মায়া গণ্ডি
.
পর্ব ৭
.
মোহাম্মদ নূর
.
আজ ক্লাসে শুধু হুমাইরা এসেছে, কিন্তু ওর মন খারাপ করে বসে আছে। তাই ঐশ্বর্য জিজ্ঞেস করল—
“কিরে হিমু, তোর কী হয়েছে? কথা বলিস না কেন আমাকেও বলবি না?
হুমাইরা বলল—
“কাল রাইত থিকে আমার আব্বায় বাসায় আইছেনা। সারাটা গেরাম তারে খুঁজছি।”
ঐশ্বর্য চমকে গেলো, ভাবতে লাগল এক রাতে কত কী ঘটতে পারে!
সে বলল—
“হিমু, কী হয়েছে? খুলে বলবি?”
হুমাইরা বলল—
“গতকাল আমি না কইছিলাম, আব্বায় কালি ঘাটে ভুত দেখছিল। তাই তার জ্বর উঠেছিলো। চাইর দিন বিছানায় পইরা আছিলো, উঠতে পারতাছিলো না।
কাল স্কুল থেকে বাসায় এসে হুনলাম, আব্বায় হঠাৎ কাউরে কিছু না বইলা বাড়ি থেকা বাইরায়া গেছেগা। সারারাত মা ঘুমায় নাই। এর আগেও আব্বায় রাতে বাড়ি আহে নাই, কিন্তু আম্মারে কইয়া যাইতো। জ্বর নিয়া শরীরটা দুর্বল আছিল, তারপরেও বাড়ি থিকা বাইরায়ে গেছে। এহনো কোনো হদিশ নাই।”
কান্না শুরু করল হুমাইরা। ঐশ্বর্য মাথায় হাত বুলিয়ে বলল—
“ভয় পাস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ঐশ্বর্য বুঝতে পারল, হুমাইরার বাবার নিখোঁজ হওয়ার পিছনে কালি ঘাটের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। এইটা ওর মনের ভুল। আবার এমনো তো হতে পারে কেউ ইচ্ছে করে ওর বাবা কে কালিঘাটেই আটকে রাখছে। তাই হবে হয়তো।
কল্পনা থেকে বেরিয়ে ঐশ্বর্য বলল—
“তোর বাবাকে ফিরিয়ে আনতে চাস?”
হুমাইরা বলল—
“কেমনে?”
ঐশ্বর্য বলল—
“আগে বল, আমি যা বলবো তাই করবি।”
হুমাইরা বলল—
“ঠিক আছে, কিন্তু আগে ক কি করতে হইবে।”
ঐশ্বর্য বলল—
“তকে একটা চিঠি দিবো, এটা একজনকে দিয়ে আসবি।”
হুমাইরা জিজ্ঞেস করল—
“কারে?”
ঐশ্বর্য বলল—
“আগে বল, অন্য কাউকে বুঝতে দিবি না যে এটা আমার লেখা। যাকে দিবি শুধু সে যেনো জানে।”
হুমাইরা বলল—
“আইচ্ছা, কারে দিতে হইবো?”
ঐশ্বর্য চিঠিটা লিখে বলল—
“বাসায় যাওয়ার আগে থানায় যাবি। নতুন এস.পি এসেছে, তাকে এটা দিবি। আমি বাসায় গিয়ে দাদুকে পাঠাচ্ছি।”
হুমাইরা অবাক হয়ে বলল—
“তুই কি তারে চিনস?”
ঐশ্বর্য বলল—
“চিনি না, কিন্তু উনি কালি ঘাটের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। কালকের দুই লাশটি নদীতে ফেলার মামলাটাও উনিই সামলাচ্ছেন। হয়তো উনি কিছু সাহায্য করতে পারবেন।
চিন্তা করিস না আমি তোর পুরোপুরি সাহায্য করবো।
হুমাইরা বুঝতে পারল এবং বলল—
“এইসব করলে কি আব্বায় ফিরা আইবো?”
ঐশ্বর্য বলল—
“এখনো আসল কাজ বাকি। তোকে সন্ধ্যা সময় আমার সঙ্গে দেখা করতে হবে।”
হুমাইরা বলল—
“আইচ্ছা, আমি তোর বাসায় যাবো। আব্বায় কি তোর বাসায় আইবো?
ঐশ্বর্য বিরক্ত হয়ে বলল—
“আহ, তোকে বলছি দেখা করতে বলছি।
কখন বললাম তোর বাবা আমাদের বাসায় আসবে!”
হুমাইরা কাদতে কাদতে বলল—
“তাইলে কী করতাম? একটু খোলাখুলি ক।”
ঐশ্বর্য হুমাইরার হাত ধরে বলল—
“শুন, বাবাকে ভালোবাসিস তো?”
হুমাইরা বলল—
অনেক।”
ঐশ্বর্য বলল—
বাবার জন্য যদি মরতে হয়, পারবি?
