Posts

প্রবন্ধ

ইন্সটিটিউসনাল অর্থনীতি: নিয়ম-কানুনই কি উন্নয়নের আসল চালক?

July 26, 2025

Fojla Rabbi

245
View

বিশ্ব অর্থনীতিতে উন্নয়ন কেবল পুঁজির পরিমাণ, শ্রমের প্রাচুর্য কিংবা প্রযুক্তির প্রয়োগে সীমাবদ্ধ নয়। বরং বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একই ধরণের সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এক দেশ অগ্রসর হয়ে যায়, অন্যটি থেকে যায় স্থবির। এই অসামঞ্জস্যের মূল ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ইন্সটিটিউসনাল অর্থনীতি বা Institutional Economics থেকে। এটি অর্থনীতির এমন একটি শাখা, যা বিশ্লেষণ করে আইন, নীতি, সামাজিক প্রথা, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক পরিবেশ—এই সব প্রতিষ্ঠান কীভাবে একটি দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে।

ইন্সটিটিউশন বলতে বোঝানো হয় “সমাজে মানুষের আচরণকে পরিচালিত করে এমন নিয়ম, রীতি ও কাঠামো।” এটি হতে পারে লিখিত আইন (যেমন: চুক্তি আইন, কর আইন), আবার হতে পারে অলিখিত সামাজিক রীতি (যেমন: ব্যবসায়িক আস্থার সংস্কৃতি)। ডগলাস নর্থের ভাষায়, “Institutions are the rules of the game, while organizations are the players.” অর্থাৎ, নিয়ম ঠিক করে কীভাবে খেলা চলবে; আর প্রতিষ্ঠান ঠিক করে সেই নিয়ম কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হবে।

ইন্সটিটিউসনাল অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি হল লেনদেন ব্যয় (transaction cost)। প্রত্যেক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথেই একটি খরচ জড়িত—তথ্য সংগ্রহ, চুক্তি বাস্তবায়ন, আইনি সুরক্ষা, বিশ্বাসযোগ্যতা ইত্যাদি। একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এই খরচ হ্রাস করে, ফলে বাজারে স্বচ্ছতা ও গতি আসে। কিন্তু দুর্বল প্রতিষ্ঠান সেই খরচ বাড়িয়ে দেয়, যা বাজারে অনাস্থা তৈরি করে এবং বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়া মালিকানা সুরক্ষা (property rights) নিশ্চিত না থাকলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক ঝুঁকি নিতে চায় না, যা প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দিতে পারে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হলো path dependence, যার মতে, একবার কোনো প্রতিষ্ঠান বা নিয়ম চালু হলে তা সহজে পরিবর্তন হয় না—even যদি তা অকার্যকর বা ক্ষতিকর হয়ে পড়ে। এর ফলে অনেক দেশ উন্নয়নমূলক সংস্কার আনতে পারে না, বরং পুরোনো কাঠামোর ফাঁদে পড়ে যায়।

এই তত্ত্বগুলোকে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকোর বাস্তব উদাহরণ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে—যারা ভূগোলগতভাবে পাশাপাশি থাকলেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একে অপরের বিপরীত।

🇺🇸 যুক্তরাষ্ট্র: সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান ও উদ্ভাবনের প্রতীক

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে অন্যতম উন্নত ও উদ্ভাবনশীল অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃত। এর পেছনে রয়েছে শতাব্দীজুড়ে গড়ে ওঠা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানসমূহ। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান, আদালত ব্যবস্থা, এবং চুক্তি বাস্তবায়নের আইনি কাঠামো এমনভাবে সাজানো যাতে ব্যক্তি স্বাধীনতা, মালিকানা অধিকার ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম নিরাপদ থাকে। এই সুরক্ষার ফলেই সেখানে বিনিয়োগ, গবেষণা ও নতুন উদ্যোগ (startups) গড়ে ওঠে প্রতিনিয়ত।

"Rule of Law" যুক্তরাষ্ট্রে একটি মৌলিক প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি। আইন সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য—এই বিশ্বাস মানুষকে নতুন কিছু শুরু করতে এবং ঝুঁকি নিতে সাহস দেয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন উদ্যোক্তা জানে, তার আইডিয়া যদি নকল হয়, আদালত তাকে ন্যায্যতা দেবে। এই কাঠামোই সিলিকন ভ্যালির মতো অঞ্চলে উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতাকে সম্ভব করেছে।

