১. সদরঘাটের ছায়া
ঢাকার সদরঘাট। কুয়াশায় ভরা সকালের রাস্তা। মানুষের ভিড়, হকারের চিৎকার, রিকশার ঘণ্টা, আর সবকিছুর মাঝেও এক নিঃশব্দ বুড়ো মানুষ বসে আছে রাস্তার একপাশে। নাম রফিক। বয়স হবে পঁইষট্টি। মুখে দাড়ি, গায়ে ছেঁড়া পুরনো একটা চাদর। সামনে রাখা একটা প্লাস্টিকের পাত্র।
“একটু সাহায্য করেন ভাইজান,”—একই সুরে বলে চলে সারাদিন। মুখে হাসি নেই, কিন্তু ভিক্ষার জন্য হাত বাড়াতে তার লজ্জা নেই। কারণ এই জীবনে সে অনেক কিছু হারিয়েছে—আর হারানোর কিছু নেই।
পাস দিয়ে চলে যাওয়া ব্যস্ত মানুষরা কেউ দেখে না এই মানুষটিকে। কেউ কেউ তাকিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে, কেউ ঘৃণা মিশিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু রফিক অভ্যস্ত—আজ বহু বছর ধরে সে এই রাস্তাতেই বসে।
২. পুরনো দিনের আলো
সবাই জানে রফিক ভিক্ষুক, কিন্তু কেউ জানে না, সে একদিন ছিল স্কুলশিক্ষক। নাম ছিল "রফিক স্যার"। গ্রামের এক হাইস্কুলে তার হাতে অনেক ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখেছে। বই, খাতা, ছড়া, গুণের ছক—সবই তার নখদর্পণে ছিল।
স্ত্রী ছিল, ছোট একটা ছেলেও ছিল—মাহিন। সংসার ছোট, তবু সুখী। তবে একদিন এক রাজনৈতিক ঝামেলায় স্কুল বন্ধ হয়। এলাকায় দাঙ্গা হয়। তাতে ঘরবাড়ি পুড়ে যায়, স্ত্রী অসুস্থ হয়ে মারা যায়, আর ছোট ছেলেটা হারিয়ে যায়—মনে হয় অপহরণ হয়েছিল।
সব কিছু হারিয়ে রফিক চলে আসে শহরে। কাজ খুঁজে পায় না। দিন দিন ভেঙে পড়ে। খাওয়ার জন্য হাত পাততে হয়। মানুষ তার চোখে মূল্য হারায়, কিন্তু রফিক শিক্ষা হারায় না।
৩. ছোট্ট রায়ান
একদিন সকালে রফিকের সামনে এসে দাঁড়ায় একটা ৬-৭ বছরের ছেলে। তার নাম রায়ান। মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার ভান করে, কিন্তু স্কুলে যায় না। ওর মা ঝিয়ের কাজ করে, বই কেনার মতো সামর্থ্য নেই।
রায়ান কৌতুহল নিয়ে বলে, “চাচা, আপনি সারাদিন বসে থাকেন?”
রফিক হাসে, “হ্যাঁ বাবা, মানুষের মুখ দেখি, কপাল দেখি। মাঝে মাঝে দুই টাকা পাই, কখনো কিছুই না।”
“আপনি কি পড়াতে পারেন?”
প্রশ্নটা শুনে রফিকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। অনেক বছর পর কেউ তাকে শিক্ষক হিসেবে কিছু জানতে চাইলো!
“পারি তো বাবা। তুই শিখবি?”
“আমার তো বই নেই।”
“তা থাকলে হবে না। মাটির ওপরও শেখা যায়,”—বলেই সে মাটিতে আঙুল দিয়ে লেখে:
"অ"
রায়ান চোখ বড় করে চেয়ে থাকে। শুরু হয় দু’জনের এক ভিন্নরকম শিক্ষা।
৪. শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে
রায়ানের মতো আরও কয়েকজন পথশিশু খেয়াল করে রফিক চাচাকে। তারা আসে, বসে, শিখে।
রফিক তাদের শেখায়—বর্ণমালা, সংখ্যা, গুণ, ভাগ, এমনকি গল্প পর্যন্ত। সময় কাটে না, সময় থেমে থাকে তাদের চারপাশে।
লোকজন কৌতুহল নিয়ে দেখতে থাকে। কেউ কেউ বলে, “ভিক্ষুক শিক্ষকের ভূমিকায়!”