হুমাইরা ভয় পেয়ে গেলো।
ঐশ্বর্য চোখ বন্ধ করে বলল—
“যতোটা বলছি, ততটার উত্তর দে। বাইরে কিছুই বলিস না।”
হুমাইরা বলল—
আমি পারব, আব্বার জন্য মরতে।”
ঐশ্বর্য বলল—
“এইটাই শুনতে চেয়েছিলাম। আর কোনো দিন এসব কথা বলিস না, পাপ হবে। আমি শুধু পরীক্ষা করছিলাম তোকে। আমি যা করতে চাইছি, তাতে তুই প্রস্তুত কিনা।”
হুমাইরা কিছুই বুঝতে পারল না।
ঐশ্বর্য বলল—
“তুই কিছু বুঝলি নাতো বুঝতে হবে না। শোন, তোর মরতে হবে না। তুই আজ সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে কালি ঘাটে যাবি।”
হুমাইরা আতকে উঠলো, বলল—
“কি! এইসন কী কইতাছস? আমি তো ওইহানে যেতে পারুম না, ওইহানে আদমখুর ভূত থাহে।”
ঐশ্বর্য বলল—
বাবার জন্য মরতে পারবি, কালি ঘাটে যেতে পারবি না?
হুমাইরা চুপ করে গেল।
দুজনের মধ্যে নিরবতা বিরাজ করল।
নিরবতা ভেঙে হুমাইরা বলল—
“কালি ঘাটের সঙ্গে আব্বার নিখোঁজ অওয়ার কী সম্পর্ক?”
ঐশ্বর্য কিছু বলল শুধু চুপ করে থাকতে বলল।
হিমাইরারো আর কছু বলার নেই কেনোনা সে ঐশ্বর্যর বিদ্ধির সম্পর্কে অবগত।
আসলে - ঐশ্বর্যের বুদ্ধি ছোট থেকেই ভালো ছিল। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছে ছিল পুলিশ হওয়ার, যদিও একসময় সে ইচ্ছাটা আর থাকে না। কিন্তু পুলিশদের গল্প শুনে, তাদের মত চিন্তা-চেতনা তার মধ্যে বাসা বেঁধেছিল।
ঐশ্বর্য বলল—
শোন, এখন পর্যন্ত যারা দাবি করেছে কালি ঘাটে ভুত দেখেছে, হয়তো তারা পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নয়তো কিছুদিন পর তাদের লাশ কালি ঘাটের পাশে ভাসতে দেখা গেছে।
হুমাইরা কিছু না ভেবেই কেঁদে উঠল।
ঐশ্বর্য বলল—
“শোন, আমি যা বললাম তাই কর। এই কাগজে সব লেখা আছে। শুধু এটা সন্ধ্যায় তাকে দিবি। এরপর আমাদের বাসায় এসে দেখা করবি। আমি তখন আম্মাকে রাজি করিয়ে নেবো আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য।”
হুমাইরা বলল—
“তোর মা রাজি হবে?”
ঐশ্বর্য বলল—
“রাজি না হলে তুই একা যাবি।”
হুমাইরা চোখ বড় বড় করে তাকালো।
ঐশ্বর্য বলল—
হেসে দেয় আর বলে ভয় পাস না। আমি কিছু একটা বলে আম্মাকে রাজি করিয়ে নিবো। আগে তুই এই কাজটা কর।”
সাল ১৯৯১
বর্তমান-
সাহিনা এবার খেয়াল করলো মেয়েটির চোখ দিয়ে আবার পানি পড়ছে। ঐশ্বর্য, একবার কাঁদে, আবার ভয়ে চুপ হয়ে যায়। এখন পর্জন্ত তার মুখে হাশি দেখতে পেলো না।
ঐশ্বর্য বলল—
“আমাকে একটু ঘুমতে দিবেন? আমি তিন দিন ধরে চোখের পলক ফেলতে পারিনি।”
সাহিনা বলল—
“এভাবে বলছ কেন? আমি তো তোমার মায়ের মতোই।”
ঐশ্বর্য জোরে হাসতে লাগল, বলল—
“পৃথিবীতে আমার জন্য মা এজনি (শান্তি) তাকে ‘মা’ বলে ডাকতে পেরে আমি ধন্য।”
সাহিনা বলল—
বোকা মেয়ে আচ্ছা যাও আমি তুমার মায়ের জায়গা নিলাম কিন্তু আমি তুমার মায়ের মতো ভালোবাসা দেওয়ার চেষ্টা অবশ্যই করবো
“তুমি ঘুমাও, আমি বাইরে দেখে আসি।”
এই বলে চলে গেল।
নজরুল গ্রামে পৌঁছেছে। গ্রামীণ রাস্তায় দুজনকে বাজারের পথ জিজ্ঞেস করলে তারা দেখিয়ে দেয়। কিন্তু কালি ঘাটের কথা বললে সবাই চোখ বড় করে দেয় কিছু বলে না এবং চলে যায়।
নজরুল একজন লোককে জিজ্ঞেস করলো—
এইযে ভাইসাব
কালি ঘাটের রাস্তা কোনদিকে?
