পোস্টস

গল্প

লিলি এন্ড হার পেট

২৮ মে ২০২৪

নূহা চৌধুরী

মূল লেখক নূহা চৌধুরী

ইউনিভার্সিটির চতুর্থ দিন আমার লিলির সাথে পরিচয় হলো। চুপচাপ শান্ত একটা মেয়ে। কিন্তু নিজে থেকে এসে কথা বলেছিলো। লিলি আমার চেয়ে দুই সেমিস্টার উপরের ছাত্রী।  আমাদের ছিল ওপেন ক্রেডিট। তাই অনেক সময় আগে পরের সেমিস্টারের অনেকেই ইচ্ছা মত সাবজেক্ট পছন্দ করে নিতে পারতো। সুবিধা মত ক্লাস ও করতে পারতো। 

কেউ যদি সরাসরি এসে প্রশ্ন করে- 

তুমি আমার বন্ধু হবে? 

তখন কি উত্তর করা যায়, তাই ঘটনার আকস্মিকতায় আমি অবাক হলাম। লিলির গলার স্বর বেশ মিহি। গোলগাল কোঁকড়া চুলের মেয়ে। আমি তাকিয়ে আছি দেখে আবার বলল-

আমাকে আজীজ স্যার তোমার কথা বলেছেন। গত ক্লাসে নাকি তুমি সুন্দর নোট নিয়েছো? তুমি কি আমাকে নোটের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারো?

আমি বুঝতে পারলাম ঘটনা কি ঘটেছে। ভাল নোটের জন্য বন্ধু হবার ঘটনা স্কুল কলেজে আমি অনেক দেখেছি।  কোন ইন্সটিটিউটে গেলে প্রথম দিন যদি আপনি টিচারদের কাউকে ইম্প্রেস করে ফেলতে পারেন তাহলে সুনজরে থাকা যায়। আমার স্কুল কলেজ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান আমাকে এটাই বলে। তাই প্রথম লেকচারে পরিচয় পর্ব শেষ হবার পর স্যার যখন সরাসরি লেকচারে চলে গেলেন আমি সুন্দর করে নোট নিলাম। আমার হাতের লেখা বেশ ভাল। শুনে এসেছি মুক্তার মত।  সেদিন ক্লাসে লিলি ছিলো না। এর মধ্যে আজিজ স্যারের দুটো লেকচার পেয়েছি। ক্লাস শেষে বুঝে নিতে গিয়ে লেকচার দেখিয়েও ছিলাম। আমি স্যার এর চোখে পড়ে গেলাম। লেকচার নেবার জন্য কেউ কারো বন্ধু হতে চায় এটা মনে মনে থাকার কথা ছিল। লিলি মেয়েটা হয় সহজ সরল অথবা একটু বেশিই স্মার্ট। ওর কন্ঠ আর চাহনী দেখে আমার মনে হলো ও সহজ সরল হবে। ভার্সিটিতে এক বেঞ্চে তো বসার সুযোগ নেই। লিলি আমার পেছনের চেয়ারে বসে মিষ্টি করে হাসলো। ক্লাসের পরে আমি লিলি কে নিয়ে ফটোকপির দোকানে গেলাম। তারপর লিলির বাসায়। 

লিলির বেডরুম বেশ গুছানো। সাদা চাদর। হালকা কুসুম রঙের পর্দা। ঘরের মধ্যেই বেশ আরাম একটা ভাব। বিছানায় একটা গাঢ় নীল রঙের কম্ফোর্টার রাখা। আমি লিলির বিছানায় গিয়ে বসলাম। ওরা বেশ অবস্থাপন্ন বাসায় এসে বুঝতে পারলাম। ডুপ্লেক্স বাসা। তবে নীচে আমার কারো সাথে দেখা হলোনা। লিলি আমাকে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বললো। কারো বাসায় গিয়ে আমি এই ব্যাপারে খুব অস্বস্তিতে ভুগি। ওয়াশরুম আমার বেশিরভাগ সময় পছন্দ হয়না। পানিতে ভিজে চুপচুপ করছে এমন অনেক সময়ই হয়েছে।  কিন্তু আমার চোখে মুখে পানি দেয়া দরকার ছিল। আমি মুখে পানির ঝাপটা দিতে দিতে শুনলাম লিলির ঘর থেকে গান ভেসে আসছে- 

