আমার পুকুর নিয়ে গেল , কেউ আটকাও "!!!

Comments

    Please login to post comment. Login