
পর্ব- ৯: নদীর মতো কতো পথ ঘুরে
খালা সেদিন কাহিনী শেষ না করেই উঠে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় একটা বড়ো ঘোমটা টেনে নিলেন প্রায় পুরো মুখ ছায়ায় ঢেকে দিয়ে। হয়তো গান শুনে মনে পড়া সহোদরের স্মৃতি আর সেইসব স্মৃতিঘেরা অফুরান দুঃখনদী সেদিন তিনি আর কাউকে দেখাতে চান নাই। আজকেও হয়তো অপমানে মুষড়ে পড়া চেহারা তিনি সাবধানে লুকিয়ে রাখছেন। চোখে আগুন পানি যাই থাকুক আমাদের কাউকে তা আর কোনদিন দেখাতে চান না। চুরির দায় নিয়ে তিনি সেদিন রাত নয়টায় হোস্টেল ছেড়ে গিয়েছিলেন, পুরোপুরি নিঃশব্দে। ঐদিনের পর আমি আর মাস চারেক ছিলাম রাজশাহীতে, খালার সাথে একবারও দেখা হয় নাই। যদিও বাসার গলি চিনতাম কিন্তু কিছু বলতে যাওয়ার সাহস হয় নাই।
যেদিন ঢাকার বাসে উঠলাম, আষাঢ় মাসের শেষ দিন ছিল বোধহয়। সকাল থেকে সূর্যের দেখা নাই। অবশ্য রাস্তাঘাট তখনও শুকনা। গতকালের বৃষ্টির ছিটেফোঁটাও কোথাও অবশিষ্ট ছিল না। বৃষ্টি নামলো আরো ঘন্টা তিনেক পর। যমুনা সেতুতে ওঠার মিনিট দশেক আগে একেবারে মুষলধারে শুরু হলো। সেতুর দুই পাশে অস্পষ্ট ঢেউ। বাতাসের ঝাপটায় মনে হচ্ছে বাসের জানলা ভেঙে যাবে। ছাদের উপর আমার শখের বুক শেলফ ভিজছে। ভিজুক। কিছু মায়া অনায়াসে ফুরিয়ে যাওয়াই ভালো।
বেতের শেলফটা আমার প্রেমিকা, বিগত বলাই ভালো, কিনে দিয়েছিল আমাকে প্রথম “তুমি” করে বলা উপলক্ষে। ওদের এলাকা ঘুরে আসার পর সপ্তাহখানেক পর আমাকে সাতশ টাকা পাঠিয়েছিল মনি অর্ডার করে। শেলফ কিনতে গিয়েছিলাম আমি একাই। ওল্ড গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে পাঠানপাড়া যাওয়ার পথে বেতের দোকানগুলো হাতের ডানে পরে। উপহার কিনে হোস্টেলে ফেরার পর থেকে অনন্য এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছিল। আমাদের ফোনে কথা বলার প্রধান বিষয় ঐ সপ্তাহে হয়ে উঠেছিল বই। কোন তাকে কবিতা, কোনটাতে উপন্যাস ইত্যাদি তুচ্ছ বিষয় আলাপ করতে করতে, এমনও হয়েছে, ঘণ্টা পার হয়ে গেছে।
গুণে গুণে দেখলাম ঠিক বিয়াল্লিশ দিন আগে আমাদের শেষ কথা হয়েছিল। শেষ দেখা আরো বহু দিন আগে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, শেষ দেখার শুরুতেই আমি বিরহের পূর্বাভাস পেয়েছিলাম, কীভাবে কোন ইঙ্গিতে জানি না।
সেদিন বাস থেকে নেমেই দেখি সে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে সব শক্তি জড়ো করে শব্দ করে হেসে উঠলো। টার্মিনাল ভর্তি মানুষের চোখ এড়িয়ে আমার হাত ধরে থাকলো মিনিট দুয়েক। এরপর আমরা সিরাজগঞ্জ শহরে ছড়িয়ে পড়লাম। বড়োপুল, স্টেশন, বাহিরগোলা ইত্যাদি বহু জায়গায় কখনো আত্মীয় পরিচয়ে, কখনো বন্ধু- আমরা দুইজন একসাথে সবচেয়ে প্রাণবন্ত বিকেল কাটালাম সেদিন। কিন্তু এতো কিছুর পরেও কোনো এক অনিবার্য শূন্যতা টের পাচ্ছিলাম আমি। দুইজনের মাঝখানে অদৃশ্য কোনো দেয়াল উঠছে যেন ক্রমশ। কিন্তু জিজ্ঞেস করার মতো কোনো সুযোগ সে রাখে নাই।
আমি মনের দ্বন্দ্ব মনের হাতে সড়িয়ে রেখে ওর অভিসার উদযাপনের সঙ্গী হলাম। একান্ত অনুগত শরীর এরপর ভালোবাসার দমকা হাওয়ায় দুলতে শুরু করলো। মাগরিবের আজান শেষ হতেই একটা রিকশা নিয়ে আমরা সোজা শহর রক্ষা বাঁধের দিকে চললাম। বাঁধ জুড়ে পার্ক বসে গেছে। মানুষের ভিড় যদিও কমতে শুরু করেছে, তবু মূল বাঁধে আমরা সুবিধাজনক বসার জায়গা পেলাম না। নদীর পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা হাইস্কুলের সামনে এসে খুঁজে পেলাম পুরোপুরি নির্জন এক মাঠ। ভরা যমুনার বাতাসে মাঠের দুইপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুপারি নারকেলের গাছগুলো একবার নুয়ে পড়ে আবার ভেসে উঠছে। পেছনে কালো আসমান। কালবৈশাখী উঠে আসলে এই মুহূর্তে উপায় কী?
