Posts

গল্প

ভালবাসার আড়ালের সংসার

August 1, 2025

Sumena bagum

61
View

আড়ালে_ভালোবাসার_সংসার২
 

🌹❤🌹

আজ বিথীর বিয়ে, তবে তার জন্য এটি জীবনের একটি অযাচিত ও কালো অধ্যায় হিসেবেই গণ্য। এমন না যে সে কাউকে ভালোবাসে তবে তার অতিত এই বিয়েকে তার জন্য অপ্রীতিকর করে ফেলেছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শ্যামা মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস বিথী,  যার মধ্যে চাঞ্চল্যতার বিন্দুমাত্র নেই বরং বেশ শান্তশিষ্ট ও চাপা স্বভাবের সে। ঘরের একমাত্র সন্তান হওয়ায় কখনো দুঃখের ছায়া দেখেনি... যদিও পারিবারিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান অনুযায়ীই সে তার চাওয়া পাওয়া অত্যন্ত সীমিতই রেখেছিলো। এছাড়া ছোটখাটো যা যখন চেয়েছে বাবামা সবই হাজির করেছে তাই বাবামাকে বড্ড ভালোবাসে সে। কিন্তু সেই বাবা-মাই যে তাকে এতোটা অপদস্থ করবে জানা ছিলো না তার।

--- এখনো বুঝতে পারছি না আমি কি করে কি হলো, হঠাৎ করে আমার জীবনটা কি করে এক পথ থেকে একদম অন্যরকম পথে নেমে গেলো! মনে হচ্ছে সব যেনো একটা কল্পনা, দুঃস্বপ্ন যা ঘুম ভাঙলেই মিথ্যে প্রমাণ হবে। তবে এদিনে উপস্থিত প্রতিটি বস্তু থেকে শুরু করে মানুষ তাকে এই কঠোর বাস্তবতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে।

বিথী আনমনেই এসব ভাবছিলো তখন তার মা আয়েজা বেগম দরজা খুলে ভিতরে আসেন। তার হাতে মূল্যবান স্বর্ণ ও হিরার অলংকার এবং বেশ রাজকীয় ও দামী একটি দুপাট্টা। তার মা বেশ খুশিমনে উত্তেজিত হয়ে বললো,

--- দেখ! দেখ! কি সুন্দর আর দামী দামী জিনিসপত্র নিয়ে আসছে তোর শশুরবাড়ির লোকজন!

বিথী উত্তরে কিছু বললো না, তাই আয়েজা বেগমে বেশি একটা ঘাটলো না বিষয়টা। সে খুব ভালো করেই জানে তার মেয়ের এই বিয়েতে মত নেই। মনে মনে সে বলে উঠে,

--- জানি মা, তোর বেশ অভিমান হচ্ছে আমাদের উপর। কিন্তু পিতামাতার চাইতে সন্তানের ভালো কেউ বুঝে না... আমরা যা করছি সব তোর ভালোর জন্যই।

সত্যি বাবা-মায়েরা অদ্ভুত এক ভালোবাসাময় মানুষ। যারা প্রত্যহ সন্তানের নানা স্বপ্ন ভেঙে থাকে... তাও শুধুমাত্র একটা অজুহাতে, পিতামাতা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না বরং সবচেয়ে ভালোটাই চায় তার জন্য। কিন্তু তাদের কে বোঝায় সন্তান হয়তো সবচেয়ে ভালোটাতে নয় বরং মোটামোটিতেই সুখী ও সন্তুষ্ট!

বিথীকে তার মা গহনাদি পড়াতে গেলে সে ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠে,

--- যেখানে মনেই বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনের রং লাগেনি, সেখানে বাহ্যিক দিকটা অলংকৃত করার কি খুব প্রয়োজন? যাই হোক এতো ভরের গয়নাগাটি আমি সামলাতে পারবো না।  

মিসেস আয়েজাও বেশ গম্ভীর গলায় আদেশ করার ন্যায় বলেন,

--- এতো কথা তো শুনতে চাইনি। যা করছি তা চুপচাপ করতে দাও আমায়। তবে হ্যাঁ, তোমার যেহেতু এতোসব পড়তে অস্বস্তি লাগছে সেহেতু শুধু এখান থেকে হিরার নাকফল, হাতের কঙ্গন জোড়া, শিতাহার এবং কোমরবন্ধনীটা পড়ে নাও।

বিথী আর কিছু বললো না বরং নিজ মনেই ভাবলো,

--- যেখানে আমার ইচ্ছেরই কোনো মূল্য নেই সেখানে কিছু বলেও কি লাভ! বলা আর না বলা তো একই কথা।

মিসেস আয়েজা নিজের মতো বিথীকে তৈরি করে বসার ঘরে নিয়ে গেলো। সেখানে আজ বিবাহ আয়োজন করা হয়েছে, বেশ রমরমা পরিবেশ হলেও বিথীর মধ্যে এই আমেজের ছিটেফোঁটাও নেই। বরং সে যেনো কারো হাতের কাঠেরপুতুল, তাকে যেভাবে বলা হচ্ছে সে সেভাবেই সব করছে।

এতোক্ষণ বেশ কথা হলো কনেকে নিয়ে। এবার বরের দিকে যাওয়া যাক, তার নাম আহান চৌধুরী বিধান। দেশের সুনামধন্য চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রিজের একমাত্র ওয়ারিশ সে। তাই তো বিথীর পিতামাতা সন্তানের চাওয়াকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের ভাষ্যমতে 'ভালো ছেলের' কাছে বিবাহ দিচ্ছেন। সে যাই হোক বিধান যুবতী নারীদের কাছে তাদের স্বপ্ন পুরুষ নিজের ব্যক্তিত্ব ও বাহ্যিক সৌন্দর্যের জন্য। শুভ্র গায়ে সিল্কি চুল। আর গোলগাল মুখে একজোড়া মায়াবী চোখ, ঘন চোখের পাপড়ি, মৃদু গোলাপি অধরসুধার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে তার এক কোণে থাকা কালোরঙা ছোট্ট তিলটা। তাই সবমিলিয়ে এক সুদর্শন ও হৃদয়কারা যুবক সে।

