পোস্টস

নন ফিকশন

কার্ল স্মিটের একমাত্র কবিতা ও একটি গদ্যরচনা

২৮ মে ২০২৪

অরিত্র আহমেদ

মূল লেখক কার্ল স্মিট

অনুবাদক অরিত্র আহমেদ


১. 
ষাট-বছরের বুড়োর গান

বল্গাহীন নিয়তিকে সহ্য করে বেঁচে আছি আমি, 
জয় আর পরাজয়, বিপ্লব ও পুনরুদ্ধার,
মূল্যহ্রাস, মূল্যস্ফীতি, ক্ষমতা বদল আর বিদীর্ণ পাইপ, 
ক্ষুধা আর শীত, বন্দী শিবির আর নির্জন কারাবাস- 
এসবের মধ্য দিয়ে পেরিয়ে এসেছি আমি, 
আমার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে এই সবকিছু।

আমি চিনি সন্ত্রাসের নানাবিধ রূপ, 
সন্ত্রাস ওপরের, সন্ত্রাস নিচের,
ভূমির সন্ত্রাস আর বায়ুর সন্ত্রাস, 
বৈধ আর অবৈধ সন্ত্রাস, 
বাদামি, রক্তিম, আর চৌখুপিতে বিন্যস্ত সন্ত্রাস, 
চিনি ভয়াবহতম সেই সন্ত্রাসও, ভয়ে যার নামোচ্চারণ করে না কেউ,
আমি সব চিনি, আমি গতিবিধিও জেনেছি তাদের।

ক্ষমতা ও আইনের বন্দনা-গায়কদের চিনি,
আমি চিনি সরকারের মুখর দালাল, আর চিনি যতো মিথ্যাচারীদের;
অসংখ্য নাম-সম্বলিত ব্লাকলিস্ট, 
আর নিপীড়কদের সব নথিপত্র আমি চিনি। 

এখন কী গাইবো তবে? স্তোত্র প্লাসেবো? 
সব দুঃখ ভুলে গিয়ে গাছপালা-প্রাণীদের ঈর্ষা করে যাবো? 
প্যানিস্টদের চক্রে বসে আতঙ্কে কাঁপবো থরোথরো? 
নাকি ডাঁশমাছিদের মতো নাচবো পরম খুশিতে? 

তিন তিন বার আমি পড়েছি মাছের পেটে ঢুকে, 
জল্লাদের হাতে মৃত্যুবরণের সামনে দাঁড়িয়েছি,
তবুও আমাকে পরিত্রাণ করে ভবিষ্যদ্বক্তা সেই কবিদের বাণী, 
আর প্রাচ্যদেশবাসী এক সাধু এসে মুক্তির দুয়ার খুলে দেন- 

ভয় পেয়ো না, হে এই অভিষেকের সন্তান, 
কান পেতে শোনো আর দুঃখভোগ করো! 


(স্মিট এই কবিতা লেখেন ১৯৪৮ সালের ১১ জুন, অর্থাৎ তাঁর বয়স ষাট বছর পূর্ণ হওয়ার এক মাস আগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। স্মিট এখনো অনুতপ্ত নন (এবং অনুতপ্ত তিনি হবেনও না কখনো)। দার্শনিকের বদলে তাঁর খ্যাতি বা কুখ্যাতি তখন 'নাৎসী তাত্ত্বিক' হিসেবে। কিন্তু তাঁর অবস্থান যা-ই হোক, তিনি যে তাঁর সময়ের রাজনীতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যবেক্ষক ছিলেন, এটা তাঁর সবচেয়ে বড়ো শত্রুও আজ অস্বীকার করবে না। এই কবিতায় হয়তো সেটাই সবিনয়ে জানাতে চাইছেন স্মিট। মজার ব্যাপার হলো, অন্যান্য অভিযোগের সাথে স্মিটের বিরুদ্ধে নাৎসীরা ক্যাথলিক-ভাবাপন্নতার অভিযোগ এনেছিলো। এবং স্মিট এক পর্যায়ে তাঁর আনুষ্ঠানিক পদ থেকে ইস্তফা দিতেও বাধ্য হয়েছিলেন। সেটা ১৯৩৬ সালের কথা। এই কবিতায় শেষে যে প্রাচ্যদেশের সাধুর কথা আমরা জানতে পারি, তিনি কি যীশু? হতেও তো পারে। নাৎসীরা তবে ঠিকই ছিলো?)









