মায়া গন্ডি
পর্ব : ৪
মোহাম্মদ নূর
ফ্ল্যাশব্যাক ১৯৮৭
সারা ঘরে নিরবতার বাতাস বইছে। ভুত যেনো ভর দুপুরেই প্রবেশ করল। ঐশ্বর্য আবার জিজ্ঞেস করল, "আম্মা, বললে না যে, ওই কালি ঘাটের রহস্য কি? সবাই কেনো এতো ভয় পায় ওই ঘাট নিয়ে?"
শান্তি বলল, "আমি নিজেও জানি না। আগে খেয়ে নে, পরে এই সব কথা ভাবিস।"
ঐশ্বর্য আর সাহস পেলো না দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার। তারা একসাথে খেতে বসল। তখনি কেউ একজন লাঠিতে ভর করে বাসায় প্রবেশ করল। বড় করে একটা সালাম দিলো। সবাই তাকিয়ে দেখল, নুরুল রহমান এসেছে, ঐশ্বর্যের দাদা।
ঐশ্বর্য আর শান্তি তাদের মাথায় কাপড় দিয়ে সালাম দিল। শান্তি ঐশ্বর্যের সালামের উত্তর দিতে যেতেই নুরুল বলল,
"দাদু ভাই, খাবারের সময় সালাম দিতেও হয় না, নিতেও হয় না।"
ঐশ্বর্য হাসি দিয়ে বলল, "জি দাদু, আপনি কেমন আছেন?"
"আমি আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।"
আসলে নুরুল রহমান এতদিন আল্লাহর রাস্তায় একশো বিশ দিনের সময় দিতে গিয়েছিলেন, যাকে আমরা ‘৩ চিল্লা’ বা একশো বিশ দিনের জামায়েত সফর বলি। ইউসুফ এসে জরিয়ে ধরল। শান্তি বলল, "বাবা ভালো আছেন?"
নুরুল বললেন, "হে বৌমা, ভালোই আছি মহান আল্লাহর রহমতে, এখনো সুস্থ আছি।"
"তা আজ রহমান বাড়ি এত নিরব কেন?" ইউসুফ বলল।
"দাদা, আইজ বাড়িতে পুলিশ আইছিল। আম্মাই ইচ্ছা মতো ঝাড়ছে।"
"কি বলে বৌমা, পুলিশ কেন এসেছিল?"
শান্তি বলল, "আসলে বাবা, ওই কালি ঘাটে নাকি আমাদের ইসমাইল চাচার ছেলেকে মানুষ দেখেছিল। তাই তাকে নিয়ে বাজারে বিচার চলছিল। তখনি নাকি ওই কালি ঘাটে আরেকটা লোককে গ্রামের মানুষ দেখতে পায়, দুইটা লাশ নিয়ে দারায়া আছে। গ্রামের মানুষ ওইখানে যাওয়ার আগেই সে লাশ দুইটা পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে পালিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে আসে। তাই পুলিশ ভেবেছে, আমাদের বাসায় গা ঢাকা দিয়েছে, তাই তারা তল্লাশি দিয়ে গেছে।"
নুরুল রহমান বললেন, "দাদু ভাই যে,বললো, বৌমা ইচ্ছা মতো ঝাড়ছে? কেন? তারা কি কিছু বলেছে?"
"বললে বলো, একেকটার খবর আছে।"
ঐশ্বর্য বাকি কথা বলতে যেতেই শান্তি বলল,
"আরে কই না, এমনি, না বলে বাড়িতে ঢুকেছে, তাই কিছু কথা শুনিয়েছি। পরে তারা ক্ষমা চেয়েছিল।"
শান্তি আরো বলল,
বাবা হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নিন পরে বিস্রাম নিয়েন এতো লম্বা রাস্তা হয়ে এসেছেন।
"ঐশ্বর্য, খাওয়া শেষ করে ঘরে যা। আমি পরে এসে তোর সঙ্গে কথা বলবো।"
ঐশ্বর্য মনে মনে ভাবছে, "আম্মা মিথ্যা কথা বলল কেন? তারা তো দরজায় অনুমতি নিয়েই ঢুকলো।"
সে রুমে এসে বসে রইলো। তাদের বাড়ির পিছনের দিকটায় ছিলো সুপারি গাছের বাগান। বাগানের ডান পাশেই ছিলো ব্রহ্মপুত্র নদ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হচ্ছিলো, সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমের রাতের অন্ধকারে আকাশটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। আষাঢ় মাসে যেমন হয়—কখনো ঘন কালো অন্ধকার, কখনো পরিষ্কার, সচ্ছ আকাশ।
বাড়ির পেছনে বসার আরি পাতা ওখানে বসে ঐশ্বর্য আষাঢ় মাসের সীমাহীন বৃষ্টিবাদলের খেলার দৃশ্য দেখে আর ভাবে , সে যদি ওই বৃষ্টিবাদলকে হাতে ধরে দেখতে পারতো, যদি ওই আকাশে তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে উরতে পারতো? তখনি তার মনমরা হয়ে গেলো আরো ভাবলো, কিন্তু সব তো আর সবার ভাগ্যে থাকে না , ওহ উর্মি আপু কোথায় তুমি তুমি তুমাকে সাথে করে উড়ে বেরাতে পারতাম। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নুরুল রহমান পেছনে কাশি দিল।
ঐশ্বর্য সালাম দিল। সালামের উত্তর দিয়ে নুরুল রহমান বললেন,
"কি আষাঢ়ের আকাশ! যত দেখবে তত মুগ্ধ হবে, গোলাপি সুন্দরী।"
ঐশ্বর্য হাসলো, বলল,
"দাদু, এদিকে আসো, এসে বসো।"
নুরুল রহমান বসলেন। তারা অনেক আলাপ আলোচনা করল। তার পর ঐশ্বর্য জিজ্ঞেস করল,
"আচ্ছা দাদু, তুমি কি কালি ঘাটের বিষয়ে কিছু বলতে পারবে? আমার খুব ইচ্ছে করে ওই জায়গার বিষয়ে জানতে। সবাই তো ওইখানের নাম শুনলেই ভয় পায়। আচ্ছা ওখানে কি সত্যি ভুত আছে?"