তবে তার বাহ্যিক দিকটা মায়াবী হলেও তার ভিতরটা একদম কঠোর। তার জেদ ও রাগের জন্য ব্যবসায়ীমহলে বেশ আলোচনা-সমালোচনার বিষয়বস্তু সে। কিন্তু সবকিছুকেই ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে সে এতোটা এগিয়েছে যে বর্তমানে বাংলাদের অন্যতম সাক্সেসফুল  ইয়াং বিজনেসম্যান। তার যা চাই তা তার লক্ষ্য নয় বরং জেদ হয়ে যায়। বিথীর উপর বেশ ক্ষোভ তার। কারণ তার মতো ছেলেকে রিজেক্ট করার মতো অকল্পনীয় কাজ করে দেখিয়েছে বিথী। ভালোবাসে সে তবে তা বর্তমানে ঢাকা ইগো, রাগ, জেদ ও কিছু দ্বিধার আড়ালে।

বর্তমানে বাসরঘরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বধূবেশে বসে আছে বিথী। তবে নেই তার মাঝে নববধূর ভাব বা তেমন চালচলন। তার মনে অনেক প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।

--- বিধান স্যার কেন আমাকে বিয়ে করলো, সে তো দিশাকে ডেট করা শুরু করেছিল। আর বড় ম্যাডাম তার একমাত্র ছেলের জন্য আমাকে কি করে পছন্দ করলো! না আমি তাদের মতো হাই সোসাইটি থেকে বিলং করি না রূপবতী তাহলে... যাকগে বিয়ে নাহয় হয়েই গেলো, তবে আমি তো তাকে বা এই সম্পর্ককে মেনে নিতে প্রস্তুত না। সে কি আমাকে সময় দিবে সবকিছু মেনে নেওয়ার কিংবা সবটার সাথে মানিয়ে নেয়ার নাকি স্বামীর অধিকার নিয়ে চাহিদা মেটাতে হাজির হবে আমার সামনে? আমি তো আরেকটা বিষয়ও ভাবিনি সে কি নিজে মেনে নিয়েছে এই বিবাহবন্ধনকে নাকি এসে হিন্দি সিনেমার মতো বলবে সে আমাকে মেনে নেয়নি এবং কয়েকমাসের মাঝেই তালাক দিবে। উফফ! আর ভাবতে পারছি না মাথাটা ধরে যাচ্ছে...

ভিষণ ক্লান্তি লাগছে বিথীর অবশ্য লাগবে নাই বা কেনো। স্বভাবগতই সে সবসময় অতি সাধারণভাবে চলাফেরা করে, বড় অনুষ্ঠান বা কারো বিয়ে উপলক্ষেও কখনো এতো সাজসজ্জা কিংবা ভারি শাড়ি পড়েনি। জীবনে এ নিয়ে দুবার শাড়ি পড়লো সে। গতবার পড়েছিলো স্বল্প ওজনের সিল্কের শাড়ি তাই বেশি একটা অপ্রীতিকর লাগেনি সামলাতে। তবে আজ তো ভারি অফ হোয়াইট বেনারসি, শশুরবাড়ির দেয়া স্বর্ণের ভারি অলংকার, তার উপর নানীমার সীঁথিপাটি ও গলার কণ্ঠহার । সবচেয়ে বেশি বিরক্তিকর লাগছে মুখের ব্রাইডাল মেকআপ।

ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই দেখে প্রায় দেড়ঘণ্টা ধরে সে এখানে বসা। বেশ অস্বস্তিবোধ হচ্ছে তার এখন, ঘুমে ঝিমুচ্ছে সে, হাত-পা ভেঙে আসছে তার সারাদিনের ক্লান্তিতে। এভাবে ঝিমুতে ঝিমুতে কখন যে চোখ লেগে গেছে বুঝতেই পারেনি বিথী।

আচমকা দরজা খুলার শব্দে ঘুম ভাঙে বিথীর তাই এভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ঘুমিয়ে পড়ায় সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ঘুমের ঘোরে মাথার ডুপাট্টাটাও পড়ে গিয়েছে বলে খাণিকটা বিব্রতভাব এসে পড়েছে তার মাঝে।

বিধান ঘরে ঢুকে বিথীর মুখশ্রীর দিকে একপলক তাকিয়ে কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে গেলো। বড্ড ক্লান্তি তার সারাদিনের কার্যক্রমে। কিন্তু নিজ মনে কেমন একটা অপারাধবোধ কাজ করছে তার। কৃত্রিম ঝর্ণার বিন্দু বিন্দু পানিকণাগুলো তার মুখশ্রী স্পর্শ করতেই মনে পড়ে যায় মায়াবতীর সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ।  সে সাক্ষাতের কথা ভাবতে ভাবতেই গোসলটা সেরে নিতে থাকে।

অতিত,

--- ইশ! মা তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট দাও! জানো তো নতুন কর্মচারী নেওয়া হবে কোম্পানির জন্য। তাই ইন্টারভিউ নিতে সময়ের আগে উপস্থিত হতে হবে, কারণ আমিই যদি লেট হই নতুন স্টাফরা কি করবে!

--- আরে বাবা, আনছি! আনছি! খাণিকটা সময় শান্ত হয়ে বস আমার তো আর দশটা হাত নেই। বলি বিয়েটা করে নে এখন, বয়স তো আর কম হলো না!

--- উফ! মা বাজে কথা না বলে তাড়াতাড়ি আনো তো!