কিন্তু কিছু মানুষ সম্মান জানাতে শুরু করে।
৫. এক আগন্তুক তরুণী
একদিন আসে আফরোজা নামের এক তরুণী। তিনি NGO-তে কাজ করেন। দূর থেকে রফিক চাচার ক্লাস দেখে তিনি বিস্মিত হন।
তিনি এসে বলেন, “চাচা, আপনি এমন করছেন কেন?”
“কারণ এই বাচ্চারা আমার ছেলে হয়ে গেছে।”
আফরোজা সিদ্ধান্ত নেন, এই মানুষটিকে সাহায্য করবেন। NGO-এর সঙ্গে কথা বলে একটা ছোট ঘর ঠিক করেন ক্লাস নেওয়ার জন্য। সেখানে টেবিল-চেয়ার, চক, বোর্ড রাখা হয়।
৬. আবার নতুন শুরু
রফিক এখন প্রতিদিন সকাল ৯টায় ক্লাস নেন। নাম রাখা হয়—“ছায়ার পাঠশালা”।
পথশিশুদের নিয়ে গড়া এই স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি শেখানো হয়—ভদ্রতা, মানবতা, স্বপ্ন দেখার সাহস।
লোকজন সাহায্য করতে আসে। কেউ বই দেয়, কেউ জামা, কেউ খাবার। কিন্তু রফিক কারো কাছে নিজের জন্য কিছু চায় না।
সে শুধু বলে, “আমার জন্য নয়, ওদের জন্য দিন।”
৭. রায়ানের বড় স্বপ্ন
রায়ান এখন বড় হয়েছে। পড়তে জানে, লিখতে জানে, গল্প বলতে পারে। সে রফিক চাচার সামনে দাঁড়িয়ে বলে:
“চাচা, আমি ডাক্তার হতে চাই!”
রফিকের চোখ জলে ভরে যায়। “তুই হবি রে রায়ান। আমি দেখব না হয়তো, তবুও তুই হবি।”
৮. সমাজে আলো জ্বলে
এক সাংবাদিক খবর ছাপে:
“এক ভিক্ষুক গড়ছে জাতি! সদরঘাটের পাশে ছায়ার পাঠশালা।”
সব জায়গায় আলোচনায় আসে রফিক। টিভিতেও খবর হয়। পুরোনো ছাত্ররা এসে দেখে তাদের রফিক স্যার এখনো শিক্ষক!
৯. শেষ বিদায়
বয়সের ভারে একদিন রফিক বিছানায় পড়ে যান। রায়ান তখন কলেজে। সে প্রতিদিন এসে দেখাশোনা করে।
এক শীতের রাতে রফিক চুপচাপ বিদায় নেয়।
তার পাশে রাখা একটি চিঠি—
“রায়ান, আমি গর্বিত। তুই আলো ছড়াস। তোর জীবনেই আমার জীবনের স্বপ্ন পূরণ। ভালো থাকিস। তোর চাচা—রফিক।”
১০. স্বপ্নের জয়
পাঁচ বছর পর।
এক অনুষ্ঠান। তরুণ ডাক্তার রায়ান মাইক্রোফোনে বলেন:
“আমার জীবন বদলেছে এক ভিক্ষুকের হাতে। তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না—তিনি ছিলেন আলোকবর্তিকা।”
পেছনের প্রজেক্টরে ভেসে ওঠে সেই ছবি—এক বুড়ো মানুষ, ছেঁড়া চাদরে, শিশুদের পাশে বসে Chalk দিয়ে লিখছেন মাটির উপর—
“ভবিষ্যৎ।”