বনরোদ্দুরের গ্রামের সন্ধ্যা ছিল একরকম মোহময়।
সন্ধ্যার পর বড় বড় বটগাছের ছায়া আর ঝোপঝারের ফিসফিসানি নিয়ে একপ্রকার গা ছমছমে পরিবেশ।
এই সন্ধ্যা বেলায় রুপা, রেনু ও রিমি অন্ধকার উঠানে বসে ডুবুনতো সূর্য দেখছে আর গল্প করছে।
এমন সময় তাঁদের মা রুম্পার ডাক পরে, "কেরে তোদের পড়তে বহন লাগেনা ?" সামনে না রুপা তোর মেট্রিক পরীক্ষা" রুম্পা কথাটি বললো একটু ঝাঁঝালো ভাবে।।
মায়ের বকুনি খেয়ে তিনজন হাত পা ধুয়ে ঘরে গেলো পড়তে।
১ম অধ্যায়
রুপা বাড়ির সবার আদরের ছোট মেয়ে, তাই জেদ একটু বেশি। সে আবার ঘরে কেউ থাকলে পড়তে বসতে পারেনা। তার নাকি পড়ায় মনোযোগ দিতে সমস্যা হয়।
বাড়ির বড় মেয়ে রেনু শান্তশিষ্ট, ভদ্র ও চুপচাপ এক কোথায় বলতে গেলে লক্ষী মেয়ে একটা।
তার আবার এসব এ সমস্যা হয়না ঘরে কেউ থাকুক পড়তে তার অসুবিধে নেই। পড়ালেখাতেও বেশ ভালো।
সে মেট্রিকে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে পাস করেছিল।
রুপা জেদি, খিটখিটে মেজাজের হলেও সেও বেশ ভালো পড়া লেখায়। ক্লাসে ১ ও ২ ছাড়া রোল হয়না।
বেশ মেধাবী। সে তার মেধার জন্য সবার কাছে আরো বেশি আদর পায় ।
মামা বাড়িতেও তার বেশ সুনাম এই রেজাল্ট এর জন্য। তার বড় মামা ' রুপা 'মামা বাড়ি গেলে রিমি কে বলেন "কেরে ছেড়ি রুপার মতো হইতে পারোসনা?"
হারাদিন খালি টো টো করে ঘুরণ লাহে?
রুপা তোর ২ বচ্চরের ছোডো তাও তোর কেলাশেই (ক্লাস ) পড়ে। ওর থাইকা কিছু শেখতে পারোসনা?
রিমি : আচ্ছা আব্বা শিখবা নি । রিমি একটু মন খারাপ করে বলেছিলো কথাটা।
বর্তমানে রিমি রুপার সাথে তার বাবার কথা মতো পড়তে বসতে আসছিলো । রিমির ঘরে ঢুকা দেখে রুপা হৈহৈ করে ওঠে বলে "কিরে তুই এইখানে আসছিস কেন? "
রিমি বললো "কেন আহন যায়তো না?"
রুপা : কেউ থাকলে আমার পড়তে সমস্যা হয়!
রিমি মুখ ভেংচিয়ে বলে " ঢং দেহ ছেরির, " আব্বা তোর কাছে পড়া শিখতে কইছে নাইলে আইতামনা তোর কাছে আমি ।।
রুপা : ইসরে রাগ করছিস? রাগ করিসনা বোন আমার। রুপার কোথায় রাগ করতে হয়না।
কথা গুলো রুপা মজা নিয়ে বললে রিমি রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে তার ফুফু রুম্পার কাছে গিয়ে নালিশ জানায়।
রিমি মেয়েটা অনেক অভিমানী একটুতেই রেগে যায়, কারো উপরে অভিমান করলে তার অভিমান ভাঙ্গানো বেশ কঠিন বেপার।
রুপা একবার রিমির এমন অভিমান আর একটুতেই রেগে যাওয়া দেখে ইয়ার্কি করে বলে " এই রিমি তুই যে এতো অভিমান করিস তোর অভিমান ভাঙানোর মতো মানুষ দুনিয়ায় পাওয়া যাবেনারে "
রিমি : তাতে তোর সমস্যা কি?