পাক্কা দশ মিনিট পর মিসেস চৌধুরী সকালের নাস্তা নিয়ে হাজির হলেন। বিধান ও সে একইসাথে খেয়ে নিলো। তারপর বিধান চলে গেলো অফিস কার কিস নিয়ে।

সে যাওয়ার পর তার মা মনে মনে ভাবছে,

--- হায় আল্লাহ! কবে যে সুবুদ্ধি হবে এই ছেলের! অফিসের দায়িত্ব নিয়ে আমাকে ঘরে বসালো অথচ আমি সময় কাটাবো কি করে তা আর ভাবলো না। হুহ! বাড়িতে বউ থাকলেও তো তার সাথে আড্ডা দেওয়া যেতো।

এদিকে বিধান অফিসে পৌঁছালো আটটা পঞ্চাশে অর্থাৎ ইন্টার্ভিউ টাইমের দশ মিনিট আগে। যদিও হাতে আরও দশ মিনিট তবুও তার ধারণামতে সে অত্যন্ত লেট এসেছে আজ। তাই হাড়তাড় করে কোনোদিকে ধ্যান না দিয়ে লিফটে ঢুকতে যাচ্ছিলো এমনসময় ধাক্কা খেলো এক নবযুবতী নারীর সাথে। সেও লিফটে ঢুকতে যাচ্ছিলো... পরিণাম স্বরূপ মেয়েটির হাতের সব ফাইল ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মেয়েটি মাথা নিচু করে ফ্লোর থেকে ফাইলগুলো উঠাচ্ছে।

আচমকা এরূপ ঘটনা হওয়ায় বিধানের রাগ উঠে গেলো তাই বেশ রাগান্বিত গলায় বললো,

--- এই যে মিস! চোখ কি বাসায় রেখে হাঁটেন নাকি? নিজের তো ক্ষতি করলেনই আমারও দেরি করিয়ে ফেললেন। আপনি জানেন আমার সময়ের মূল্য কত।

মেয়েটি কিছু না বলেই ফাইলগুলো হাতে নিয়ে মুখ উঠিয়ে বিধানের দিকে তাকালো। বিধান যেনো থমকে গেলো এই মেয়ের চাহনিতে। আনমনেই বিড়বিড় করে বলে উঠে,

--- কাজলরেখা আঁকা চোখজোড়ায়, ছলছল তার চাহনি। এই চাহনিতে লুকিয়ে আছে হাজারো অভিযোগ যা মুখ ফুটে বলতে না পারে সে, কি করে পারবে? তার মনের ভাব প্রকাশ যে চোখ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তাই মুখের বুলি হওয়ার সুযোগ কই!

মেয়েটির সিঁড়িপথ বেয়ে চলে যাওয়ায় ঘোর ভাঙে তার। ভুল তারই ছিলো সে কোনোদিকে তাকায়নি বলে সামনে থাকা নারীকে দেখতে পারেনি কিন্তু তা কি আর মনে রাখে ইগোস্টিক বিধান! সে তো বিনাদোষে মেয়েটিকে বকেছিলো তাই হয়তো চোখে পড়েছে অভিযোগে রাঙা নয়নযুগল।

যাকগে এই প্রথম বিধান কোনো নারীর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করলো তবে মেয়েটির পুরো মুখ দেখতে পারেনি। কারণ তার সকল ধ্যান চোখজোড়ার মাঝেই সমাপ্ত ছিলো। আর যখন ধ্যান ভাঙলো তখন মেয়েটি নেই। ব্যপারটা বেশ আবেগপ্রবণ হলেও বিধান এসব আবেগের ধার ধারে না তাই সে আর মেয়েটিকে নিয়ে না ভেবে গম্ভীরত্ব বজায় রেখে নিজের কেবিনে পৌঁছালো। সেখানে আগে থেকেই তার বিশ্বস্ত কর্মচারী আলোড়ন উপস্থিত ছিলো।

--- গুডমর্নিং স্যার!

--- হুম। শুনুন মিস্টার আলোড়ন, বাহিরে যারা যারা চাকরির জন্য বসে আছে তাদেরকে বলেন আফটার টেন মিনিটস ইন্টার্ভিউ উইল স্টার্ট সো বি প্রিপেয়ার্ড।

--- ওকে স্যার!

এই পর্যন্ত বিশজন ইন্টার্ভিউ দিয়েছে তার মধ্যে একজনকে খুব পছন্দ হয়েছে পদটির জন্য। এখন মাত্র একজন বাকি ইন্টার্ভিউ নিতে আর সবার শেষেই সেই অনাকাঙ্ক্ষিত নারীটি ঢুকলো। হ্যাঁ, ধাক্কা লাগা সেই মেয়েটিই এসেছে।

বিধান প্রথমে তাকে চিনতে না পারলেও, ভালোভাবে তাকাতেই চিনে ফেলে। তার মন যেনো বারবার বলছে এই মেয়েটাকে চাকরিতে রাখতে কিন্তু ইগোস্টিক বিধান কি আর শুনে তা!

এদিকে বিথী সেই যে মাথা নিচু করে কেবিনে ঢুকেছে আর মাথাই উঠায়নি। বেশ মিনমিনে গলায় বললো,

--- গুড মর্নিং স্যার! হাউ আর ইউ?

বিধানের মেজাজ খারাপ হচ্ছে বিথী মাথা নিচু করে রাখায়। মনে মনে বললো,

--- আমাকে স্বচক্ষে দেখার জন্য প্রতিটি নারী পাগল, সেখানে এই মেয়ে এমন ভাব দেখাচ্ছে যেনো আমাকে দেখলে তার চোখ নষ্ট হয়ে যাবে নাহলে খসে পড়বে। যাকগে আমার কি! তবে মেয়েটার নামটা বিথী বা বিথুপাখি বললেও কম যায় না। হাউ কিউট! ধুর! বিধান তুই এসব কি বলছিস রূপের মতো!