দুশ্চিন্তায় তলিয়ে যাওয়ার আগেই ও এসে হাত ধরলো আরো একবার। অন্ধকারে এইবার শক্ত করে। ওর পুরো খেয়ালে কেবল আমিই তখন। বাতাসের তোড়ে বুক থেকে ওড়না উড়ে গেল দূরে। অবাক হয়ে দেখলাম সেদিকে মেয়েটা ভ্রুক্ষেপ করলো না কোনো। সব ভুলে আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিল আর আমার অন্তরে শুরু হলো যমুনার ভাঙন। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থেকে অস্ফুট একটা স্বর ভেসে এসে আমাকে সাবধান করে গেল। কিন্তু আমি তখন বিচার-বুদ্ধিহীন জগতের বাসিন্দা। প্রেম নামক নেশার ঝড়ে উথাল পাতাল দুলছি। নিজের ঠোঁট, চুল, বুক, বাহু কোথাও আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। আমার খোলা পিঠ আর হালকা গোঁফের রেখায় ওর আঙ্গুলের চলাচল থেমে গেলেও আমি নিজেকে থামাতে পারলাম না। অন্ধকারেও বুঝলাম ও চোখ বন্ধ করে আছে। ঘন নিঃশ্বাস। কোনো কথা না বলে আমার উষ্ণতা মেনে নিল আরো পাঁচ মিনিটের মতো। তারপর হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে আমার শরীর-মনকে ফেলে দিল ধুলাবালিময় ঘাসের উপর। টিমটিমে টর্চের আলোয় একটু পর আমার শার্ট-/ছেঁড়া বোতাম আর ওর ওড়না খুঁজতে খুঁজতে আমরা একেবারে নদীর কোলে নেমে গেলাম। অর্ধেক ভেজা ওড়নাটা খুঁজেও পেলাম। সাধ্যমত পানি ঝরিয়ে কাপড়টা ওর গায়ে জড়াতে জড়াতে দুইজন বাঁধে উঠে আসছি। নদীর দিকে পিঠ, চোখ পায়ের উপর। আমার দিকে না তাকিয়ে নির্মোহ কণ্ঠে আমার বিদায়ী প্রেমিকা একটাই বাক্য বললো, সামনাসামনি বলা ওটাই ছিল তার শেষ কথা।
আমরা যতোটুকু যা করলাম, তওবা তওবা, এইটা কিন্তু মহাপাপ!
কিন্তু আমি তো এইসব চাই নাই, তুমিই তো
আমাকে শেষ করতে না দিয়ে পাগল মেয়ে দৌড়ে চলে গেল স্কুলের দিকে। একবারও আর পিছন ফিরে তাকালো না। আমি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ ওর দুরন্ত ছায়ামূর্তি দেখলাম। সর্বশক্তি দিয়ে মাত্র একবার চেষ্টা করলাম তাকে আটকানোর। দ্বিতীয়বার ডাক দেয়ার আগেই আমাকে সেই অজানা ইন্দ্রিয় এসে আরো একবার সতর্ক করে গেল।
আমি এবার ধীরপায়ে একলা হাঁটছি নদীর দিকে। বিরহ ফিরে পাওয়ার প্রভাবেই হয়তো, আমার ভয় ডর দ্বিধা উদ্বেগ সব ঝোড়ো বাতাসে মিশে গেল। ব্যাগ হাতড়ে দেখলাম ওয়াকম্যানটা আছে কিন্তু তাড়াহুড়ায় ক্যাসেট আনতে ভুলে গেছি। নদীর দিকে তাকিয়ে অবশেষে নিজেই সুরে-বেসুরে গাইতে শুরু করলাম মনটাকে এক বিষাদকাতর নদী ভেবে।
তুমি তো জানো না আমি কতোবার
বেঁধেছি আমার মনোবীণা-তার
শোনাতে তোমায় কন্ঠ আমার
কত যে গোপনে সেধেছি
আমি নদীর মতো কতো পথ ঘুরে
তোমার জীবনে এসেছি

লাহোরে এবার যেতে হবে পুরো এক সপ্তাহের জন্য। আসা যাওয়ার টিকেটও কাটা হয়ে গেছে গতকাল। তবে আসল কাজটা এখনও বাকি। মাদার সুপিরিয়রের কাছে পাঁচদিনের ছুটি চাইতে হবে। আমাদের সুরের রাজকন্যা স্কুলে আবার বাধ্য অনুগত ছাত্রী। চেষ্টা করেন যতোটা সম্ভব ক্লাস পরীক্ষায় নিয়মিত থাকতে। তবে সম্প্রতি খুব মুশকিল হয়ে গেছে দুই কুল বাঁচিয়ে চলা। দিনের পর দিন রাত জেগে রেকর্ডিং, বাসায় প্রতি বিকেলে নিবিড় রেয়াজ, পণ্ডিত সাহেবের কাছে গজল শেখা, তার উপর অচেনা ভাষায় গানের প্রস্তাব আসছে প্রচুর। অন্য জাতির ভাষায় মৌলিক গান গাওয়া তো আর সহজ কথা না। শুধু শব্দ বাক্য উচ্চারণ জানলেই হয় না, এসব তো মাধ্যম মাত্র। যেকোনো গানের আসল সৌন্দর্য হলো ভাষার আড়ালে লুকিয়ে থাকা উপলব্ধিগুলো, সাথে ঠিকঠাক মেশাতে হয় সুর তালের খেলা। গলার চল হওয়া চাই জলের মতো জড়তাহীন।
আইদার স্টাডি অর সিং, ইউ কান’ট ডু বোথ!