২.
এডুয়ার্ড স্প্রেঙ্গারের সঙ্গে কথোপকথন ( গ্রীষ্ম, ১৯৪৫)

তুমি কে? Tu quis es? দুরবগাহ একটি প্রশ্ন। ১৯৪৫-র জুনের শেষের দিকে, যখন বিখ্যাত দার্শনিক ও শিক্ষক এডুয়ার্ড স্প্রেঙ্গার  আমাকে একটি প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে তার উত্তর পাওয়ার অপেক্ষা করছিলেন, তখন আমি প্রশ্নটি ভালো করে তলিয়ে দেখেছিলাম। উনি আমাকে বলেছিলেন, আমার বক্তৃতাগুলি সবসময়ই খুব প্রাণবন্ত হয়ে থাকে, কিন্তু আমি নিজে- আমার ব্যক্তিত্ব ও আমার সারসত্তা- আজ অব্দি অস্পষ্টই রয়ে গেছি। গুরুতর এই অভিযোগ, কারণ এর অর্থ দাঁড়ায় এরকম: তুমি যা ভাবো এবং যা বলো, তা হয়তো স্পষ্ট ও কৌতূহলোদ্দীপক; কিন্তু তুমি নিজে যা, অর্থাৎ তোমার আত্মসত্তা (self), তোমার সারসত্তা (essence), তা এখনো অস্পষ্ট, ঝাপসা রয়ে গেছে। 

ব্যাপারটা ভেবে ধাক্কা খেয়েছিলাম আমি। কী কাজে আসবে আমার এই সুন্দরতম বক্তৃতাগুলি কিংবা আমার স্বচ্ছতম ধারণাগুলি, কিংবা আমার এই মনন? প্রশ্নটা হলো সারসত্তার। কিংবা, প্রশ্নটা হলো সত্তা ও অস্তিত্বের। সংক্ষেপে বললে, যে গুরুতর সমস্যার সমাধান দর্শন এখনো করতে পারেনি, সেটাই আমার আত্মার উপরে চেপে বসলো। কারো চিন্তা যদি স্বচ্ছ হয়, তো তার সারসত্তা কেনো অস্বচ্ছ হবে? এ ধরনের বৈপরীত্য কিভাবে সম্ভব? হাজার বছরের পুরনো, আবার একই সঙ্গে চরম আধুনিক এই বৈপরীত্যগুলি আমাকে দংশন করতে লাগলো ও আমাকে পেয়ে বসলো: চিন্তা ও সত্তা, জ্ঞান ও জীবন, প্রবৃত্তির বিপরীতে বুদ্ধি, আত্মার বিপরীতে মন- এ জাতীয় বৈপরীত্যের এক বিশাল ধারা আমার মনের মধ্যে বয়ে যেতে লাগলো। 

এখন আমার কী করা উচিত? আমি কি এখন স্বচ্ছ মানুষ হওয়ার সাধনা করবো? নাকি আমার উচিত এটা প্রমাণ করে দেওয়া যে, বস্তুতঃ আমি এতো অস্পষ্ট কোনো মানুষ নই; বরং- অন্তত দয়ালু রেডিওগ্রাফারদের চোখে হলেও- আমি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ একজন মানুষ। 

আমি এবার আমার প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালাম এবং ভাবলাম: আমাকে প্রশ্ন করার তুমি কে? তোমার এই শ্রেষ্ঠত্ববোধ কোত্থেকে এলো? যে ক্ষমতার বলে বলবান ও সাহসী হয়ে তুমি আমাকে এই প্রশ্নগুলো করছো- এমন সব প্রশ্ন যা আমাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং সেই কারণেই শেষ পর্যন্ত প্রশ্নগুলো আসলে আমাকে ধরাশয়ী করার জন্য পাতা জাল এবং ফাঁদ ছাড়া কিছুই নয়- সেই ক্ষমতার সারসত্তাই বা কী? 