নাম রেখেছি বনলতা 
যখন দেখেছি 
হয়তোবা সেই ক্ষণেই 
তোমায় ভালবেসেছি। 



সত্যি বলি শ্যামল মিত্রের গান আমি লিলির ঘরে আশা করিনি। আমি টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ওর বিছানায় এসে বসলাম। লিলি ঘরে ছিলোনা। পড়ার টেবিলের ওপরে অনেক গুলো কোলাজ করা ছবি দেখা যাচ্ছিলো। আমি উঠে সেই ছবি দেখবো চিন্তা করছিলাম কিন্তু আচমকা আমার কোলে কিছু একটা এসে পড়লো। ভারী আর লোমওয়ালা। আমি ভীষণ চমকে চিৎকার করে উঠলাম। দু হাত দিয়ে সরাতে চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু প্রাণীটা ততোক্ষণে বেশ কিছু আঁচড় বসিয়ে দিয়েছে আমার গায়ে! আমার চিৎকার শুনে লিলি ছুটে এলো না। বরং আস্তে ধীরে রুমে কফির মগ দুটো নামিয়ে রাখলো। আমাকে সে বললো 

তুমি এত চিৎকার করছো কেন? এটা তো রুবি। আমার বিড়াল। আমার আদরের রুবি । 

আমার বুক তখন থরথর করে কাঁপছে। হাতে অল্প আঁচড়। সেটা জ্বলছে। লিলি হেক্সিসল দিয়ে আমার হাতের মুছে দিলো। পোষা প্রাণী কনসেপ্টটাই আমার পছন্দ না। ঘরের মধ্যে লোম ওয়ালা একটা প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা আমার ভাল লাগেনা।  এই ঘটনার পর সেটা আমার ফোবিয়া মতো হয়ে গেলো। বিড়াল কে ভয় পাওয়া এটা একটা অসুখ। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলা হয় এইলোরো ফোবিয়া। আমার বিড়াল দেখলেই প্যানিক অ্যাটাক হতে লাগলো। প্রথমদিন এরকম ভয় পাবার ঘটনা ঘটার পর আমার লিলির বাসায় আর যাবার কথা না। মানুষ যা ভয় পায় সেটা ফেইস করতে চায়না।  তবু আমি যেতাম। কি এক অমোঘ আকর্ষণ আমাকে টেনে নিয়ে যেতো আমি তা ব্যখ্যা করতে পারবো না।  তবু লিলির বাসায় আমি অনেকবার গিয়েছি। যেন একটা রহস্য আছে এই বাড়িতে।  গিয়ে আমি যবুথবু হয়ে বসে থাকতাম। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আমার কি এক অমোঘ আকর্ষণ!  লিলির ঘরে একটাই গান বাজতো। শ্যামল মিত্রের সেই গান। নাম লিখেছি বনলতা… 

লিলির পোষা বিড়াল রুবির চোখ অন্যরকম। একটা চোখ তার সবুজ। সেখানে পাহাড়ের কাঠিন্য বসবাস করে। আরেকটা চোখে সাগরের নীল। সে চোখ যেন বলতে চায় কিছু তো ঠিক নেই এ বাসায়। এ ধরনের দু রঙের চোখের বিড়াল খুব কমন ঘটনা নয়। এটাকে অডেড আই বলে। আরেকটা গাল ভরা নাম আছে এটার। হেটারেক্রোমিয়া ইরিডিস। ইন্টারনেট দুনিয়ায় এ বিড়ালদের বেশ চাহিদা। অনেকে পেইজ খুলে বসে থাকে। তাতে থাকে হাজার হাজার লাইক। লিলি এসব পছন্দ করে না। আমি লিলির ঘরে যেয়ে একটা ফার্নিচারের মতো বসে থেকে দেখতাম লিলি তার বিড়ালের সাথে খেলছে। গালে গাল ঘষছে। পিঠে বুলিয়ে দিচ্ছে হাত। আমার গা ঘিনঘিন করতো। আমি সব ফার প্রাণীদের অসম্ভব ভয় পাই। লিলির বিড়াল আমাকে দেখলে গ্রররররর আওয়াজ তুলতো। ঘাড়ের লোম ফুলিয়ে যেন আমাকে বলতো এখানে কেন এসেছো? চলে যাও! চলে যাও!!

