Posts

গল্প

আমার না বলা কথা।

July 29, 2025

Abdur Nur (R KING)

121
View

আমার নাম রায়ান। এই গল্পটা আমার না বলা কিছু কথা নিয়ে—যা আমি কখনো মুখে বলতে পারিনি, কিন্তু মনের গভীরে প্রতিটা নিঃশ্বাসে বহন করে গেছি।

নায়লা আমার বন্ধু ছিল, খুব সাধারণভাবে পরিচয় হয়েছিল স্কুলে। গ্রীন ভ্যালি হাই স্কুলের সেই করিডোর, যেখানে প্রথম দিনের ক্লাসে সবার ভেতর একটু একটু ভয়, একটু একটু কৌতূহল ছিল, সেখানে একজোড়া চোখ আমাকে টেনে নিয়েছিল—নায়লার চোখ। নায়লা আর আমি একসাথে প্রজেক্টে কাজ করতাম, কখনো গ্রুপ স্টাডি, আবার কখনো মেলা বা ক্লাস পার্টির আয়োজন। ধীরে ধীরে আমরা একে অপরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠি। কিন্তু মনের ভেতরে যে অনুভূতিটা দানা বাঁধছিল, সেটা কোনোদিন বলিনি। কারণ, বন্ধুত্ব ভাঙার ভয়টা ভালোবাসার চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিল।

নায়লা ছিল সেই মানুষ, যার সাথে নীরবতাও সুন্দর লাগত। ক্যান্টিনের সামনের পুরনো বেঞ্চটা যেন আমাদের জন্যই ছিল। প্রতিদিন বিকেলে আমরা সেখানে বসে থাকতাম, কোনোদিন কথা না বলেও ঘন্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতাম।

স্কুলজীবনের শেষ দিন, মিলন মেলা। সবাই একে অপরকে শুভকামনা জানাচ্ছে, কেউ কেউ হাসছে, কেউ চোখ মুছছে। আমি জানতাম, এটা আমাদের শেষ দিন। নায়লার পাশে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ বুকের ভেতর সব সাহস জমা করে বললাম,
“নায়লা… আমি তোমাকে অনেকদিন ধরে পছন্দ করি।”

নায়লা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমি জানতাম রায়ান। আমিও তোমাকে পছন্দ করতাম। কিন্তু আমি পারবো না...”

আমি অবাক। “কেন?”

নায়লা চোখ নিচু করে বলল, “আমার পরিবার আমাকে কানাডায় পাঠাচ্ছে উচ্চশিক্ষার জন্য। আমি চাই না আমার যাওয়ার আগে আমাদের মাঝখানে এমন কিছু হোক, যা আমাকে কষ্ট দেবে বারবার। দুঃখ দিও না আমাকে, রায়ান...”

আমি কিছু বলিনি। শুধু মুচকি হেসে বলেছিলাম, “তোমার জন্য প্রার্থনা করব।”

সেই ছিল আমাদের দেখা হওয়ার শেষ মুহূর্ত। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি এত সহজে সম্পর্কটা থেমে যাবে।

কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। আমি নিজেও পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে একবছর পর কানাডা চলে যাই। সেখানে আমি ভর্তি হই Maplewood International Academy-তে। নতুন বন্ধু, নতুন শহর, কিন্তু মনটা তো আর নতুন হয় না। পুরোনো স্মৃতি গেঁথে থাকে প্রতিটি সকালে, প্রতিটি রাতে।

ঠিক তখনই, এক বিকেলে হোস্টেলের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখি সেই চেনা মুখ। নায়লা।

আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সে বলল, “তুমি যাচ্ছো শুনেই আর থাকতে পারলাম না। আমি ফিরে এসেছি, রায়ান।”

আমাদের সম্পর্কটা যেন নতুন করে শুরু হলো। আমরা একসাথে পড়তাম, সময় কাটাতাম, পার্কে যেতাম, সিনেমা দেখতাম। আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম আগের সেই অপ্রাপ্তি। জীবনের সবটুকু আলো ফিরে এসেছিল নায়লার সাথে।

কিন্তু সুখ কখনো স্থায়ী হয় না। কিছুদিন যাবত শরীরটা ভালো লাগছিল না। মাথা ঘোরা, হঠাৎ ক্লান্তি, ওজন কমে যাওয়া। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার জানাল, আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত।
তিনটে শব্দ। কিন্তু সেগুলো যেন পুরো জীবনটাকে গিলে খেল।

আমি অনেক ভেবেছিলাম, বলবো কি না নায়লাকে। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম—তাকে ভালোবাসি বলেই কিছু বলবো না। আমি চাই না সে আমাকে দেখে ভেঙে পড়ুক।

নায়লা একদিন হঠাৎ রেস্টুরেন্টে আমাকে বলল,
“রায়ান, আমি ভাবছি... আমরা কি বিয়ে করতে পারি? আমি আর এই অপেক্ষা সহ্য করতে পারছি না।”

আমি চুপ করে ছিলাম। তারপর বললাম,
“তুমি পাগল নাকি? আমি তোমাকে চাই না। আমি তোমার জীবনে বোঝা হতে চাই না। ভালোবাসা করলেই কি জীবন চলে?”

নায়লা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। জানি, ও বুঝেছিল আমি মিথ্যে বলছি। কিন্তু তাও কিছু বলেনি। শুধু চলে গিয়েছিল... আমার ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে।

তিন মাস পর, আমি মারা গেলাম।

আর এই মুহূর্তে, আমার চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে শেষ যে ছবিটা আমার মনের পর্দায় ফুটে উঠেছিল, তা ছিল নায়লার মুখ।

আজ অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। আমি জানি না সে এখন কেমন আছে। তবে আমি জানি, সে একদিন আমার কবরের সামনে দাঁড়াবে, এবং বলবে—

“তুমি আমার সব ছিলে। আর এখন, তুমি আমার সব না বলা কথার স্মৃতি।”

Comments

    Please login to post comment. Login