এদিকে বিথী ভাবছে,

--- আল্লাহ আসতে না আসতেই কোনো ভুল করে ফেললাম নাকি... লোকটা জবাব দিচ্ছে না কেনো নাকি শুনতে পায়নি! এমনিতেই আমার সিভি এই চাকরির যোগ্য না তার উপর আসার পর থেকে ঝামেলায় লেগে আছি। উফফ!

বিথীর নিজের সাথে বলা কথার মাঝেই বিধান বেশ গম্ভীর গলায় বললো,

--- গুড মর্নিং মিস বিথী! এন্ড ইউ ক্যান সিট নাউ।

সদ্য সাক্ষাৎ হওয়া লোকের ভয়েসটা বিথীর কেমন যেনো চিনা চিনা লাগলেও, সে আর ঘাটলো না। বরং চুপচাপ সামনে থাকা ব্যক্তিটির কথা মতো চেয়ারে বসে পড়লো।

বিধান সামনে থাকা মেয়েটির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ফাইল ঘাঁটতেই চক্ষুচড়ক গাছে তার কারণ মেয়ে পড়ালেখায় অনেক ব্রাইট হলেও যেই পদের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিলো তার যোগ্য নয়। বলা বাহুল্য চাকরিটি বিধানের এই অফিস অর্থাৎ কোম্পানির প্রধান শাখার জন্য নয়, আরেকটি ব্রাঞ্চের জন্য। তবে সেই পদের জন্য নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা হলো মাস্টার্স, সেখানে বিথী সবেমাত্র অনার্স থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট।

তাই সে বেশ গম্ভীর বললো,

--- মিস বিথী আপনি জব সার্কুলার ভালোভাবে দেখেননি? এখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা...

সামনে বসে থাকা লোকটিকে আর বলতে না দিয়ে বিথী এক নিঃশ্বাসে বলতে লাগলো,

--- আই নো আই এম নট সুইটেবেল ফর দ্য জব। কিন্তু আমার জন্য জবটা বেশ ইম্পর্ট্যান্ড। কারণ এটা নাহলে আব্বু-আম্মু বিয়ে দিয়ে দিবে আমাকে। আর আই এম নট প্রিপেয়ার্ড ফর দ্যা মেরেজ রাইট নাউ। আপনি চাইলে আমাকে আরও ছোট কোনো পদেও নিয়োগ দিতে পারেন, বাট প্লিজ ডোন্ট সে নো!

বিথীর কাঁদো কাঁদো গলায় বলা কথাগুলো বেশ বুকে লাগে বিধানের। না চাইতেও মেয়েটির বাচ্চামিতে যুক্তিবল ও চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলে সে। মনে মনে ভাবে,

--- ইশ! মেয়েটা কত আশা নিয়ে এসেছে আমি কিনা ফিরিয়া দিবো! কথাবার্তা এবং কাঁদোকাঁদো চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে আমি উত্তরে না বললেই বিলাপ শুরু করে দিবে। কিন্তু এই পদ তো দেয়া পসিব্যাল না আফটার অল বিজনেস কাম ফাস্ট! ওয়েট! আমি তো নিজের কাজ একা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি বলে পিএ রাখিনি। তাহলে এই মেয়েকে পিএ রেখেই দেই, এতে তার মনও ভাঙবে না আর কাজ না পারলেও সমস্যা নেই। বিধান চৌধুরী একাই একশো!

মনে মনে সকল হিসাব-নিকাশ শেষ করে বিথীকে বলে,

--- ঠিক আছে, মিস বিথী আপনাকে চাকরি দেয়া হচ্ছে তবে বিজ্ঞাপনে দেয়া পদে নয় অন্য পদে। কাল থেকে আপনার জয়েনিং আমার পিএ হিসেবে। আর চাকরিটা কিন্তু আপনার এই রিকুয়েস্টের জন্য পাননি, পেয়েছেন কারণ পদটি খালি ছিলো এবং আপনি এই পদের জন্য একদম ফিট।

বিথী খুশিমনে ধন্যবাদ জানাতে সামনে তাকাতেই থমকে যায় ধাক্কা খাওয়া ব্যক্তিটিকে দেখে। তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠে,

--- থ্যাংক ইউ স্যার। আমি কি যেতে পারি?

--- না, আপনি সবার পরে যাবেন যেহেতু আগামীকাল আপনি জয়েন করছেন সব কাজ বুঝে নিয়ে যাবেন। আমি একটা কনফারেন্স কল এটেন্ড করবো, তারপর আপনাকে বুঝিয়ে বলবো। ততক্ষণ আপনি ঐ যে কর্ণারের সোফায় বসুন, ইউ ক্যান ইউজ ইউর ফোন ফর টাইমপাস।  

বিথী মাথা ঝাঁকিয়ে সোফায় যেয়ে বসলো, আর কানে ইয়ারপট লাগিয়ে গান শুনতে লাগলো। অপরপাশে বিধান নিজের মিটিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, এতোটা ব্যস্ততার মাঝে ডুবে গিয়েছে যে বিথী নামক কোনো মেয়ে যে তার জন্য অপেক্ষারত সেটাই ভুলে গিয়েছে।

মিটিং শেষ করে ল্যাপটপে নিজের কাজ করছিলো সে, আচমকা সকালের কাজলনয়নার কথা মনে পড়তেই রুমের কর্ণারে তাকালো সে। তাকিয়ে যা দেখলো তাতে নিজেই বোকা হয়ে গেলো। কারণ বিথী গান শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। বিধান এবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলো তার মনকাড়া নারীটিকে। কেমন একটা ঘোরে চলে যায় সে...