লিলির বাবা মা দেশে থাকতো না বছরের বেশিরভাগ সময়। এখানে একজন কেয়ারটেকার, একজন বাবুর্চি থাকে। আগের রাতে বাবুর্চি এসে জেনে নেয় লিলি পরদিন কি খাবে। বাসায় কোন গেস্ট আসবে কিনা। আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলাম লিলির তেমন কোন বন্ধু নেই। আমার লিলির জন্য খারাপ লাগতো। লিলি ওর দাদীর কাছে ছিলো। ওর দাদাকে ও দেখেনি।  ওর বাবা মা কাজের সূত্রে দেশের বাইরে। তাদের ব্যস্ততা তাদের মেয়েকে নিজেদের কাছে থাকার সুযোগ দেয়নি । লিলির কোন চাচা ফুপিও নেই। তাই দাদী সাদরে লিলিকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। এই গল্প আমাকে লিলি ইউনিভার্সিটির ক্লাসের ফাঁকে বলেছে।

 একদিন লিলি আমাকে ফেসবুকের সিবলিংস এ অ্যাড করে নিলো আর আমি খুব আবেগগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। আমার কোন ভাই বোন নেই।  লিলি তার দাদীর চোখের মণি ছিল। লিলির দাদা মারা যাবার পর তিনি বেশ একা হয়ে গিয়েছিলেন। একমাত্র ছেলে আর ছেলের বৌ যখন উচ্চ শিক্ষার্থে দেশের বাইরে যেতে চাইলো তিনি অনেকটা মনক্ষুণ্ণ হলেও কিছু বলেননি। তারপর একা একা বেশ খানিকটা সময় কেটে গিয়েছিলো। এরপর তাদের ঘর আলো করে এলো লিলি। সে সময় লিলির দাদী তার ছেলে এবং ছেলে বৌর

কাছে গিয়ে ছিলেন। লিলি কিছুটা শক্ত পোক্ত হলে দাদী দেশে ফিরে আসেন। একটা সময় লিলির বাবা মায়ের চাপ বাড়লো। দুজনেই ছাত্র। অনেক খরচ। সিদ্ধান্ত হলো লিলি তার দাদীর কাছে থাকবে। লিলি যাওয়া আসার উপর থাকলো। বছরে কিছুটা সময় বাবা মায়ের কাছে থাকা বাকি সময়টুকু দাদীর কাছে। লিলি দাদীর নেওটা হয়ে রইলো।

লিলির বাসায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটা আমার মনে বেশ প্রভাব ফেলেছে বুঝতে পারছিলাম আমি। রাতে ঘুমালে দুঃস্বপ্ন দেখতাম। স্বপ্নের রঙ ধূসর। যেন একটা ব্ল্যাক এন্ড  হোয়াইট টিভি দেখার মতো। একা একটা মাঠে বসে আছি। আমাকে ঘিরে আছে শত শত বিড়াল। তার মধ্যে একটা এগিয়ে  আসে যার ঘাড়ের লোম ফোলা। খুব রেগে আছে যেন সে। তার চোখ লিলির বিড়ালের মত। এক চোখ সবুজ অন্য চোখটা নীল। আসলে সে লিলির বিড়াল। সে আমার সামনে আসে। তার থাবা বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে। আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি। আমার বুক হাঁপড়ের মত ওঠানামা করে। গলা শুকিয়ে আসে। আমি বিছানার পাশে রাখা পানির বোতল এর ঢাকনা খুলে ঢক ঢক পানি খেয়ে নেই। আমার তৃষ্ণা মেটেনা। আমি ঠিক করলাম আমি সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাবো। নাহলে এই ভয় থেকে মুক্তির উপায় জানিনা।


লিলি আমাকে তার সাথে দেখা করতে বললো। মেয়েটা একটু অন্যরকম আর কথা যখন বলে খুব স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড ও। কিন্তু বেশ শীতল থাকে ওর কন্ঠ। আমার লিলির রহস্য ঘেরা বাড়িতেই যেতে ইচ্ছে করছিলো। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরদিনের। কিন্তু লিলি সেটা চাইলো না আর তাই আমরা ভার্সিটির কাছেই একটা ক্যাফেটোরিয়াতে বসলাম। সাধারণত এই ক্যাফেতে বেশ ভীড় থাকে। ওইদিন খুব ফাঁকা ছিল। লিলি আর আমি দুটো ফ্রোজেন হোয়াইট মোকা অর্ডার করে বসলাম সেখানে। আমার খুব ল্যাথার্জিক লাগছিলো। টানা অনেকগুলো রাত আমি ঘুমোতে পারিনি।

