মায়া গণ্ডি
পর্ব ৮
মোহাম্মদ নূর
লতিফ মিয়া বললেন,
“কি, ঘাট দেখার শখ মিটেছে?”
নজরুল বলল,
“কাকা, ঘাটে তো ঐরকম কিছুই দেখলাম না।”
কিন্তু নজরুল যে জায়গাটা দেখে কতটা ভয় পেয়েছিল, তা তার মন জানে, আর আল্লাহ জানেন সে মূল কাহিনি জানার জন্য মিথ্যা বলল।
লতিফ বলল,
“আমারে কি পাগল মনে করছ? আমি তোর মুখে ভয় পরিষ্কার দেখতাছি।”
নজরুল হাসলো আর বলল,
“এইটা দেখে ভয় পাওয়ার কি আছে? আপনি যদি এর কাহিনি বলে আমাকে ভয় দেখাতে পারেন তাহলে বলব যে কালি ঘাটে রহস্যময় কিছু আছে।”
লতিফ বলল,
“আমি যদি ভয় দেহাইতে পারি, তবে তুই আমারে কি দিবি?”
অন্যদিকে ঐশ্বর্য দীর্ঘ ঘুম থেকে উঠে বসলো,
সাহিনা জিজ্ঞেস করল,
এখন কেমন লাগছে তোমার?”
ঐশ্বর্য বলল,
“আমি ঠিক আছি।
সাহিনা খেয়াল করল ঐশ্বর্যের হাতে অনেক আগের একটি আঘাতের দাগ আছে। তাই সে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার হাতে এটা কিসের দাগ?
ঐশ্বর্য বলল,
এটা আমার বেশি বারাবাড়ির ফল। সেদিন রাতে হয়তো আমার বারাবারিটা না হলে অনেক প্রাণ বাঁচতো, এটা সেই ভুলেরি প্রমান।
সাহিনা স্পষ্ট দেখতে পেল ঐশ্বর্যের চোখ-মুখে নিরবতার ছাপ, কথা বলতে গিয়ে সে ঢলে পরছে।
সাহিনা জিজ্ঞেস করল,
তুমি ঠিক আছো তোমার খেয়ে নেওয়া উচিত।
ঐশ্বর্য বলল,
না আমি খাবো না। এই বলে সে চুপ করে বসে রইলো।
সাহিনা বসে না থেকে ঐশ্বর্যর মাথায় হাত রেখে বলল গাড়ি আসছে আমি তুমাকে বাড়ি নিয়ে জাবো কিন্তু তুমি কি এখন বলতে পারবে
“কোন রাতে? কে মারা গিয়েছিল? এটা কি কালি ঘাটের ঘটনা?”
ঐশ্বর্য বলতে শুরু করলো, ওই দিকে লতিফ মিয়াও বলতে শুরু করলো।
(ফ্ল্যাশব্যাক ১৯৮৭)
দুপুর গড়িয়ে বিকেল এখনও বৃষ্টি থামেনি। স্কুল ছুটির পর ঐশ্বর্য আর ইউসুফ স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। একসময় দুজন লোক আসে, হাতে ছাতা নিয়ে। ঐশ্বর্য একজনকে চিনতে পারে, কিন্তু আরেকজনকে চিনতে পারেনা।
প্রথম লোকটি সালাম দিয়ে বলল,
“আসসালামুওয়ালাইকুম ঐশ্বর্য আপা, কেমন আছো?”
ঐশ্বর্য হাসি দিয়ে বলল,
“আরে রোহিম ভাই, তুমি দুই দিন আসো নাই কেন?”
রোহিম হলো রহমান বাড়ির কাজের লোক, গ্রামের মানুষরা সবাই তাকে রহমান পরিবারেরি একজন মনে করে। রোহিম দাঁত বের করে হাসে, বলল,
“দুই দিন শরীরডা খারাপ আছিলো আপা।”
ঐশ্বর্য রেগে গিয়ে বলল,
“রোহিম ভাই, আমাকে ‘আপা’ ডেকো না। আমি তোমার ছোটো, আমাকে ‘ঐশ্বর্য’ বলে ডাকো। এখন শরির কেমন আছে তুমার
রোহিম আবার হাসে আর বলে,
ভালা আছি আপা... মানে ঐশ্বর্য..। ইউসুফ জিজ্ঞেস করলো,
“ও রহিম ভাই, এইডা কেডা?”