ছুটির আবেদন দেখা মাত্র মাদার সুপিরিয়রের চোখ রাগে রক্তিম হয়ে গেল। পরক্ষনেই নিজেকে শান্ত করে সুরের ভবিষ্যত সুলতানাকে তিনি দুই নৌকায় পা রেখে চলার ঘোর সংকট বোঝাতে লাগলেন। আগামীর সুর সম্রাজ্ঞীর মন যদিও পড়ে আছে অন্য ঘটনায়। প্রথম টেলিভিশনে গান গাওয়ার আবেশ থেকে তিনি একেবারেই বের হতে পারছেন না। রেকর্ডিং হয়ে গেছে অন্তত এক সপ্তাহ অথচ এখনো মনে হচ্ছে আলোয় চোখমুখ ঝলসে আছে। আজ রাত নয়টায় পুরো প্রদেশের মানুষ একসাথে বসে তাঁকে দেখবে। কী ঘটতে পারে এরপর? সবাই কি অতি আধুনিক বলে বাতিল করে দেবে, সজোরে সমস্বরে? গানের সাথে চলে আসা তাঁর নাচের স্বতঃস্ফূর্ততা কি দেশের মানুষ মেনে নিতে পারবে? টেলিভিশন চালু হয়েছে তিন বছরও হয় নাই। এদেশের দর্শক কি এতো নজিরবিহীন চমক দেখার জন্য প্রস্তুত হতে পেরেছে আদৌ? এসব উদ্বেগের তুলনায় কিছুটা তুচ্ছ কিন্তু নিজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু প্রশ্নও ঘুরছে মাথায়। হীরার ঝলক দেখতে কেমন লাগবে সাদাকালো পর্দায়? হাতের কারুকাজ ফুটবে তো স্পষ্ট? টেলিভিশনে গাওয়ার প্রস্তাব আসার পর থেকেই একটা হীরার আংটির শখ তার প্রবল হয়ে ওঠে। কিন্তু মায়ের আপত্তি ছিল বয়স নিয়ে।
এখনও এতো ছোট তুমি, আরেকটু বড় হও কিনে দেব, আই প্রমিজ।
কিন্তু কণ্ঠের রাজকুমারী আজ কোনো অজুহাত মানতে চান না। স্কুলে আসার সময় গাড়িতে পুরোটা সময় মন খারাপ করে বসে থাকলেন। মা বাবার দরকারি কথার উত্তরও পারলে সব এড়িয়ে যাচ্ছেন। বিকেলে ফেরার সময় একই অবস্থা দেখে মা অবশেষে আংটিটা কিনে দিতে রাজি হলেন। কেনার পর গাড়িতে ফিরেই জানলা খুলে আগে সূর্যের নিচে হাত রাখলেন কিশোরী গায়িকা। যতোক্ষণ নরম রোদ তাঁর আঙুলে পড়ে দুলছিল, তিনি মোটেও চোখ ফেরাতে পারলছিলেন না। সেদিন সন্ধ্যায়, কণ্ঠের সোনালি আনন্দে হীরার জৌলুস মিশিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন।
ইয়ে মেরা আফসানা নাহি
পাতা নাহি কিসকি ইয়ে রুপকাহানি হ্যায়
যো ম্যায় সুনা রাহি হু
গানের কথার সহজাত উৎসাহে হয়ে উঠলেন পেখম খোলা ময়ূর । তাঁর রেশমি চুলে ফুল ফুটে আছে, রাজকীয় ঝুমকা দুলছে কানে। স্বর্ণকণ্ঠী গায়িকার তখন সত্যিই মনে হচ্ছিল কলকাতায় বসে ঠাকুরমার মুখে শোনা আশ্চর্য রূপকথা তাঁর গানের চারপাশে এসে ঝলমল করছে!
মেরি মোরা ওয়ারগি চাল, নে সাইয়ো
রেশম ওয়ারগি বাল
মেরি হাত বিচ লাল রুমাল
চলবে…