দাদী যেদিন মারা গেলেন সেদিন আমি বাসাতেই ছিলাম।  সত্যি বলতে এটার জন্য আমি একদম প্রস্তুত ছিলামনা। তারপর ও এটা হলো। বাবা মায়ের সাথে আমার সেভাবে বন্ডিং হয়নি কখনো। দাদীই আমার সব ছিল। তাই দাদী যখন চলে গেলো আমি তখন বুঝতে পারলামনা আমার কি করা উচিত। তুমি তো জানো দাদী আমাকে চোখে হারাতো তোমাকে এটা অনেকদিন বলেছি আমি।

আমি চুপচাপ লিলির কথা শুনতে লাগলাম। এরা কফিটা বেশ ভাল বানায়। সুক্ষ্ণ একটা কফির ঘ্রাণ এর জন্য ফ্রেশ লাগতে থাকে। আমার ক্লান্তি কিছুটা কমে আসছিলো যেন। হোয়াইট মোকায় বেশ চিনি থাকে। আমাদের ক্লান্ত মস্তিষ্ক অপেক্ষায় থাকে চিনির জন্য।  ব্রেইন নিডস সুগার। আজীজ স্যার কথাটা প্রায়ই বলেন।

দাদী মারা যাবার পর আমি বাবা মা কে জানালাম। এই স্বল্প সময়ে তারা আসতে পারলেননা। দাদী আমাকে নিজের কাছে রাখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। বাবা মা ও ঝাড়া হাত পা হয়ে ছিলেন। তাই দাদী মারা যাবার পর সব কিছু সামলালো বাসার ম্যানেজার, কেয়ার টেকার আর বাবুর্চি। আমি একা হয়ে গিয়েছিলাম। একাকীত্বের ভয় অনেক ভয়ঙ্কর জানো তো। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম এখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে আমি বাবা মায়ের কাছে চলে যাবো। সেদিন রাতে আমি প্রথম স্বপ্ন দেখলাম। ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট। তুমি জানো আগের দিনের মানুষ কেন স্বপ্ন সাদা কালো দেখতো?

আমি মাথা নাড়ি। আমি জানিনা এটা। কিন্তু আমার জানার আগ্রহ হচ্ছিলো।

লিলি তার ধীরস্থির কন্ঠে বলতে শুরু করলো-

বিজ্ঞানীরা ধারণা  করেন এই ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট স্বপ্ন দেখার পেছনে একটা কারণ ছিলো টেলিভিশন। ১৯৫৪ সালের আগে রঙ্গীন টিভি ছিলনা। তাই ঐ সময়ে মানুষের স্বপ্ন ও ছিল ধূসর। ১৯৫৪ সালের পর নাকি মানুষ রঙ্গীন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। আমি যদিও এটা পুরোপুরি জানিনা। কোথায় পড়েছিলাম মনে নেই। তো যা বলছিলাম- আমার স্বপ্নে প্রথমে শ্যামল মিত্রের গান ভেসে এলো কানে।

‘নাম রেখেছি বনলতা…’

আমি প্রায়ই গানটা শুনি খেয়াল করেছো নিশ্চয়ই। এটা আমার দাদীর সবচেয়ে পছন্দের গান ছিলো।  যাই হোক… তারপর দেখলাম রুবি কে। ও খুব আস্তে আস্তে হেঁটে আমার কাছে এলো। আমার কোলে বসলো। স্বপ্নের ভেতরই আমি টের পেলাম প্রচুর বাতাস হচ্ছে। আমি শুনতে পেলাম দাদীর কন্ঠ। আমাকে ডাকছেন লিলি লিলি বলে। কিন্তু আমি চারপাশে তাকালাম। দাদীকে কোথাও দেখতে পেলামনা। আমি হুট করেই বুঝতে পারলাম দাদীর কন্ঠটা আমার পর্যন্ত আসছে রুবির ভেতর থেকে। আমি অবাক হয়ে রুবির দিকে তাকালাম।। রুবি মাথা নাড়লো উপর নীচ। তুমি বুঝতে পারছো কি ঘটেছে? দাদী আসলে চলে যাননি। দাদী রয়ে গেছেন। রুবির মাঝে।

