Posts

নন ফিকশন

পারিশ্রমিক

August 3, 2025

Kazi Eshita

204
View

পারিশ্রমিক 

কাজী ফাল্গুনী ঈশিতা  

সাল ২০০৩। মাধ্যমিকের প্রথম পর্ব (ইংরেজি মাধ্যমে আপনি চাইলে মাধ্যমিক কয়েক পর্বে ভেঙ্গে দিতে পারেন। ও লেভেল এমনিও বছরে দু বার, জানুয়ারী আর মে তে হয়ে থাকে ) । দেবার পর বেশ কিছু দিনের অবসর।  ভাইবোনের সবার ছোট হওয়ায় আদরের পাল্লাটা আমার দিকে সব সময় ভারী, আলহামদুলিল্লাহ। আমার তখন দিন কাটছিল ছবি এঁকে, গান গেয়ে, টুকটাক লিখে, আর এক বছরের ছোট্ট ভাইপোকে বুকে নিয়ে।  যেহেতু সবার ছোট আমি, নিজের আদরে কমতি না থাকলেও আল্লাহ্‌র  কাছে সব সময় চাওয়া ছিল,  আমার থেকে ছোট এমন কেউ থাকুক জীবনে, যাকে আমি স্নেহের বর্মে ঘিরে রাখতে পারি ।  আমার ভাইপোটি, এবং পরবর্তীকালে ওর বাকি দুই ভাই বোন পৃথিবীতে এসে আমার এই চাওয়া টা পূরণ করেছিল। আজও এরা তিন জন, যোগ আমার বড় বোনের দুই জন, এই পাঁচ জন মানে আমার কাছে এমন এক শক্তির উৎস, যা আমার চরম খারাপ অবস্থায়ও আমাকে টেনে তুলতে সক্ষম। 

আমরা থাকতাম আমাদের বিল্ডিং এর চার তলায় তখন।  দোতলায় ছোট্ট একটি একক পরিবার। মধ্যবয়সী বাবা মায়ের এক মিষ্টি দশ বছর বয়সী পুত্র। আমাদের গাড়ীটি গ্যারেজে থাকতো দোতলার গাড়ীর সামনে।  প্রতিদিন সকালে এই দুষ্টু -মিষ্টি ছেলেটি দরজার ঘণ্টা বাজাতোঃ 

“আপু, ওই, আপনাদের গাড়ীটা একটু সরাতে হবে।” 

তবে আমার গলা তখন দুটো তুলতুলে হাতের দখলে, আর কাঁধে একটা ছোট্ট গোল মাথা। আমার কণ্ঠে তখন ঃ “আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা...” আর নয়ত ”Rock a bye baby, on the treetop... “ কোলেরটিকে  আর একটু আগলে ধরে হালকা চেঁচাতাম ঃ “ও ভাইয়া আ আ... গাড়ী ই ই ...”

এর কিছুদিন পর থেকে এই ছেলেটি আসার একটু আগে থেকেই লজেন্স হাতে তৈরি থাকতাম। ঘণ্টা বাজার আগেই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেলে দরজা খুলে হাতে লজেন্স ধরিয়ে গাল টিপে দিতাম ওরঃ 

“যাও বাড়ী যাও, আমি গাড়ী সরাবার কথা বলছি।” লাজুক হেসে চলে যেতো ছেলেটি। 

মাস খানেক পর একদিন শুনি আম্মু আর দোতলার আনটি র কথোপকথন ঃ 

“ঈশিতা কি পড়াতে পারবে?  আমার ছেলে নিজেই বলছিল পড়তে চায়। ও পছন্দ করে ঈশিতার আদর।” 

আমার কিছুটা আক্কেল গুড়ুম! এ ছেলের মুখে কথা সরে না, ও কি সহজ হতে পারবে আমার সাথে? আবার খুশি ও হয়েছিলাম, কচি মনে নিজের জন্য জায়গা করে নিতে পেরেছি ভেবে। 

প্রথম দিন পড়াতে গিয়েই বুঝলাম, কিছুটা সহজ হয়ে গেলেই ব্যাস! বোবা মুখে কথার ফুলঝুরি ছোটে! এ ছেলেটি ছাত্র হিসেবেও বেশ মেধাবী ছিল। সে তার বাড়ীর কাজ প্রায় সব নিজেই শেষ করে রেখে দিত। আমার কাজ ছিল কেবল সেগুলো ঠিক করা আর ওর দুর্বল জায়গা গুলো বুঝে নিয়ে গল্পের ছলে সেগুলোর প্রতি ওর আগ্রহ তৈরি করা।  আমরা অনেক গল্প করতাম। পড়তে পড়তেই এ ছেলেটি কখনো আমার  পিঠে, কখনো আমার চুল দিয়ে খেলা শুরু, কখনো পাশের চেয়ার থেকে কোলে মাথা ফেলে দিত। কোন দিন বাধা দেইনি ওকে।  এক মাসের মধ্যেই আক্ষরিক অর্থে ছোট ভাই হয়ে উঠেছিল সে। দ্বিতীয় শ্রেণীর এই ছেলেটিকে পড়াতে গিয়ে নিজের অজানা বিষয় গুলো জানা হয়ে যাচ্ছিলো। 

