মায়া গন্ডি
পর্ব ৫
✍️ মোহাম্মদ নূর
চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক তীব্র হচ্ছে। ধীরে ধীরে চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে—যেন চাঁদেরও এই দৃশ্য দেখে ভয় লাগছে।
ঐশ্বর্য জানালা খুলে দেখতে পেলো, রহমান বাড়ির প্রধান দরজার সামনে কেউ একজন হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আরেক হাতে রামদা।
হারিকেনের আবছা আলোতে যতটুকু বোঝা যায়, এটি আর কেউ নয়—তার দাদু!
ঐশ্বর্য সাহস করে এক ঝটকায় জানালাটা বন্ধ করে দিল।
তারপর জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল, যেন হাপানির রোগে আক্রান্ত। এক সময় আর কিছু করার সাহস পেল না, সোয়ার জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
ভয়ে সারা রাত ঘুমাতে পারেনি।
হঠাৎ কাকডাকা ভোরে খেয়াল করলো, সে নামাজ পড়তে পারেনি। তার খুব খারাপ লাগলো।
গত রাতের কথা মনে পড়তেই চিন্তায় পড়ে গেল। ভাবতে লাগলো—
“দাদু কেন জানালায় টোকা দিলেন? আর রামদা নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন? তিনি কি আমাকে আঘাত করতে চেয়েছিলেন?”
এ কথা ভাবতেই মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। মা বলেছিলেন,
“একসময় তোমার দাদু তোমাকে পছন্দ করতেন না।”
এসব ভাবতে ভাবতে ঐশ্বর্য পিছনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
সূর্য উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সুপারি গাছগুলো স্থির—যেন কোনো জাদুঘরের নিদর্শন।
ঐশ্বর্য একবার নদীর দিকে তাকালো। তার মনে হলো, নদীর ধারে কিছু একটা আছে, যা তাকে বারবার আকর্ষণ করে।
প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে দাঁড়িয়ে মনে হলো—প্রকৃতি যেন তার পূর্ণতা খুঁজে পেয়েছে।
আকাশ ধীরে ধীরে রঙ পরিবর্তন করছে। সূর্য ওঠার আগেই যেন বাতাস ভারী হয়ে এলো।
ঐশ্বর্যের ভেতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
তার মনে ভীষণ এক কষ্ট—৮ বছর আগের সেই ঘটনা মনে পড়ে গেলো।
আবেগে মাথার কাপড়টা খুলে ঘাড়ে ফেলে দিল।
আকাশ একদম অন্ধকার হয়ে এলো।
বাতাসের সঙ্গে গাছের পাতায় লেগে আসা শাঁ শাঁ শব্দ, মিষ্টি এক ঘ্রাণ—সব মিলিয়ে যেন প্রকৃতি ঐশ্বর্যের জন্যই অপেক্ষা করছিল।
ঐশ্বর্য চোখ বন্ধ করে উপরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
খোলা চুল, হালকা সবুজ থ্রিপিস, গলায় সাদা ওড়না—তার সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়ে রইলো প্রকৃতি।
কিন্তু আজ তারও মনে হলো, কেউ একজন বাগানের ভেতর থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।
বেশি কিছু ভাবার আগেই সে খেয়াল করলো—বাঁদিকের সরু পথ দিয়ে কেউ একজন দৌড়ে আসছে।
ঠিক তখনই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো।
ঐশ্বর্য বুঝে উঠতে পারছিল না—লোকটি কি বিপদে আছে?
তাকে সাহায্য করা উচিত, না কি ঘরের ভেতরে চলে যাওয়া উচিত?