আমি বিব্রত এবং অবাক হয়েই রুবির দিকে তাকালাম। ও কি বলছে ও সম্ভবত নিজেও জানেনা। আমার মনে হলো আমার থেকে সাইকিয়াট্রিস্টের অনেক বেশি প্রয়োজন লিলির। যেন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলালাম আমি। লিলির আস্তে আস্তে কথা বলা। কোন বন্ধু না থাকা। লিলি আসলে মানসিক ভাবে সুস্থ নয়। ও নিজেকে কি ফ্রেন্ডস এর ফিবি বুফ্যের মতো ভাবে কিনা চিন্তা আসলো আমার মাথায় কারণ ফিবিও মনে করতো ওর পোষা বিড়াল আসলে ওর মৃত মা। তারপর ওই চিন্তা বাদ দিলাম। ওটা নিছক মজা ছিলো।  আর লিলি খুব বেশি টিভি সিরিজ দেখেনা। আমি লিলির দিকে তাকালাম। লিলি তখন ও বলে যাচ্ছে-

এই গল্প তোমার বিশ্বাস হবে না জানি। আমি খুব অল্প কয়েকজন মানুষকে জানিয়েছি এটা। বেশিরভাগ মনে করেছে আমি পাগল। যাইহোক আমি আর বাবা মায়ের কাছে চলে গেলামনা। কিন্তু এর মধ্যেই বাজে একটা ব্যাপার ঘটে গেলো। বাবা মায়ের ডিভোর্স। মা অন্য স্টেট এ চলে গেলেন। বাবার সাথে আমাকে ছাড়া কোন কথা বলেন না মা। আমি যখন যেতে চাইলামনা ওখানে বাবা ও মনে হলো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। আমি এখানে রয়ে গেলাম। দাদীর কাছে। আমার বাসায় বেশি বন্ধু আসলে দাদী এটা পছন্দ করেননা। প্রথমদিন দেখেছো তো কেমন তোমাকে চমকে দিয়েছিলো। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছো না তাইনা? আমি জানতাম এরকম কিছু একটা হবে। তাই বেশি কোন মানুষের সাথে এই কথা গুলি আমি শেয়ার করিনি। যাই হোক। তুমি আমার সাথে বাসায় চলো। আমি তোমাকে এমন কিছু দেখাবো যে তুমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে। চলো।

আমিও যেতে চাচ্ছিলাম। আমি জানি এটা নেহাত লিলির পাগলামি। ও না চাইতেও অনেক বেশি একা। তাই দাদীর মৃত্য ও মেনে নিতে পারেনি। তার মধ্যে বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ি। এই শান্ত মেয়েটা অল্প বয়সে অনেক কিছুর মুখোমুখি হয়েছে। আমার লিলির জন্য খারাপ লাগছিলো। আর আমার মনে হচ্ছে লিলির সাথে ওর বাসায় যাওয়াটাই ঠিক হবে। লিলি আমাকে যখন কিছুই দেখাতে পারবেনা। আমি ওকে বোঝাতে পারবো। লিলির এই বাসাটা থেকেও বের হওয়া উচিত। পুরোনো দিনের বাড়িটা মনের মধ্যে একটা প্রেসার ফেলে। আলো বাতাস আছে আর নতুন বাড়ি লিলির এমন কোথাও থাকা উচিত। পরিবেশ যে মনের উপর প্রভাব ফেলে তাতে তো কোন সন্দেহ নেই। তাই আমি মাথা নেড়ে লিলি কে জানালাম আমি যেতে চাই ওর বাসায়। লিলি উঠে দাঁড়ালো আর আমি ওর পিছু পিছু হাঁটলাম।

লিলির বাসায় যখন পৌঁছে গেলাম তখন গোধূলী সময়। কিছুটা মেঘ আছে। বাড়িটা আজ আরেকটু নির্জন লাগলো। লিলি বললো কেয়ারটেকার ছুটিতে গেছে। আমি কিছু অবশ্য জানতে চাইনি। ও কেমন প্রশ্নের আগেই জবাব দেবার ভঙ্গিতে বললো। লিলির সাথে দোতলায় উঠে এলাম। লিলির ঘরটাতেই বসবো। আমার একটু ভয় ভয় লাগছিলো। যদিও আমি জানি লিলি অসুস্থ। কিন্তু অতিপ্রাকৃত কিছু কি আসলেই দেখতে পাবো? যত যাই হোক শেক্সপিয়ার হ্যামলেটের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন-