রোহিম বলল,
“এইডা বট্টিগাড, নুরুল দাদার জন্যে।
ইউসুফ হেসে বলল,
“ভাই, এটা বট্টিগাড না, বর্ডিগার্ড।”
সবাই হেসে উঠে। ঐশ্বর্য খেয়াল করলো এই ছেলেটা একবারও মাথা উচু করে তাকায়নি, মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে।
ঐশ্বর্য বলল,
“চলো বাড়ির দিকে যাই।”
বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমছে। ইউসুফ জিজ্ঞেস করল,
“আপনার নাম কি?”
ছেলেটি হেসে বলল,
“আমি জায়েদ নওয়াজ। তোমার নাম ইউসুফ, তাই না?”
ইউসুফ বলল,
“হ্যাঁ, আপনি কেমনে জানলেন?”
নওয়াজ বলল,
“আমি সব জানি।”
ঐশ্বর্য হাতে ছাতা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। তার মনে ভাবনা জাগলো ছেলেটা গরিব? ভাষা-আচরণ ঠিক যেনো কোনো শিক্ষিত ঘরের বড়লোক সন্তান।
ইউসুফ জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কি সব জানেন?”
নওয়াজ ধীরে ধীরে সব বলে দিলো। ঐশ্বর্য অবাক হলো।
রহিম বলল,
“এই সব তো তোমার দাদু বলেছে।
ঐশ্বর্য বুঝল, দাদুই তাকে পাঠিয়েছে।
তারা বাসায় পৌঁছালো। ঐশ্বর্য বলল,
“আম্মা, আমরা চলে এসেছি।”
সেই চিরো চেনা কণ্ঠে উত্তর এলো,
“হ্যা, আগে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বস।
ঐশ্বর্য আর ইউসুফ ঘরে ঢুকে কাপড় বদলে হাত-মুখ ধুতে গেল। ঐশ্বর্য লক্ষ্য করলো ছেলেটা বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
ঐশ্বর্য রান্নাঘরে গিয়ে তার মাকে বলল,
“আম্মা, ঐ ছেলেটাকে একটু জিজ্ঞেস করো সে কি কিছু চাইছে কিনা, অনেকক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।”
শান্তি নরম কণ্ঠে বলল,
“যা বলতে এসেছিস বল কথা ঘুরাস না।”
ঐশ্বর্য বলল,
আসলে.... আচ্ছা
খাওয়া শেষ হলে কথা বলবো।”
শান্তি বলল,
“খেয়ে ঘরে বস, আমি আসছি।”
ঐশ্বর্য চলে গেল। শান্তি খুব বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতী, সে মানুষের মনের ভাব বুঝতে দেরি করেন না।
খাওয়া শেষ, বিকেলের পরিবেশ একদম ঠাণ্ডা। মনে হচ্ছে রাতে বড় ঝড় আসবে।
অন্যদিকে, এস.পি আকাশ পুলিশ স্টেশনে বসে নিজের মধ্যে বিচলিত।
কনস্টেবল তাকে বলল,
“স্যার, কালি ঘাটের মামলা নিয়ে কি প্রেসারে আছেন?”
আকাশ হকচকিয়ে উঠল,
“না, ভাবছিলাম এক জনের কথা।”
কনস্টেবল জিজ্ঞেস করল,
“কাকে নিয়ে ভাবছেন স্যার?”
আকাশ হঠাৎ বলল,
“প্রকৃতির মাঝে এক শ্রেষ্ঠত্বের মাঝে দেখেছি তাকে, যার চোখে তাকিয়ে হাজার বছর কাটানো সম্ভব।”
একজন সুন্দরী
কনস্টেবল তাকিয়ে আছে বোকার মতো
আকাশ হেসে বলল,
তুমি বুঝবে না।”
ঠিক তখন বাইরে থেকে একজন মেয়ের কণ্ঠ শুনা গেলো,
“আমাকে ভিতরে যাইতে দেন, আমার যাওয়া জরুরি।”
আকাশ দেখতে গেলো, একজন মেয়ে স্কুল ড্রেস পরে স্টেশনে এসেছে। হাবিলদার তাকে ভিতরে যেতে দিচ্ছে না।
আকাশ বলল,
“কি হচ্ছে এখানে?”