তাছাড়া, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা, প্রতিবেদনমূলকতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে সরকারি ব্যয় ও নীতির ওপর জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা, ট্রান্সপারেন্সি ইন ইলেকশনস, এবং শক্তিশালী কর-নীতি প্রতিষ্ঠানসমূহ মার্কিন অর্থনীতিকে বিশ্বব্যাপী আস্থার প্রতীক বানিয়েছে।

🇲🇽 মেক্সিকো: দুর্বল প্রতিষ্ঠান ও সম্ভাবনার অপচয়

অন্যদিকে, মেক্সিকো একটি মধ্যম আয়ের দেশ, যার প্রাকৃতিক সম্পদ, কৌশলগত অবস্থান এবং বাণিজ্যিক সম্ভাবনা প্রচুর থাকলেও কাঙ্ক্ষিত গতিতে উন্নয়ন করতে পারছে না। এর প্রধান কারণ—দুর্বল প্রতিষ্ঠান, অব্যবস্থাপনা, এবং উচ্চ মাত্রার দুর্নীতি।

মেক্সিকোর বিচারব্যবস্থা দুর্বল এবং অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। আদালতের রায় কার্যকর করতে দীর্ঘ সময় লাগে, অনেকসময় তা হয়ও না। ফলে ব্যক্তি বা বিদেশি বিনিয়োগকারী নিশ্চিত থাকে না যে, তার অধিকার রক্ষা পাবে। মালিকানা সুরক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়লে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়ে। এছাড়া করব্যবস্থার জটিলতা, অব্যবস্থাপনা এবং "informal economy"–র উচ্চ মাত্রাও ইন্সটিটিউশনাল দুর্বলতার প্রকাশ।

মেক্সিকোর নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো (regulatory bodies) প্রায়ই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শিকার হয়, ফলে স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা কমে যায়। একই সাথে, পুলিশ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ওপর আস্থা কম থাকার ফলে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে, যা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।

এতসব সীমাবদ্ধতার মাঝেও মেক্সিকো যে মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে, তার প্রধান কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও শিল্প উৎপাদনের কিছুখানি পুনর্বিন্যাস। তবে, এই সুবিধার পূর্ণ সুবিধা নিতে হলে মেক্সিকোকে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন করতে হবে।

🔍 তুলনামূলক শিক্ষা: একই অঞ্চল, ভিন্ন বাস্তবতা

যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো ভূগোল, জনসংখ্যা ও সাংস্কৃতিক সংযোগে ঘনিষ্ঠ হলেও প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোয় রয়েছে বিপুল পার্থক্য। এই পার্থক্যই দু’দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি হলো “আইন ও বিশ্বাসযোগ্যতা,” সেখানে মেক্সিকো এখনো লড়ছে “ব্যবস্থাগত দুর্বলতা ও জবাবদিহিতার অভাব”-এর বিরুদ্ধে।

এই উদাহরণ দুইটি স্পষ্ট করে যে, সম্পদ নয়—একটি দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের গুণমান, নিয়ম-নীতি বাস্তবায়নের কার্যকারিতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর।

✅ নিয়মই শক্তি

ইন্সটিটিউসনাল অর্থনীতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—অর্থনীতি শুধু বাজার নয়, বরং সেটিকে ঘিরে থাকা সামাজিক কাঠামো, আইন এবং রাজনৈতিক পরিবেশ। নিয়ম-কানুন, বিশ্বাসযোগ্যতা, এবং মালিকানা সুরক্ষা ছাড়া অর্থনীতির কোনো কাঠামো স্থায়ী হতে পারে না। রাষ্ট্র যদি তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী না করে, তাহলে প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিশ্রম বা প্রযুক্তি কোনোই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারবে না।

এই বাস্তবতাকে বুঝে যে রাষ্ট্র, সেখানেই জন্ম হয় উদ্ভাবন, বিনিয়োগ এবং মানবকল্যাণের। আর এখানেই ইন্সটিটিউসনাল অর্থনীতির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।

Comments

    Please login to post comment. Login