নুরুল রহমান বললেন,
"দেখো গোলাপি সুন্দরী, সবার দেখার আলাদা আলাদা নজর আছে।"
নুরুল রহমান আর ঐশ্বর্য এভাবে একান্তভাবে সময় কাটানোর মুহুর্তে নুরুল রহমান ঐশ্বর্যকে ‘গোলাপি সুন্দরী’ বলে ডাকতো।
তিনি আরো বললেন,
"কেউ ভুত বিশ্বাস করে, ভুত দেখে; আর কেউ মানুষ বিশ্বাস করে, মানুষ দেখে। কিন্তু দাদু ভাই, একটা কথা মাথায় রাখবা—যা রটে তা কিছু টা হলেও ঘটে।"
ঐশ্বর্য বুঝতে পারে, কিছু তো একটা ঘটেই। নইলে তার দাদু এইভাবে বলতেন না, কারণ তিনি ভুতে বিশ্বাস করেন না, তিনি খুব শক্ত মনের মানুষ।
নুরুল রহমান বললেন,
"গোলাপি সুন্দরী, কি ভাবছ? আর এই সন্ধ্যা সময় তুমি এখানে চুল খুলে দাঁড়িয়ে কেনো? সন্ধ্যা সময়ে মেয়েদের এভাবে চুল খুলে বাইরে বের হওয়া উচিত নয়। এতে অনেক অপশক্তির নজর পড়ে। আর তুমি তো সুন্দরীদের সেরা। তোমাকে দেখলে জিন জাতির গুষ্টি ধরে পিছে পরে যাবে।" নুরুল হাসলেন
কথাটি মস্করা ভেবে ঐশ্বর্য হেসে উড়িয়ে দিলেও নুরুল রহমানের কথাটিতে অনেকটাই ওজন ছিলো। তিনি সুপারি বাগানে কাউকে তো দেখেছেন যে ঐশ্বর্যের ওপর অনেক সময় ধরে নজর রাখছে।
নুরুল রহমান কণ্ঠ কঠোর করে বললেন,
"শোনো, তুমি কাল থেকে বিকেল বেলায় পিছনের উঠোনে আসবে না।"
ঐশ্বর্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"কেনো দাদু?"
নুরুল রহমান বলে উঠলো,
"আহ, আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। এটা আমার কঠোর আদেশ। এর বাইরে যাবে না, বুঝলে?"
ঐশ্বর্য ভয় পেয়ে যায় এবং মাথা নারিয়ে ভিতরে চলে আসে। ও ভাবতে লাগলো, হঠাৎ কি এমন হলো দাদুর?
ঐশ্বর্যের এখনো মনে আছে, একসময় নুরুল রহমান তার মায়ের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করতো। তখন রবি, দেশের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তখন ঐশ্বর্য অনেক ছোট, তাই তেমন কিছু মনে নেই। তার মাকে জিজ্ঞেস করলেও বলতো না।
একসময় এই সব কথা ভুলে যায় সে, কিন্তু আজ তার খুব মন চাইছে সে তার মাকে জিজ্ঞেস করবে,
"দাদু কেনো এমন করতো?
এইসব ভাবতে ভাবতেই রাত হয়ে যায়।
একসময় তারা খাওয়া দাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়ে। মাঝরাতে কেউ ঐশ্বর্যের ঘরের জানালায় টোকা দেয়। ঐশ্বর্যের ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমে ভাবে তার মনের ভুল, এরপর আরো কয়েকবার টোকার শব্দ শুনতে পায়।
সে ভয় পেয়ে ধীরে ধীরে জানালা খুলল। জানালা খুলে যা দেখতে পেলো তা দেখার জন্য কিছুতেই সে প্রস্তুত ছিলো না।
.
ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
পর্ব ৫ দ্রুত আসবে, সবাই পাশে থাকবেন। ধন্যবাদ।