There are many things in heaven and earth… 

লিলি ঘরে এসে গান ছেড়ে দিলো। ওর দাদীর পছন্দের গান। আমার কাছে জানতে চাইলো আমি কিছু খাবো কিনা। আমি ইশারায় মানা করলাম। মাত্র কফি খেয়ে এসেছি। সেই ঘ্রাণ মনে আর মুখে লেগে আছে। লিলি আমার পাশে এসে বসলো। বললো-

আমাদের এই বাড়িটা অনেক পুরোনো জানো তো? আমি ছোটবেলায় খেলতে খেলতে বাড়িটার কিছু রহস্য আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম। আজ তোমাকে দেখাবো।

আমি বললাম,

লিলি আমাকে কিন্তু তোমার অন্য কিছু প্রমাণ করার কথা। বাড়ির রহস্য নয়।

লিলি মৃদু হাসলো। বললো-

দাদী আর রুবির ব্যাপারটা কিন্তু বাড়ি ঘিরে। ওরা এর বাইরে নয় তো। তাইনা?

আমি হতাশ হয়ে মাথা নাড়লাম। লিলি বললো-

 ছাদে যাই চলো। ওখানেই তুমি প্রমাণ পাবে। রুবির ভেতর দাদী থাকেন।

লিলি আর আমি ছাদে এলাম। লিলিদের ছাদটায় প্রচুর গাছ। মানিপ্ল্যান্ট আর মনেস্ট্রা এক পাশের দেয়াল বেয়ে উঠে গেছে। এই জায়গাটা শীতল আর স্যাঁতস্যাঁতে। দেখে কেমন পুরোনো আএকটা আরামের কথা মনে পড়ে যায়। তার পাশে দিয়ে রেলিং দেয়া নেই। লিলি ঐ জায়গাটায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। লিলি সেদিকে এগুলো। বললো-

চলো ওখানে গিয়ে বসি। ঐ জায়গাটা সুন্দর।

আমার ও ইচ্ছে করছিলো। আমি মাঝেমাঝে ভাবি লিলির মত একটা জীবন  হলে আমি কি করতাম। এই তীব্র ঐশ্বর্য থাকার পর ও যে নির্লিপ্ত একাকীত্ব আমি কি কোনদিন ও মানিয়ে নিতে পারতাম। ভেবে ভেবে আমি অন্যমনষ্ক হই। আমার পা হড়কে যায়। হাত বাড়ালে লিলি আমাকে ছুঁতে পারতো। কিন্তু লিলি আমাকে ছুয়ে দেয়না। আটকানোর চেষ্টা করেনা। তিন তলার ছাদ থেকে পড়ে যেতে যেতে আমি ভাবি লিলি আমার সাথে এমন কেন করলো। লিলি নীচে ছুটে আসে। রক্তে ভিজে যাওয়া আমার পাশে বসে আমাকে আরেকটা গল্প শোনায়-

প্ল্যানটা ছিল অন্যরকম বুঝলে? তুমি ছাদে আসবে। রুবিকে দেখে ভয় পাবে। ভয় পেয়ে ছাদ থেকে তো পড়ে যেতেই পারো তাইনা? আমার কোন বন্ধু নেই। কেন নেই জানো? যে কয়েকজন কে আমি বন্ধু ভেবেছিলাম তারা কেউ মানতে চাইলোনা রুবির মাঝে দাদী বাস করেন। দাদী বললেন- ওরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে, পাগল ভাববে আমাকে। তুমিও তাই করলে। দাদীর কথা বলার সময় তোমাকে দেখে আমি বুঝে নিয়েছিলাম। আমার খারাপ লাগলো অনেক। তোমাকে আমি সত্যিই খুব কাছের ভেবেছিলাম…


চোখ বন্ধ হবার আগে আমি টের পেলাম লিলির রুবি ও ওর পাশে এসে বসেছে। ওর দৃষ্টিতেও অবাক বিস্ময়!