ফজরের আজানের আগেই ঘুম ভাঙ্গে রেহানা বেগমের। বয়সের কারণে প্রায়ই অনিদ্রায় ভোগেন ৷ তবে আজ দুঃস্বপ্নের কারণে জেগে উঠেছেন। তিনি কী দেখেছেন তা মনে করতে পারছেন না। হঠাৎ তার বুক খালি খালি লাগছে। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে চাইছেন। কিন্তু পারছেন না৷ ইদানিং তিনি শুধু মোনাজাতে কাঁদেন। নামাজ শেষে যখন দুই হাত তুলে কিছু চাইতে যান তখন ই দুই চোখ বেঁয়ে পানির স্রোত বয়ে যায়। তখন মন ও প্রাণ শূণ্য হয়ে যায়। আর কিছু চাওয়া হয়না। তিনি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন। আবার কী যেন ভেবে বসে পড়লেন। বয়সের ভার,একাকিত্বের সংমিশ্রণে তিনি কেবলই এক অস্তিত্ব।
রেহানা বেগমের এখন পুরো সময়টাই অবসর। তিনি কাল্পনিক খাতায় জীবনের পূর্ণতা অপূর্ণতা লিখে সময় কাটান।পূর্ণতার অংশে চার পাঁচটি বিষয়ের ঠাঁই হয়েছে। অপূর্ণতার ক্ষেত্রে তা সীমাহীন।আজান কানে যেতেই তিনি নড়ে উঠলেন। তারপর ওজু করে, নামাজ পড়লেন। কিছুক্ষণ তিনি নীরবে কাঁদলেন। পরিকল্পনা করেছিলেন মোনাজাতে তার ছেলেকে দেখতে চাইবেন৷ চাইবেন তার ছেলে যেন এসে তাকে নিয়ে যায়। কিন্তু তিনি চাইতে পারলেন না। কেন এমন হয়?নিজের উপর রেহানা বেগম বিরক্ত হলেন। এরপর তিনি বিছানায় কাত হয়ে বসলেন। আঙুলের কড় গুণে গুণে হিসাব করেলেন যে তিনি বৃদ্ধাশ্রমে কত সময় ধরে আছেন। চার বছর পাঁচ বা ছয় মাস। বয়সের সুবাদে দিন তারিখ মনে থাকে না।তাই মাসের হিসাবে গন্ডগোল লেগে গেছে। এর মধ্যে মাত্র সাতবার তার ছেলে তাকে দেখে গেছে।শেষ হবে আসে তার মনে নেই। তিনি মনে মনে বলে উঠলেন "সোনাবাবা তোকে কতদিন দেখি না! "। ছেলের কথা ভাবলেই চোখের সামনে ভাসে এক কোমল শিশুর অবয়ব। যে হাঁটলে ঠাস ঠাস শব্দ হতো। এতটুকু মনে করে রেহানা বেগম মুচকি হাসলেন। কতই না বায়না করতো তার ছোট্ট বাবুইপাখিটা। কতই না মায়ের ভক্ত ছিলো। আর এখন? দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। যেদিন থেকে মা হয়েছেন ঠিক সেদিন থেকেই তার হৃদপিণ্ড দখল করেছে তার সন্তান।
স্বামীর মৃত্যুর পর তার জীবনে আসে এক ঘূর্ণিঝড়। যার পুনর্বাসন সম্ভব না। বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেয় ছেলের সংসারে। যেখানে তিনি হয়ে গেলেন সব থেকে বড় " ঝামেলা"।ঝামেলা শব্দটি মাথায় ঘুরপাক খায়। গর্ভধারণ থেকে সন্তান পালনের যে যুদ্ধ তা বর্ণনায় তিনি কখনই ঝামেলা শব্দটি ব্যবহার করেননি। বরং এমন ভাবনাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করেছেন৷ যাইহোক এরপর তাকে রেখে যাওয়া হয় এই বৃদ্ধাশ্রমে। ছেলের সংসারে ঝামেলা রইলো না এভেবে তিনি কোন প্রতিবাদ করেননি। তবে মনে মনে আশা করেছিলেন একদিন ঠিক ই তার ছেলে তাকে নিয়ে যাবে। এ এমন এক আশা যার বাস্তবিক রূপ নেই।
চারিদিকের অসহায় মানুষদের দেখে রেহানা বেগম বুঝে গেছেন একটা বয়সের পর মানুষ ফেলনা হয়ে যায়। তখন তার সারাজীবনের ছুটে চলা, দুঃখ, কষ্ট,ত্যাগের মূল্য থাকে না৷ তিনি এখন সে বয়সেই আছেন। যে বয়সী মানুষদের কেউ গোটা একটা উপন্যাস উৎসর্গ করে না।যাদের জন্য নিয়ে আসা হয় না এক মুঠো লাল গোলাপ। কিংবা জানতে চাওয়া হয় না অপূর্ণ শখ৷ অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্রেও কাপড় বুলিয়ে ধূলো সরানো হয়৷ কিন্তু কেউ তাদের তিলে তিলে গড়ে তোলা বিষাদসিন্ধুর ভাঙ্গন চায়না। এভাবেই একরাশ আফসোস নিয়ে বয়ে যেতে হয় জীর্ণ অস্তিত্ব। অপেক্ষা করতে হয় এমন এক দিনের, যার পর পূর্ণতা অপূর্ণতার হিসাব চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় ।
75
View
Comments
-
Kazi Eshita
4 months ago
এমন পরিণতি কোনো মায়ের না হোক