হাবিলদার বলল,
“স্যার, আপনার জিরোনোর সময়, ভেতরে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না।”
মেয়েটি বলল,
“কমপ্লেন ফাইল করতে এসেছি, আপনার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা আছে স্যার।”
আকাশ ভরকে বলল,
“আমি কি বলছি, আমার জিরোনোর সময় ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেবে না?
হাবিলদার মাথা নিচু করে বলল,
“স্যার, আমি ১৭ বছর এই স্টেশনে চাকরি করি। যারা এর আগে এসেছিলেন তারা সবাই এমনি ছিলেন।”
আকাশ বুঝতে পারল এতে হাবিলদারের কোনো দোষ নেই।
সে আরো বলল,
তাকে ভিতরে যেতে দাও।”
হুমাইরা এসে বাবার ঘটনা খুলে বলল, তারপর ঐশ্বর্যর লিখা চিঠিটা দিল আকাশের হাতে।
আকাশ বলল,
কি এটা?
হুমাইরা বলল এইটা ঐশ্বর্য দিছে আপনার জন্যে।
আকাশের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। সে মেয়েটিকে বসতে বলল এবং চিঠি পড়তে শুরু করল—
চিঠি:
আসসালামুওয়ালাইকুম,
আশা করি ভালো আছেন। বেয়াদবি মাফ করবেন গুছিয়ে লিখার সমিয় নেই , আমার উচিত ছিল স্টেশনে এসে সরাসরি আপনার সঙ্গে কথা বলার। আমাদের পরিবারের এমন কোনো পরিস্থিতি নেই আমাকে জেতে দিবেন না, তাই স্টেশনে আসতে পারিনি। আশা করি চিনতে পেরেছেন।
আমার খুব কাছের একজন মানুষ—হুমাইরা, যে এই মুহূর্তে আপনার সামনে আছে, আপনি চিঠি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তার মুখে সব শুনেছেন হয়তো।
আমাদের গ্রামে প্রচলিত ঘটনা আছে, আগে এমন ঘটেছে— যারা দাবি করেছে কালি ঘাটে ভুত দেখেছে, তারা হয়তো পাগল হয়ে যায়, নাহলে তাদের লাশ কালি ঘাটের নদীতে বাজে অবস্থায় ভাসতে দেখা যায়।
এইবারও এমন কিছু ঘটবে। আপনি কিছু একটা করুন, আজকের মধ্যেই। আজ রাতে কালি ঘাটে না গেলে হুমাইরার বাবাকে বাঁচানো যাবে না।
আমার বিশ্বাস, কালি ঘাটে ভুত বলতে কিছু নেই, এর পেছনে যেই আছে খুব রহস্যময় কারোর হাত আছে। কেউ আমাদের থেকে লুকোতে চায়। দয়া করে আজকেই কিছু করুন, নাহলে সব শেষ হয়ে যাবে।
হয়তো ভাবছেন আমরা ছোটো মানুষ, আমাদের ভুল ধারণা। তাই আমি দাদুকে পাঠিয়েছি, সে আপনাকে গ্রামে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বলবে। আবারো বলছি, বেয়াদবি মাফ করবেন।
ইতি - ঐশ্বর্য
আকাশের চোখ কপালে উঠে গেলো। সে ভাবতে লাগল,
“আমার মাথায় কেন আগে এই চিন্তা আসেনি?”
