Posts

চিন্তা

ডানপন্থার বাড়াবাড়ি ও আমাদের চুপকথা

July 28, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

98
View

গঙ্গাচড়ায় এখনো কাটেনি আতঙ্ক। হাতে যা কিছু আছে, পোটলা বেঁধে তাই নিয়ে মানুষ এলাকা ছাড়ছে। শিশু, নারী ও বয়োজ্যেষ্ঠরা অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়েছেন। এ যেন রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার সংখ্যায় কম মানুষদের করুণ ও নীরব অভ্যুত্থান। আজকের খবরের কাগজগুলোয় বড় হরফে ছাপা হয়েছে ঘটনাটি। অথচ সরকারের উচ্চপর্যায় -প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব এ বিষয়ে একটি বিবৃতিও দেননি; যিনি অপ্রাসঙ্গিক বহু বিষয় নিয়ে সোশ্যাল হ্যান্ডেলে সরব থাকেন। সবার চেনা রাজনীতিক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতাদের টাইমলাইনেও নেই কোনো প্রতিবাদ, কোনো নিন্দা।

কিছুক্ষণ আগে শুনছিলাম এক প্রভাবশালী আলেমের ওয়াজ। মাওলানা মামুনুল হক নামটি কারো অজানা নয়। ভরা মাহফিলে গলার রগ ফুলিয়ে তিনকোটি হিন্দুকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, “তারা মাটির তৈরি স্বরস্বতী, দুর্গা, কালী, পাথর, গাছ, গরুর কাছে মাথা নত করে। এক আল্লাহর একত্ববাদ যাদের সহ্য হয় না -তাদের বিরুদ্ধে আমরা বলবই। তারা যেন ইন্ডিয়ার বর্ডার পেরিয়ে চলে যায়।”

মাহফিলে উপস্থিত মুরিদানেরা ‘হয়’ ধ্বনি দিয়ে সমর্থন জানালেন। এমন ঘৃণার রাজনীতিকে আমরা যে সম্মানিত করে চলেছি, তা স্পষ্ট হয় যখন দেখি, সংখ্যালঘুর ধর্মের প্রতি প্রকাশ্য বিদ্বেষ ছড়ানো এই বক্তার সঙ্গে দেশের প্রধান নির্বাহী রাজনৈতিক বৈঠকে বসেন হাসিমুখে। ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেন।

নবতিপর বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, “পাঁচ আগস্টের পর বাংলাদেশে ডানপন্থার উত্থান শুরু হয়েছে।” অপরদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পর্যন্ত এই উত্থান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অথচ আমাদের মূলধারার রাজনীতি -বাম কিংবা দক্ষিণ -উভয়ই এমন নীরবতা রক্ষা করে চলেছে, যেন 'ডানপন্থা' বলে দেশে কিছু নেই। যেন এটাই স্বাভাবিক। তারা যেন এটাকে 'হিরণ্ময় নীরবতা' ভেবে আত্মতুষ্টিই পাচ্ছেন!

রংপুরের গঙ্গাচড়ায় দিনকয়েক আগে এক অপ্রাপ্তবয়স্ক হিন্দু কিশোরের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া কিছু পোস্টের কারণে শুরু হয় উত্তেজনা। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলেও সহিংসতা থামেনি। পরপর তিন দফা হামলায় ওই কিশোরের বাড়িসহ ১৪টি হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়। লুটপাট হয়েছে টাকা ও স্বর্ণালংকার। দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান -একটি প্রাথমিক, একটি উচ্চ বিদ্যালয় -ছাত্রছাত্রী না থাকায় এখনো বন্ধ। কারণ, এই বিদ্যায়তনের অধিকাংশ শিক্ষার্থী হিন্দু। এই হামলাগুলো হয়েছে ‘ধর্মপ্রেমে’র নামে। অথচ সেটিই আজ মানবিকতার সবচেয়ে বড় সংকট। রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির চূড়ায় বসে থাকা ব্যক্তিরা এই বিষক্রিয়াকে অস্বীকার করেন। তাঁরা মনে করেন, এ দেশে র‌্যাডিক্যালিজম বা ফ্যানাটিসিজম বলে কিছু নেই; ডানপন্থা, ধর্মীয় উগ্রতা, এসব শুধু মিডিয়ার তৈরি বিভ্রম।

কিন্তু সত্য হলো -আমরা এক ভয়াবহ নীরবতার মধ্যে বাস করছি। একটি সমাজ তখনই বিপর্যয়ের দিকে এগোয়, যখন চুপ করে থাকাটাই তার সাংস্কৃতিক অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে রাষ্ট্রীয় মদদে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার, অন্যদিকে অসহায় সংখ্যালঘুদের দমিয়ে রাখার প্রবণতা -এই দুইয়ের সংমিশ্রণে আমরা তৈরি করেছি বিভেদের এক দানবীয় মানচিত্র।

আমরা যদি ধর্মকে রাজনীতির বাহন না করতাম, যদি ক্ষমতালিপ্সা আমাদের একমাত্র লক্ষ্য না হতো, তবে হয়তো ইনক্লুসিভ একটি মানবিক সমাজের স্বপ্ন আমরা দেখতে পারতাম। বৃক্ষের মতোই সর্বংসহা হতে পারতাম।

কিন্তু এখন আমাদের চারপাশজুড়ে শুধুই ঘৃণা, আড়ম্বর, মোহ ও ক্রমবর্ধমান স্বার্থপরতা। এই প্রবণতাই একদিন আমাদের চূড়ান্ত নিমজ্জনের পথে নিয়ে যাবে। এবং ভয়াবহ সত্যটি হলো -সেদিন আমাদের উদ্ধার করবার মতো একজন মানুষও আর কোথাও অবশিষ্ট থাকবে না।
প্রাচ্যকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ধর্মমোহ' কবিতায় যেভাবে এই অন্ধত্বের বিরুদ্ধে সত্যটা উচ্চারণ করেছেন প্রায় শতবর্ষ আগে, তা আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক:
ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।
নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,
শাস্ত্রে মানে না, মানে মানুষের ভালো।

লেখক: সাংবাদিক
২৮ জুলাই ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login