লোকটি ভয় পায় না, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
নজরুল অবাক ও খুশি হয়।
সে জিজ্ঞেস করলো—
“আপনি বাকি সবার মতো ভয় পাননি কেন?”
লোকটি উত্তর দিল—
“ডারনির কী আছে! মরবো আরেকজন! আমি কেন ডরাইতাম ?”
নজরুল একটু সংকোচ হয়ে বলল—
“এটা কী বললেন?”
লোকটি বলল—
“আপনারা কালি ঘাটে কী করবেন? ওইহানে মানুষ মরে।”
নজরুল জিজ্ঞেস করলো—
“আপনি কি কালি ঘাট সম্পর্কে জানেন?”
লোকটি বলল—
“আমি কিছুই জানি না। আমি গাঁয়ের নতুন লোক। আগে কালি ঘাটে যাওয়াটা নিষেধ ছিল। এখন যেতে দেয়, কিন্তু সময় পাই না। তাই যাই না। কিন্তু ওইহানে না যাওয়া ভালা।”
“আর যদি কিছু জানতে চান, লতিফ কাকার কাছে যান। আইজ পর্যন্ত কালি ঘাটের সব ঘটনা হেতি জানে।”
নজরুল জিজ্ঞেস করলো—
“লতিফ মিয়া কোথায় থাকেন? আমি তার কাছ থেকে জানতে চাই।”
নজরুল বুঝলো লতিফ মিয়াকে পেতে হলে কালি ঘাটের পারেই যেতে হবে। তাই সে আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেল।
অনেক খুঁজে শেষে লতিফ মিয়াকে পেল।
নজরুল বলল—
“কি লতিফ চাচা, ভালো আছেন?”
লতিফ বলল—
“কিছু খাইতে দে, আমার ক্ষুধা লেগছে।”
নজরুল তার জন্য রুটি আর তরকারি বের করল।
লতিফ রাক্ষসের মতো খেতে শুরু করল আর বলল—
“তোমাদর মতো মানুষ নাই গাঁয়ে। তোরা খুব ভালা মানুষ।”
নজরুল হাসতে হাসতে বলল—
এইটা আমার মায়ের হাতে বানানো রুটি
“আইচ্ছা কাকা, তুমি কি আমাকে কালি ঘাটের বিষয়ে কিছু বলতে পারবে?”
লতিফ খাবার বন্ধ করে দেয় কিছুক্ষন থমকে তাকিয়ে থেকে একঝটকায় পানি দিয়্র হাত ধুয়ে বলল—
“দেখ, এই ঘাট সম্পর্কে জানতে চাইস না। ওইহানে আদমখুর আছে।”
এ কথা শুনে নজরুল রেগে গেল,
“কি আদমখুর? আদমখুর লাগাইছেন! মিয়া আপনারা সব ভুয়া বলেন মনে হয়।”
লতিফ ভয়ংকর হাসি দিয়ে বলল—
দেখবি, দেখবি দেখবি দেখবি
আই“আই আমার সাথে।”
তারা রওনা দিল। লতিফ মিয়া সামনে একাই হেঁটে যাচ্ছে, লাঠিতে ভর করে। গায়ে খয়েরি রঙের চাদর। পিছনে সবাই হাটছে।
লতিফ বলল—
“ঘাট দেখতে আইছে আই আইজ সব দেখামু আই।”
কিছুটা পথ যাওয়ার পর লতিফ মিয়া দাড়িয়ে পড়ল,
“আমি এর আগে যাইতে পারতাম না, তোরা যাইতে পারলে যা।”
নজরুল দেখলো একটি পরিত্যক্ত স্থান। ঘণ জঙ্গল বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হচ্ছে কিন্তু ওখানে কোনো আলোই আসছে না। নদীর ওপর এখনো কুয়াশা।
ঘাট থেকে নদীর ওপর কিছুই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না।
গেইটের সামনে একটি বিশাল বড় বটগাছ, যা একমাত্র প্রাণধারী গাছ। তার নিচে যেনো অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে।
ঘাটের চারপাশে কাটা তার দিয়ে আটকে রাখা।
ঘাটের মূল রাস্তায় একটি পুরনো বিশাল কাঠের গেইট, উপরে বড় করে লেখা— ‘কালি ঘাট’।
নজরুল একটু জোরে বলল—
“এই জায়গার নাম শুনে ভয় পেতাম না, কিন্তু আজ দেখে এর নামটাও মৃত্যু পুরি মনে হচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম এটা অনেক ভয়ংকর, কিন্তু আমি ভুল এটা আমার ধারনার থেকেও ভয়ংকর।”
সবাই ভয়ভীতি নিয়ে ঘাটের দিকে তাকিয়ে আছে।
,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন পর্ব ৮ জলদি আসবে পাশে থাকবেন ও এই পর্জন্ত থাকার জন্য ধন্যবাদ।
.
পরের কিছু এপিসোড গুলো স্পেশাল কেউ মিস করবেন না। আর আপনাদের কি মনে হয় কালি ঘাটের রহস্য উদঘাটনের সময় কি এসে গেছে?