রুপা : আমার আবার কি সমস্যা,কিন্তু তোর অভিমান ভাঙানোর জন্য কোনো স্বামী পাবিনা আমার বনু ।
রিমি : এই ছেরি এইবার বেশি কইতাছোছ কিন্তু।
রুপা : ওহ বেশি বলে ফেললাম বুঝি।।
এই বলে রুপা দাঁত কেলিয়ে হাসতে থাকে, যেটা দেখে রিমির রাগ আরো তিড়িং তিড়িং করে কপালে ওঠে যায়। সেইদিন সেই কি তাঁদের ঝগড়া।।
২য় অধ্যায়
বর্তমানে রিমি রুম্পা কে নালিশ দিলে রুম্পা রুপাকে উদ্দেশ্য করে বলে " কেরে ছেড়ি মাইয়াডারে লইয়া এক লগে পড়লে কি ওয় ( হয়)? মাইয়াডা দুইদিন ফুফু বাড়ি আইছে থাকুনের লাইগা, কেরে এই দুইদিন ওর লাগে মানাইয়া লইয়া পড়তে পারোসনা?
রিমি যা তুই ওর ঘরেই পড়তে ব তারপর দেখবাম ওই তোরে কেমনে ঘর থাইকা বাহির কইরা দেই। ঐটা ওর ঘর না তুই নিশ্চিন্তে পড়তে ব যা
দিন দিন বদ্দের হাড্ডি হইতাছে, যেদিন মার পড়বো পিঠে সেইদিন বুঝবানি।
রিমি যখন রুপার ঘরের উদ্দেশে যাচ্ছিলো তখন এতো বোকা খাওয়ার পড়ো রুপা রিমির মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়।
রুম্পা এইটা দেখে রেগে গিয়ে বলে " এই ছেড়ি তুই এতো বেক্কল কেরে "? দরজা খোল কইতাছি নাইলে দরজা ভাঙ্গায় তোরে পিটাইয়া ভর্তা বানালাম।
এতসব চেঁচামেচি শুনে রেনু আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা সে এসে পরিস্থিতি ঠান্ডা করার জন্য রিমিকে বললো " ও রিমি তুই আমার লগে আমার ঘরত আয়। আমি তোরে পড়া শেখাইতাম । ওই ছেরির মেলা জেদ ওরে ওর মতো পড়তে দাও আম্মা ওই দরজা সারাদিন ধাক্কাইলেও খুলতো না। ওর সাথ আমি জানি আম্মা। "
রুম্পা রুপার উদ্দেশে বলে "তোরে আজ খাওন দিতামনা বদমাইশ ছেড়ি, তোরে বেশি আদর দিয়া বাঁদর বানায় ফেলছি "।
৩ অধ্যায়
রাত ৮টা
মনছের আলী ও আক্কাস আলী আসেন জমি থেকে।
জমিতে অনেক কাজ থাকায় আজ তারা দোকানে যায়নি। রাতে ফিরে আক্কাস আলী হৈ হৈ করে ওঠানে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে তার স্ত্রী রুম্পা কে ডাকেন " কই গো কই গেলা? ভাত বার খাইতাম আমি"
রুম্পা " ভাত বাড়ছি হাত মুখ ধুয়ে আসেন আপনেরা। "
মনছের আলী ও আককাস আলী হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে বসে।
মনছের আলী চেয়ার টেনে বসে। রুম্পা বলে "আব্বা আপনে খাইবেননা?"