লোকটি একদম কাছে এসে পৌঁছাতেই বোঝা গেলো, তিনি এস.পি. আকাশ।
সে এতক্ষণ ঐশ্বর্যের সৌন্দর্য উপভোগ করছিল দূর থেকে।
সে এতটাই মগ্ন ছিল যে, বৃষ্টি শুরু হওয়ারও খেয়াল ছিল না।
ঐশ্বর্য তৎক্ষণাৎ মাথায় ওড়না দিয়ে লম্বা ঘোমটা টেনে নিলো।
আকাশ দৌড়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো।
ঐশ্বর্য চমকে গেলো।
সে বুঝতে পারছিল না কী করবে। তাই ঘুরে ভেতরে চলে আসতে যাচ্ছিল, তখনই আকাশ বলল,
“শুনেন, আমাকে একটু সাহায্য করুন। আমি পুরো ভিজে গেছি।”
ঐশ্বর্য কিছু না বলেই ভেতরে চলে গেলো।
আকাশ জোরে বললো—
“যাহ বাবা! সাহায্য করবে না কিনবা হ্যাঁ—কিছুই তো বললো না! একটু বসার মতো একটা চেয়ারই দিতেন!”
ঐশ্বর্য দরজার ফাঁক দিয়ে এক হাতে একটা গামছা আর আরেক হাতে একটা চেয়ার দিয়ে দিলো।
ঐশ্বর্য খেয়ালই করেনি—এত সকালে নদীর ধারে আকাশ কী করছিলেন!
ঘরে ফিরে সে ভাবতে লাগলো।
শেষমেশ সে আবার গিয়ে দারালো দরজার পাশে।
আকাশ তখন সেই সবুজ প্রাকৃতির মাঝে এক সবুজ পরিকে দেখার কথাই ভাবছিলো।
ঐশ্বর্য দরজা টেনে বন্ধ করে পেছন থেকে ডেকে উঠলো—
ঐশ্বর্য: “শুনছেন?”
আকাশ কল্পনার জগৎ থেকে ফিরে বললো— “কে?”
: “আমি ঐশ্বর্য।”
আকাশের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
আকাশ: “আপনিই কি সেই সবুজ পরি?”
ঐশ্বর্য: “জি? কি বললেন?”
আকাশ: (নিজের মাথায় একটা টোকা দিয়ে বলল)
“আপনিই কি সেই—যাকে কালকে দেখেছিলাম? আর আজকে আমাকে গামছা আর চেয়ার দিলেন?”
ঐশ্বর্য: “হুমম।”
আকাশ: “আপনার গলার স্বর তো অনেক মিষ্টি।”
ঐশ্বর্য হেসে বললো—
“ধন্যবাদ। তবে আমার কাছে সবার কণ্ঠই সুন্দর মনে হয়।”
আকাশ: “হ্যাঁ ঠিক আছে, কিন্তু আপনারটা একটু বেশিই সুন্দর।”
ঐশ্বর্য জিজ্ঞেস করলো—
“আপনি এত সকালে নদীর ধারে কী করছিলেন?”
আকাশ: “আজ আমার ডিউটি ছিলো নদীর পাশে।
কাল রাত থেকেই আমি কালীঘাটে ডিউটিতে ছিলাম।
কিন্তু গ্রামের মানুষ ওখানে যেতে দেয় না, তাই বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
মাঝরাতে একটা ঘটনার সূত্রে এদিকে আসা হয়।”
এ কথা বলে আকাশ চুপ করে গেলো।
ঐশ্বর্যের তখনই মনে পড়ে গেলো—গত রাতের ঘটনা।
সে জিজ্ঞেস করলো—
“কি হয়েছিল?”
আকাশ: “না না, কিছু না। আপনি এসব ভাববেন না।”
ঐশ্বর্য জোর করতে লাগলো।
কারণ, তাকে জানতেই হবে এই গ্রামে কী হচ্ছে!
কেনই বা তার দাদু বাড়ির পেছনে যেতে নিষেধ করেছিলেন!
শেষমেশ আকাশ বললো—
আকাশ: “আচ্ছা ঠিক আছে, বিকেলে আমার সাথে এখানে দেখা করুন। তখন সময় নিয়ে সব বলবো।”
ঐশ্বর্য: “না, এখন বলুন। আম্মাই জানলে আমাকে বকা দিবে।”
আকাশ: “আচ্ছা, তাহলে শোনেন—…”
.
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
পর্ব ৬ আসছে খুব শিগরই । পাশে থাকুন। ধন্যবাদ।