এই পাল্টা প্রশ্নগুলো অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন করার মতো অবস্থানে আমি ছিলাম না। হতেই পারে যে, আমার সারসত্তা অস্পষ্ট, কিন্তু, তা সবসময়ই আত্মরক্ষাপ্রয়াসী। আমি একজন চিন্তাশীল মানুষ এবং শাণিত বক্তব্য প্রকাশে আমি অভ্যস্ত হতে পারি; কিন্তু আমি সেটা কখনোই আক্রমণাত্মক কিংবা পাল্টা-আক্রমণাত্মক অবস্থান নেওয়ার জন্য করি না। আমার সারসত্তা হলো ধীর, নিঃশব্দ, ও নমনীয়; এক প্রশান্ত নদীর মতো- মোজেল নদীর মতো: tacito rumore Mosellae ( মোজেলার প্রশান্ত মর্মরধ্বনির তলে)। 

কিন্তু আত্মরক্ষায়ও আমি দুর্বল। নিজের ব্যাপারে প্রায়োগিক আগ্রহ আমার খুব কমই রয়েছে, এবং আমার প্রতিপক্ষদের ধ্যানধারণার ব্যাপারে আমার তাত্ত্বিক আগ্রহ অতিরিক্ত বেশি, এমনকি আমার প্রতিপক্ষরা যখন বাদীপক্ষ হিসেবে হাজির হয়, তখনও। প্রতিটি অভিযোগ, প্রতিটি ফরিয়াদ, প্রতিটি ফরিয়াদী ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক পূর্বধারণাগুলোর ব্যাপারে আমি অতিরিক্ত কৌতুহলী হয়ে পড়ি। ফলে আমি বিবাদী হিসেবে যেমন ভালো নই, বাদী হিসেবেও তেমনি ভালো নই। তারপরও, বাদী হওয়ার চেয়ে বিবাদী হতেই আমি এখনো বেশি পছন্দ করি৷ ‘আমি অভিযোগ করছি'-ধরনের লোকজন এই জগতের মঞ্চে তাদের ভূমিকা পালন করে যেতেই পারে। তবে আমি মনে করি, জেরা-প্রক্রিয়ার (inquisitorial) তুলনায় অভিযোগ-দায়ের প্রক্রিয়া (prosecutorial) অধিক অশুভ। আমার ক্ষেত্রে সম্ভবত ব্যাপারটার একটা আধ্যাত্মিক শিকড় রয়েছে। কারণ diabolus শব্দটির অর্থ হলো- প্রসিকিউটর। 

আমার প্রতিপক্ষ বেশি নিষ্ঠুর হলে আমি হেরে যাই, এবং আমি তেমন কাজের কিছু নই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন ছিলো না। আমার প্রশ্নকর্তা আমার সঙ্গে কেবল কড়া হতে চেয়েছিলেন, নিষ্ঠুর হতে চাননি। অন্য দিকে, আমি কিছুই চাইনি। তার কাছে আমি কিছু চাইনি, কিছু প্রত্যাশাও করিনি। তাকে দেখে আমি খুশি হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ তার উপর আমার পুরনো ভালোবাসাটা তখনো মিইয়ে যায়নি। আর এই কারণেই আমি তাকে ঠিকঠাক দেখতে পেলেও তিনি আমাকে দেখতে পাননি। সত্য পথে থাকার এবং সত্য প্রমাণিত হওয়ার বোধে তিনি আচ্ছন্ন ছিলেন। নৈতিক, দার্শনিক, শিক্ষানৈতিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক- প্রতিটি ক্ষেত্রেই সত্য পথে থাকার এক অনুভূতি তাকে পূর্ণ করে রেখেছিলো। যা কিছু সত্য, আর সত্য মানুষকে যা কিছু দিতে পারে- নায্য কারণ (iusta causa) এবং পূর্বনির্ণীত যাবতীয় বিষয়-আশয় (res iudicata)- সবই ছিলো তার পক্ষে।