--- শ্যামা গাঁয়ের গড়ন, গোলগাল মুখ, ছোট ছোট মায়াময় চোখ, বোঁচা একটা নাক, গোলাপের পাপড়ির ন্যায় কোমল ও পুরু অধরসুধা, এলোকেশ সবমিলিয়ে সাধারণ এক বাঙালি নারী। তবুও কেনো যেনো আমার কাছে সে সাধারণের মাঝেও অসাধারণ, মায়াবি রাজ্যের মায়াবিনী রাজকন্যা সে।

বিথী ঘুমের মাঝে আলতো হেসে উঠে। তার হাসিতেই যেনো মন আটকে যায় বিধানের, বিথীর প্রেমের সাগরে ডুব দিয়েই ফেলে সে। তারপর সদ্য প্রেমিকপুরুষ হওয়া যুবকটি কি নিজেকে সামলে রাখতে পারে! সবার কথা জানা নেই কিন্তু বিজনেস টাইকুন বিধানি চৌধুরী তা পারেনি, বরং ধীর পায়ে এগিয়ে যায় মায়াবিনীর দিকে। সোফার সামনে ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে বিথীর হাসিমাখা মুখটা তীক্ষ্মদৃষ্টিতে দেখতে লাগে।

--- হাসলে টোল পড়ে তার ঠোঁটের কোণে ও থুঁতনিতে। টোলপড়া গালের তো সবাই প্রেমে পড়ে তাহলে আমি কি এই শ্যামবতীর টোলপড়া থুঁতনি ও ঠোঁটের কোণের প্রেমে পড়লাম! অবশ্য, পড়লাম কোথায়? এই মায়াবি রাজ্যের মায়াপরীই তো নিজের মায়ায় আটকেছে আমায়। তবে শুনে নিন মায়াপরী আজ থেকে সেই রাজ্যের নয় শুধু আমার মায়াপরী আপনি।

বিধান যখন আপনমনে কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে প্রেয়সীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তখনই মেয়েটি নড়াচড় করে উঠে। এতে ঘোর কাটে বিধানের এবং সে অতিদ্রুত নিজের আসনে যেয়ে বসে।

বিথীর ঘুমের রেশ পুরোপুরি কাটতেই সে লজ্জা লাল-কমলা হয়ে উঠে। কারণ সে-ই মনে হয় যে চাকরির ইন্টার্ভিউয়ের জন্য এসে ঘুমিয়ে পড়েছে। বিধান বিথীর লজ্জা পাওয়াটা ঠিকই খেয়াল করলো এবং তা দেখে আলতো হেসে অস্পষ্ট গলায় বললো,

--- পাগল মেয়ে!

বিথী আমতাআমতা করে জিজ্ঞেস করলো,

--- স-স্যার অনেক তো সময় হলো, তো কাজটা বুঝিয়ে...

--- আজ বাদ থাকুক, কাল তুমি আমার বা ম্যানেজার সাহেবের থেকে বুঝে নিয়ো। এখন নাহয় নিজের বাড়ি ফিরে যাও!

বিথী বেরিয়ে যেতেই আলোড়ন দরজায় নক করলো,

--- মে আই কামিং সার?

--- ইয়েস। বাট তুমি কি এপোয়েনমেন্ট লেটার তৈরি করেছো মিস বিথীর আর মিস্টার সেনের?

--- ইয়াপ সার। কিন্তু চাকরি দেওয়ার কথা তো একজনের ছিলো, আর বিজ্ঞাপনটিও একটি পদের জন্য ছিলো, তাছাড়া আপনি তো পিএ রাখা পছন্দ করেন না। দেন মিস বিথী...

--- দ্যাটস নান অফ ইউর বিজন্যাস। আমি এই কোম্পানির কর্তা এবং আমি যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি তা বুঝে, শুনে, এই কোম্পানির ভালোর জন্যই করি ।

--- সরি সার। আমি যাচ্ছি এখন।

--- হুম।

সেদিনই বিধান চৌধুরীর মতো বদরাগী, একগুঁয়ে ও ইগোস্টিক মানুষের মনে দাগ কেটেছিলো বিথীর মতো অতিসাধারণ একজন বাঙালি নারী। প্রথম প্রথম বিথীর প্রতি অনুভূতিগুলো বুঝতে পারলেও সেটা ভালোবাসা না প্রেম তা বুঝতে পারতো না। ধীরেধীরে যখন নিজের ভালোবাসা নিয়ে একদম নিশ্চিত হলো, সেদিন সোজা গেলো মিসেস চৌধুরীর কাছে। মিসেস চৌধুরী তার পরিচিত ঘটকের হাতে প্রস্তাব পাঠালে বিথীর পরিবার খুশি মনে রাজি হলেও বিথী মানা করে দেয়। যদিও সে জানতো প্রস্তাবটা বিধানের জন্য। সেই সাথে তাকে কোম্পানি থেকে রিজাইন নিতে হয় নিজস্ব কিছু কারণে।

এদিকে বিধানের তো এমনিতেই বিথীর রিজেকশনে মাথা খারাপ তাই নিজের মনের বিরুদ্ধে যেয়ে দিশার সাথে টাইম স্পেন্ড করতে থাকে, ডেটে যায়। দিশা মেয়েটার অনুভূতিগুলো প্রকৃতি বিধানের পক্ষ হতে এই সম্পর্কের মাঝে ছিলো শুধুমাত্রই কৃত্রিমতা। দিশার সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থাতেই এমন পরিস্থিতির সূচনা ঘটে যার জন্য দিশাকে ছেড়ে আজ বিথী বিধানের স্ত্রী হয়ে চৌধুরী মহলের বাসরঘরে বসে আছে।

তবে বিয়ে হলেই কি সবটা স্বাভাবিক! একদিকে বিথী নিজের অতিতের বেড়াজালে বন্দী, অপরদিকে বিধান নিজের নিজের অপারাধবোধ, রাগ ও জেদের আড়ালে বিদ্যমান ভালোবাসায়। এটাই হয়তো #আড়ালে ভালোবাসার সংসার। 
এখন দেখার ব্যাপার হলো #দিনশেষে কে কোথায় ঠাই পায়, একে অপরের মনে নাকি অন্য খাঁচায় বন্দী হয়ে এই সংসারের ধ্বংস হবে?