প্রথম মাসের শেষে একদিন নাস্তার ট্রে হাতে ছেলের ঘরে ঢুকলেন আনটি।  ছেলের চোখ বাঁচিয়ে চায়ের পিরিচের নিচে একটা সোনার দোকানের খাম চাপা দিলেন। ফিস ফিস করেই বললেন ঃ “ওই ওটা তোমার  জন্য, ফারজামের তরফ থেকে।” 

বাড়ী ফিরে দেখি, খামে চারটা নতুন নোট, দুটো পাঁচ শো টাকার, আর বাকি দুটো এক শো। সে সময়ের বারোশো টাকা মানে আজ প্রায় পাঁচ হাজার টাকার মত।  বছর তিনেক পড়িয়ে ছিলাম ওকে, টাকার অঙ্ক ও বেড়ে ছিল।  সে বয়সে প্রথম পারিশ্রমিকের আনন্দ, লিখে বোঝানো যাবে না। 

আম্মু বললেন, চলো, সোনার দোকানের খামে তোমার  প্রথম রোজগার, তুমি এখানেই চলো।  দোকান থেকে একটা ছোট্ট সোনার লকেট কিনেছিলাম ছয়শো টাকা দিয়ে, আল্লাহ্‌র নাম লেখা।  বাকি ছয়শো র কিছু টাকা দিয়ে কিছু আপেল, কারণ ভাইপোটি ওর কচি কচি নতুন দাঁতে আপেলের টুকরো খেতে ভালোবাসতো। কিছু টাকা দিয়ে দুটো মুরগী, আর বাকিটুকু ব্যাংক এ।  সেদিন রাতে বাড়ীর সবার জন্য মুরগী - পোলাও রেঁধেছিলেন আম্মু। 

আজ এতো বছর ধরে ওই একই দোকান আমার সমস্ত সোনার গয়নার শখ মেটায়।  সোনা, রুপা, পিতল, মাটি, পুঁতি... সব ধরণের গয়না ভালোবাসি আমি, তবে তা হতে হবে খুবই হালকা, সুন্দর নকশা আর দামে সাশ্রয়ী। 

আপনি ছবি আঁকতে পারেন? মেহেদি পরাতে? হয়তো চাকরির আশায় বসে থেকে নিজেই নিজেকে চড় মারছেন “আমি বেকার” বলে। এমন ছোট ছোট শখ থেকে ছোট ছোট রোজগার শুরু করুন, আত্মবিশ্বাস বাড়বে। চারাগাছ থেকেই ধীরে ধীরে ডাল পালা ছড়ায়।  সেদিনের সেই ছোট্ট আমি হাতের কাছে পাওয়া প্রতিবেশী ফারজামকে  নিয়ে শিক্ষা, শেখানোকে ভালবাসতে শুরু করেছিলাম। শেখানোর সেই শখ থেকেই  আজ আমার পেশা শিক্ষকতা। আর এর ভেতর পাওয়া সম্পর্ক গুলো, মিষ্টি মুহূর্তগুলো এক কথায় অমূল্য। 

তাই কোন পরীক্ষা পাশ করেই অযথা বেশি বেতনের আশায় বসে না থেকে, পরীক্ষার পরের অবসর সময়টা, ছোট ছোট অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করুন। ছোট্ট একটুখানি টাকা ও কিন্তু আপনার নিজের রোজগার, যার আনন্দ সীমাহীন। 

*প্রিয় আনিস ওবাএদ, যাকে আমি ফারজাম বলেই ডাকতাম, বেঁচে থাকলে আজ তুমি ২৫ -২৬ বছরের যুবক। নিজের মেধা কে পৃথিবীর কোথাও কাজে লাগিয়েছ আশা করি। জানিনা এ লেখাটি তোমার চোখে পড়বে কিনা। যেখানেই থাকো, সব সময় ভালো থেকো। 


 

9th June, 2020


 


 



 

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Mst Mukta 3 months ago

    অসাধারণ লেগেছে।

  • Kazi Eshita 3 months ago

    @farddin আমি ফেসবুক ব্যবহার করিনা

  • farddin on fire 3 months ago

    https://www.facebook.com/share/16py92QXsQ/ aita amar Facebook link aktu nok diyen

  • Shassue mllah 4 months ago

    যে বলে আমি বেকার আমি বলি সে অন্ধ । হাত পা থাকলে পৃথিবীতে কেউ বেকার না