সে সাথে সাথে মিশন x নামন একটি এফ.আই.আর করল। হুমাইরাকে কিছু কঠোর কথা শুনালো—
“আপনারা কি পুলিশের ওপর ভরসা করেন না? আপনার বাবা কাল থেকে নিখোঁজ, আগে কেনো জানাননি।”
আকাশ চেঁচিয়ে বলল,
“সবাই রেডি হও! রাতে মিশনে বের হতে হবে। দুই কনস্টেবল এখনই কালি ঘাটের সামনে পাহারায় পাঠিয়ে দাও, কেউ ভিতরে ঢুকতে পারবে না।”
আকাশ তার উপরের অফিসারের কাছে ফোন করে সব খুলে বলল। পরে স্ট্যান্ডার্ড অর্ডার পেলো, একটি স্পেশাল টিম লাগবে কারণ সে জানে না ওখানে যা ঘটছে তার পেছনে খুব ভয়ংকর কেউ আছে কিনা! তারা কতোজন তাউ জানা নেই। যেই আছে, তাকে সহজে পরাজিত করা যাবে না।
আকাশ হুমাইরাকে বলল,
“আপনি এখন যেতে পারেন। কেউ তাকে বাসায় দিয়ে আসুন।”
হুমাইরা বলল,
“আমি ঐশ্বর্যের বাসায় যামু।”
আকাশ বলল,
“তাকে রহমান বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসুন।”
হুমাইরা এসে পৌঁছালো রহমান বাড়িতে। ঐশ্বর্য তার মাকে মানিয়ে নিয়েছে, তার দাদুও রাজি হয়েছে জাওয়ার জন্য। নুরুল রহমান আগেই চলে গেছে। এখন ঐশ্বর্য, শান্তি, হুমাইরা, রহিম ও নওয়াজ ঘাটের দিকে এগোচ্ছে। নওয়াজ সবার পিছনে, রহিম সামনে, তাদের মাঝখানে ঐশ্বর্যরা।
ঘাটের কাছে এসে তারা মানুষের চিৎকার শুনতে পেলো।
হুমাইরা কিছু না ভেবে আব্বা বলে দৌড়ে ঘাটে ঢুকে গেলো, ঐশ্বর্য পিছনে দৌড় দিল।
ঘাটের সামনে এসে সে তার জীবনের প্রথম বীভৎস ও ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে পেলো।
সে স্তম্ভিত হয়ে গেলো, মনে হলো সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, কান দিয়ে গরম হাওয়া বের হচ্ছে।
চাঁদের আলো ও পাশের আগুনের আলোতে ঘাট ঝলমল করছে।
সে দেখল, কালি ঘাটের প্রধান কাঠের গেইটের সামনে কয়েকটি মরদেহ ঝুলানো, নিচে পড়ে আছে আরও কিছু মৃতদেহ।
প্রতিটি লাশের শরীর রক্তাক্ত ও ভীষণ রকমের বীভৎস।
ঝুলন্ত লাশ থেকে অঝরে রক্ত পড়ছে।
হুমাইরাকে কেউ টেনে বাঁশঝাড়ের পিছনে নিয়ে গেল।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্য, যেন ইচ্ছা করে সাজানো হয়েছে ঐশ্বর্যকে দেখানোর জন্য।
সে দেখলো সবার মাঝখানে উপরে ঝুলছে রহমান বাড়ির প্রধান, তার দাদু নুরুল রহমানের লাশ।
সে হিমু বলে ডাকতে গেলো, সেই সময় কেউ তার মাথায় জোরে আঘাত করল।
ঐশ্বর্যের চোখ অন্ধকার হয়ে গেলো, এরপর আর কিছু মনে নেই তার।
ঘটনার পরদিন, সারা দেশে প্রথম আলো পত্রিকায় একটাই খবর—
এক রাতে চন্দনপুর গ্রামের কালি ঘাটে ২৯টি লাশ ও ৫৬টি কঙ্কাল পাওয়া গেছে।
২৭ জন আইনজীবি, একটি ১৭ বছর বয়সী মেয়ে এবং ব্রিটিশ আর্মির সদস্যর ছেলে মেজর নুরুল রহমান।
খুনি সনাক্ত করা যাচ্ছে না। মেয়েটি ধর্ষনের শিকার।
এই কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সাহিনার হাত-পা কাপতে লাগলো। সে দ্রুত ইনহেলার বের করে মুখে লাগাল।
অন্যদিকে লতিফের মুখে এই ঘটনা শুনে সঙ্গে সঙ্গে নজরুল ও তার সঙ্গীরা শীতের দিনে ঘেমে একাকার।
সবার চোখ কালি ঘাটের দিকে, সবার চোখে সেই রাতের দৃশ্য ভাসছে।
নজরুলের শরীর ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।
সাহিনা কিছুটা সুস্থি নিয়ে বলল,
“তাহলে কি সত্যিই কালি ঘাটে অপশক্তির বসবাস আছে?”
ঐশ্বর্য বলল,
(মানুষই সব থেকে বড় অপশক্তি)
এবার ঐশ্বর্য হাসতে লাগলো, যেন এক অতৃপ্ত আত্মা।
ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
পর্ব ৯ শিগগিরই আসবে।