চলবে...
#আড়ালে_ভালোবাসার_সংসার২
#দিনশেষে_কে_কোথায়
#Ipshita_Shikdar
#পর্বঃ২
বর্তমানে,

বিধান গোসল করে একটা ট্রাউজার এবং টিশার্ট পড়ে নেয়। মনে মনে ভাবে,

--- এতো ঝামেলার মাঝে ইশার সালাতটা পড়া হয়নি, তা আগে পড়ে নেই। আচ্ছা বিথী কি সেভাবেই বসে আছে নাকি... মেয়েটিকে একবার ড্রেস চেঞ্জ করতে বলা উচিত। উফফ! বিধান তুই একটা সামান্য মেয়েকে নিয়ে এতো ভাবছিস কেনো! নিজের কাজে কাজ রাখ! ইউ আর দ্য বিধানক চৌধুরী, ইউ শুড কন্ট্রোল ইউর মাইন্ড এন্ড ফিলিংস। তুই ঐ ফালতু মেয়ের দিকে তাকাবিও না। চুপচাপ জায়নামাজ নিয়ে নামাজ পড়তে থাকবি।

আনমনে কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে ওয়াশরুম থেকে বের হলেও, না চাইতেও তার চোখদুটো বেডে স্থীর হয়ে যায়। কারণ সেখানেই দেখেছিলো বিথীকে শাওয়ার নিতে যাওয়ার আগে। কিন্তু এবার তাকাতেই কিছুটা ভড়কে যায় সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীকে বেডের উপর না দেখে।

একটু চিন্তিত হয়েই ভাবে,

--- মেয়েটা এখানের কিছু চিনে না গেলো কোথায় তাহলে? তাছাড়া বিথী তো এমন ছটফটে মেয়েও না যে ঘর থেকে বের হবে কোনো কারণ ছাড়া। ধুর! এই মেয়েটাও না আমাকে একমুহূর্ত শান্তি দিবে না।

বিধান এদিক-ওদিক তাকিয়ে না পেয়ে বারান্দায় যায়, সেখানেও না দেখে ফিরে আসতে নেয় তখনই শুনতে পায় কোনো রমণীর মধুর বাণী।

--- হারিয়ে যেতে চাইছি যে আজ নতুন শহরে,
      যেথায় থাকবে না কোনো অশ্রু-কষ্ট,
      থাকবো শুধু সুখকর দিনের ছায়াতলে,
      যেথায় হবো না বন্দী পুরোনা স্মৃতির বেড়াজালে। 
      কিন্তু এমন শহর কি আদৌ কোথাও আছে,
      এটা যে প্রতিটি মানুষের এক অবাস্তব স্বপ্ন মাত্র। (অবাস্তব স্বপ্ন by ইপ্সিতা শিকদার)

বিধান মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই কণ্ঠ অনুসরণ করে নারীটির কাছে গেলো। কারণ জানে এই রমণী আর কেউ নয় তার প্রেয়সী যে কিনা বর্তমানে তার স্ত্রী।

বিধানের বারান্দার সাথে মিনি টেরেস। বিথী দূষণমুক্ত বায়ুতে শান্তির শ্বাস নিতে বারান্দায় যায়। খাণিক পরেই চোখ পড়ে ডান পাশে থাকে ফুল গাছে সজ্জিত মিনি ট্যারেসের দিকে। ছোটবেলা থেকেই ফুল গাছের প্রতি ব্যাপক টান তার, তাই দেখতেই চলে যায় সেখানে। বিধান তার পিছু এসে প্রেয়সীর মায়ায় পড়ে থমকে যায় সেখানে।

--- স-স্যার আপনি এখানে... এমন করে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?

বিথীর আচমকা করা প্রশ্নে ধ্যান ভাঙে বিধানের, সেই সাথে কিছুটা অপ্রস্তুতও হয়ে পড়ে। নিজের এমন আচারণের জন্য রাগ উঠে যায় তার।  

তাই বেশ রেগে বিথীকে বলে উঠে,

--- এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার! এখানে কি করো তুমি? সভ্যতা শিখো নাই নাকি! কোথায় নতুন মানুষ চুপচাপ ঘরে বসে থাকবে তা না ড্যাংড্যাং করে হাঁটছে, ঘরে যাও!

বিথীর কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আসছে, তবুও ঠোঁট কামড়ে তা আটকালো। কারণ আর যাই হোক কারো সামনে বিশেষ করে নিজের বসের সামনে কেঁদে দিয়ে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করার কোনোরূপ ইচ্ছে নেই তার।

কাঁন্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলো,

--- জ-জী স্যার।

বলেই এলোমেলো পায়ে ঘরে দিকে চলে গেলো। ভারি শাড়ি গায়ে কি আর সুন্দরভাবে চলতে পারে রমণী! সবারটা যাই হোক তবে বিথী পারলো না, শাড়িতে পা বেজে পড়ে যেতো নিলো। তখনই বিধান এসে ধরে ফেললো তাকে, রমণীর ভয়ার্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে পুনরায় তার রূপে মগ্ন হয়ে যাচ্ছিলো, তারপরও নিজেকে সামলে নিলো।

ধমক দিয়ে বলে উঠলো,

--- এখনো কি হাঁটাও শিখো নি নাকি?  এভাবে যখন তখন পড়ে যাও। যত্তসব ফাউল, অকর্মের ঢেঁকি!