একজন আইনজ্ঞ হিসেবে আমি জানি এর অর্থ কী। মানুষের ন্যায়পরায়ণতার তুচ্ছ ট্রাজেডির ব্যাপারটা আমি জানি। ইউরোপীয় আন্তর্জাতিক আইন এবং এর ইতিহাস সম্পর্কেও আমি জানি। আজ আমি, কুইন্সি রাইটের উপস্থিতি সত্ত্বেও, পৃথিবীর একমাত্র আইনের শিক্ষক, যিনি একটা ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধের (just war) ব্যাপারটিকে (দুর্ভাগবশত গৃহযুদ্ধও যার মধ্যে পড়ে) তার সমস্ত কারণ ও গভীরতা সহকারে, নথিবদ্ধ করেছেন ও তার সম্মুখীন হয়েছেন। সুতরাং মানুষের গোঁড়ামি-র বিশাল ট্রাজেডির ব্যাপারটাও আমার জানা৷ 

অতএব, আমি অসহায়। তবে আমি ধ্বংস হয়ে যাইনি। এই দার্শনিক ও শিক্ষক, আজ যার সামনে আমি বসে আছি এমন একজন মানুষ হিসেবে, যাকে তিনি অবিশ্বাস করেন, অনেক আগে এই মানুষটিকে আমি আমার অন্তর থেকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতাম। সেই পুরনো সময়ের কথা ভেবে এবং আমি যে কখনো তাঁর কোনো ক্ষতি করিনি বা করতে চাইনি, এ কথা মাথায় রেখে, আমি তাঁকে ঠিক সেইভাবেই উত্তর দিয়েছিলাম, যেভাবে কেউ একজন দার্শনিকের প্রশ্নের উত্তর দেয়; তাঁর পাঠানো প্রশ্নপত্রের কোনো উত্তর আমি দিইনি। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘আমার সারসত্তা পুরোপুরি স্পষ্ট না-ই হতে পারে, তবে এক সুমহান কবির আবিষ্কৃত এক নাম দিয়ে আমি আমার এই মামলার নামকরণ করতে পারি। আমার মামলা হলো এক খ্রিস্টান এপিমেথিউসের মূল্যহীন, নগণ্য, কিন্তু বিশুদ্ধ এক মামলা। 

আমি এই উত্তর দেওয়ার পরে অবশ্য আমাদের আর কোনো আলাপ হয়নি। 

(গ্রীক পুরাণে এপিমেথিউস হচ্ছেন প্রমিথিউসের ভাই। প্যান্ডোরার রূপের প্রেমে পড়ে আগুপিছু না ভেবেই তাকে বিয়ে করে নেন। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে যাদের, এপিমেথিউস হচ্ছেন তাদেরই আদিপুরুষ। - অনুবাদক) 


[ দু’টি রচনাই অনুবাদ করা হয়েছে মূল মাইকেল হান্না কর্তৃক অনূদিত এবং আন্দ্রেয়াস ক্যালিভাস ও ফেদেরিকো ফিংকেলস্টাইন কর্তৃক সম্পাদিত Ex Captivitate Salus: Experiences, 1945–47 গ্রন্থ থেকে। অনুবাদের বিশুদ্ধতার স্বার্থে মূল জার্মান টেক্সটের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। ]