এবার আর বিথী নিজের কান্না আটকাতে পারলো না, দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কারণ চাকরিরত অবস্থায়ও তাকে কখনো ধমক কিংবা বকা খেতে হয়নি বিধান থেকে। আনমনেই ভেবে উঠলো,

--- পিতামাতা তো সন্তানের সবচাইতে আপন মানুষ হয় তাহলে আমার বাবা-মা কেনো আমাকে এতোটা অপদস্থ হতে ছেড়ে দিলো।

না চাইতেও বিধানের বড্ড খারাপ লাগলো বিথীর অশ্রুসিক্ত চোখ দেখে, তাই আচমকা কোলে তুলে নিলো বিথীকে। বিথী অপ্রস্তুত হয়ে বিধানের কাঁধ খামচে ধরলো, তবে সে কি জানে এই কাজটি বিধানের মনে তাকে পাওয়ার তৃষ্ণা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।।

বিথী অবাক হয়ে কিছু বলবে তার আগেই বিধান তাকে থামিয়ে বললো,

--- নট আ সিঙ্গেল ওয়ার্ড নাহলে এক আছাড় দিয়ে কোমড় ভেঙ্গে ফেলবো।

বিথী এমনিতেই ভীতু ধরনের মেয়ে, তার উপর সে প্রথম থেকেই বিধানের রাগকে অনেক ভয় পায়। তাই বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ বিধানের কোলে চড়ে থাকে।

বিধান তাকে আলতো করে বিছানায় বসিয়ে গম্ভীর গলায় আদেশ করার ন্যায় বলে,

--- আমি নিচ থেকে আসছি, ততক্ষণে তুমি ফ্রেশ হয়ে ড্রেসি চেঞ্জ করে নিয়ো।

বিথী মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালে সে সেখান থেকে চলে গেলো। আগামীকালের রিসিপশন পার্টির জন্য কিছু বলতে হবে সারভেন্ট এবং মিসেস চৌধুরীর সাথে।

এদিকে বিধানি চলে যেতেই বিথী খাট থেকে নেমে নিজের লাগেজ খুলে। অন্যান্য মেয়েদের মতো বিথীর কোন জামা পড়বে তা ভাবতে ব্যস্ত হওয়া লাগে না কখনো কারণ সে এসব সাজসজ্জা সম্পর্কে তেমন সচেতন নয়। তাই হাতের কাছে পাওয়া জাম রংয়ের শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

বিধান ঘরে এসে বিথীকে পেলো না, তবে বাথরুম থেকে আওয়াজ আসায় বুঝলো সে সেখানে।  তাই সেও নিজের মতো বেডের এককোণে যেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। খাণিক বাদে বিথীও বাথরুম থেকে বের হয়ে অপরপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো।

--- তোমার পথে পা মিলিয়ে চলা,
তোমার হাতটি ধরে বসে থাকা,
আমার আকাশে তোমার নামটি লিখা।

এক অতিশয় সুন্দরী যুবতী চোখজোড়া বন্ধ করে গিটার বাজাতে বাজাতে উপরোক্ত গানটি গাইছে, আঙুল কেটে ফিনকি রক্ত বয়ে যাচ্ছে তাতে তার ধ্যান নেই। আসলে বুকের বা পাশে যখন ব্যথার সঞ্চার হয় তখন অন্য ব্যথা বা কষ্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। এই যুবতীর নাম দিশা, জহির খানের একমাত্র অষ্টাদশী কন্যা। কাঁদছে সে, কাঁদবে নাই বা কেনো আজ যে তার হৃদয়ে বসবাসকারী মানুষটা অন্য কারো হয়ে গেলো।

সে অশ্রুঝরাতেই ব্যস্ত ছিলো তখনই পিছন থেকে কেউ গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,

--- দিশা, কোথায় তুমি? আজ তোমার একমাত্র খালাতো ভাইয়ের বিয়ে ছিল। আর তুমি কিনা সেখানে উপস্থিত না হয়ে এখানে বসে বসে গান গাইছো!

দিশা দুহাতে নিজের অশ্রু মুছে বারান্দা থেকে উঠে নিজের ঘরে গেলো। তার বাবা প্রচন্ড রাগী ও একরোখা ধরনের মানুষ হলেও তাকে খুব ভালোবাসে। তার অশ্রু যে সহ্য করতে পারবে না তা তার জানা।

তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে বাবার সামনে যেয়ে দুষ্টু গলায় জিজ্ঞেস করে,

---কেনো গো বাবা তোমার ভাগিনা কি আমার জন্য বিয়ে থামিয়ে রেখেছে নাকি? তাছাড়া কাল আমি সিলেট যাচ্ছি কলেজ থেকে এন্ড ইউ নো দ্যাট আই হ্যাভ টু সিং ইন এভ্রি এভেন্ট।

মেয়ের দুষ্টু কথায় জহির খানের রাগ একদম গলে পানি। মেয়েকে অনেক আদরযত্নে বড় করেছে সে স্ত্রীর মৃত্যুর পর, মেয়ের সুখ তার কাছে সাতরাজার ধনের চাইতেও দামী।

বেশ নরম গলায় বললো,

--- কিন্তু আম্মু তুমি একা একা...

--- ডোন্ট ওয়ারি বাবা আই উইল বি ওকেহ।

--- এজ ইউর উইশ আম্মু, বাট বি কেয়ারফুল।

--- হুম।

মিস্টার খান দিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বেডরুম থেকে বের হয়ে যান, অপরদিকে তার মেয়ে হৃদয় ভাঙার ব্যথায় কাতর হয়ে আবার নিজেকে অশ্রুর মাঝে ডুবিয়ে নেয়।

সকালের একফালি রোদের আগমনে বিথীর ঘুম ভাঙলো। আড়মোড়া দিয়ে বিছানা থেকে উঠতেই সামনে যা দেখলো তাতে চোখ বন্ধ করে দিলো এক চিৎকার,

--- আহ!

বিধান দৌড়ে এসে বিথীর মুখ চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করলো,

--- এমন চেঁচাচ্ছো কেনো? অন্যকেউ শুনলে কতটা বাজে ভাববে কেন ইউ ইভেন ইমাজিন!

এদিকে যুবক রাগের মাথায় যে এতোটা কাছে এসে পড়েছে যে তার নিঃশ্বাস ছিটকে পড়ছে রমণীর মুখে তা তার মাথায় নেই। কিন্তু বিথীর তো ভয়ে ও লজ্জায় শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সে চোখ বন্ধ করে চুপ হয়ে আছে।

সামনে থাকা নারীর কাছে তার কর্মের কারণ জিজ্ঞেস করেও না জানতে পেরে আরও মেজাজ খারাপ হয়ে যায় যুবকের। বাজপাখির ন্যায় তীক্ষ্মদৃষ্টি স্থাপন করে আবার জিজ্ঞেস করে,

--- কি হলো বলছো না কেনো?

কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব আসে,

--- আ-আপনি কাপড়চোপড় না পড়ে বের হয়েছেন কেনো?

বিধান এবার আসলেই খেয়াল করে সে টাওয়াল পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে নিজের দোষ ভেবে শান্ত হলেও মুহূর্তেই রাগ উঠে যায় তার এই ভেবে যে তার কাছাকাছি আসার জন্য শত মেয়ে পাগল। সেখানে তার নিজের ভালোবাসার মানুষ, বউ তাকে এভাবে দেখে এমন প্রতিক্রিয়া করছে। এক ধাক্কায় বিথীকে ছেড়ে নিজের স্টাডিরুমের দিকে চলে যায় সে। যেতে যেতে বললো,

--- যত্তসম মিডেলক্লাস মেলোড্রামা!

বিথী বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে ঢুকরে কাঁদছে। পিছনে বেড থাকায় সে পড়ে যেয়ে খুব একটা ব্যথা না পেলেও খাটের কোণের ধারালো অংশ লেগে পায়ের কিছুটা জায়গা কেটে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তার। তবে সে ব্যথায় কাঁদছে না, অশ্রুকণার প্রবাহ হচ্ছে অপমানবোধে।

আনমনেই কাতর গলায় বলে উঠে,

--- এতো কি পাপ কামিয়েছি জীবনে যে আর্থিক অবস্থা নিয়ে এতোটা অপদস্থা হচ্ছে? আল্লাহ কখনো যে এমন পরিস্থিতিতে ফেলোনি আমায়, তাহলে আজ... বড্ড কষ্ট হচ্ছে এসব সহ্য করতে।  

কিছু সময়ের মাঝে নিজেকে সামলে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।

সে এখন কুমারী নেই, বরং কারো স্ত্রী, কারো বউমা, পুরো পরিবার ও সংসার দায় তার কাঁধে। তাই এসব খারাপ লাগাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই চলতে হবে তার।

বিধান বেডরুমে এসে দেখে বিথী বাথরুমে। তাই একাই নিচে চলে যায়। মিসেস চৌধুরী ছেলেকে নিচে আসতে দেখে মুচকি হাসে।

--- গুডমর্নিং আব্বু। তুমি একা আসলে যে সুরাইয়া মামনি কোথায়?

বিধান চেয়ারে বসতে বসতে গম্ভীর গলায় উত্তর দেয়,

--- সে ফ্রেশ হচ্ছে, খাণিকটা সময় লাগবে মনে হয় তার।

ছেলের গম্ভীর কণ্ঠে মিসেস চৌধুরী বুঝতে পারলেন এই বিবাহবন্ধন তার কাছে এখনো অবহেলিত ও উপেক্ষিত। তবুও এ নিয়ে সে একটুও চিন্তিত না কারণ মানুষ চিনতে তার ভুল হওয়ার কথা না। তার বিশ্বাস বিথী অল্প দিনেই সেই মেয়েকে সরিয়ে তার ছেলের মনে জায়গা করে নিবে।

--- বিধান, কাজটা তুমি একদমই ঠিক করোনি। মামনি নতুন এই বাড়িতে তাকে তোমার সাথে করে নিয়ে আসার দরকার ছিলো।  

--- উফ! মা সে নতুন তবে খুকি নয়।

--- একজ্যাক্টলি, মাম্মা ডোন্ট ওয়ারি শি উইল কাম। এতো চিন্তা করছো তার জন্য যেনো সে তোমার আপন মেয়ে।

কথাটা বলতে বলতে টেবিলের সামনে এলো বিধানের দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া বোন, নাম রূপ। রূপ মিসেস চৌধুরীর ভাসুরের মেয়ে হলেও তার অভিভাবকের মৃত্যুর পর নিজের আপন কন্যার মতোই লালনপালন করেছে সে। বর্তমানে মা ও ভাই উভয়েরই কলিজার টুকরা সে। তাই একটু বিগড়ে যাওয়াই বলা যায়।

মিসেস চৌধুরী মেয়েকে চোখ রাঙিয়ে বলে উঠে,

--- রূপ! বেশি কথা নয়।

--- ওকেহ সরি মাম্মা।

বিথী ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসে দেখে বিধান এখনো আসেনি। এদিকে পেট তার ক্ষুধায় চোঁচোঁ করছে, সে বিড়বিড় করে বলে উঠে,

--- এই পাষাণ লোকটা এখনো আসেনি কেনো নাকি আমাকে ছাড়াই চলে গেছে?

বিথীর ভাবনার সুতো কাটে কারো দরজায় নক করায়। সে যেয়ে গেট খুলতেই দেখে চৌধুরী ম্যানশনের সার্ভেন্টের মাঝে একজন। তাই প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে সামনে তাকাতেই মেয়েটি হাসিমুখে বলে,

--- ম্যাম আপনাকে বড় ম্যাম নিচে ডাকছে।

--- জী, চলেন তবে আমায় ম্যাম বলে ডাকবেন না। আমাকে নাম ধরে কিংবা আপু বা ভাবি বলেও ডাকতে পারেন।

--- আচ্ছা ভাবি। তবে আমাকেও তুমি করে সম্বোধন করবেন।

--- হুম।

চলবে...

Comments

    Please login to post comment. Login