"না খাইতাম না "বললো মনছের আলী। তিনি রুপা ও রেনুর দাদু। রুম্পা রেনু আর রিমিকে খেতে ডাকে কিন্তু
রুপাকে খেতে ডাকেনা, যেটা দেখে মনছের আলী বললেন "ছোডোটারে ডাকোনা কেরে বৌ? " "আব্বা আজ ওর খাওন নাই"বললো রুম্পা।
"কেরে খাওন নাই কা আমার বিবির? " বললো মনছের আলী। রুম্পা কিছু বলতে যাবে তখনি রেনু ও রিমি আসে খেতে। এসেই রিমি সব ঘটনা দাদুকে বলে। রিমির নিজের দাদু নেই সে রুপা ও রেণুর দাদুকেই নিজের দাদুর মতো ভালোবাসে। আর তাঁদের দাদুও রিমিকে নিজের নাতনীদের মতোই ভালোবাসে।
দাদু রিমিকে সান্তনা দিয়ে বলে" তোগো সামনে মেট্রিক পরীক্ষা এই জন্যই ওই এমন করতাছে "তুই ওর সাথে পড়তে বইতে যাসনা ওই তোরেও পড়তে দিবেনা নিজেও পড়বনা। আর তুই জানোসই তো ওই পড়ার সময় কাউরে চেনেনা।" যাইহোক ওই এমনিই ভালো অইবো " আয় খাইতে ব" আমি ওরে ডাইকা আনি গিই "
এই বলে মনছের আলী রূপাকে আনতে যায়,গিয়ে সে রুপাকে বুঝায় যেন এমন সে না করে। দুইদিন পর মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বাহিরে থাকতে হলে তাকে সবার সাথেই একই ঘরে থাকতে হবে। তাই সে যেন এখন থেকেই মানিয়ে নেই। এমন বুঝিয়ে শুনিয়ে রুপাকে আনে মনছেরআলী।
তারপর রাতের খাবার শেষে রুপা বলে "দাদু আজ গল্প শুনাবেনা?"
"হ শুনাইবাম" বললো দাদু।
তারপর তিনি ওঠানে আলগ চৌকি পেতে দিলেন ।
আলগ চৈকিতে একে একে রুপা, রেনু ও রিমি এসে বসলো। তারপর দাদু গল্প শুরু করলো।
৪র্থ অধ্যায়
মনছের আলী বললেন " আজ তোগো যে গল্প টা হুনাইতাম তা মিছা গল্প নয়, এইটা সত্যই ঘটছিলো এই গেরামে। " রুপা : "কেমন ঘটনা দাদু?"
দাদু :" দারা হুনাইতাছি" বললো মনছের আলী।
আমি যখন ছোডো আছিলাম তখন আমগো গেরামে একটা বড় মসজিদ আছিলো। মসজিদের ডান দিকে একটা বড় গাছ আছিলো। গল্প বলার সময় মনছের আলীর মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। সে গল্প বলার সময় ঘামতে থাকলো। সে বললো " আমি এমন ঘটনা আমার জীবনে আর দেহিনাই। "
সে বললো " বড় বট গাছটার ছায়ার নিচে হগগলে (সকলে ) বেছরাম (বিশ্রাম ) লইতো। সব ঠিকঠাকই
আছিলো কিন্তু ওই পাড়ার আশরাফ মাত্যবরের মাইয়া ফুলবানু..
ফুলবানু পর্যুন্ত বলতেই রুম্পা তাঁদের ঘুমানোর জন্য ডাকে, বলে " আব্বা রাত মেলা অইছে, কাল গল্প হুনায়েন আজ ওগো ঘুমাইতে পাঠান। কাল রুপার স্কুল
আছে আব্বা। "
রুপা : " মা গল্পটা শুনে ঘুমায়? "
রুম্পা : " না তাড়াতাড়ি ঘরত আয়"
মনছের আলী: "আচ্ছা বিকি গল্প কাল হুনকমু তোগো আজ ঘুমাইতে যা তোগো আম্মা নাইলে খেপ্পা যাইবো।"
এই বলে মনছের আলীতাঁদের গল্পের সভা ছেড়ে ওঠে ঘুমানোর জন্য ঘরে যায়। রুপা, রেনু ও রিমি আর একা একা বাহিরে বসে থেকে কি করবে তাই তারাও ঘরে ঘুমোতে যায়। রুপা মাঝখানে রিমি একপাশে রেনু আরেকপাশে শুয়ে আছে। রুপা ঘুমানো বাদ দিয়ে চিন্তা করছে কি এমন ঘটনা ফুলবানোর সাথে ঘটেছে তাই দাদু আর সেই ঘটনা ভুলতে পারেনা। কি ঘটতে পারে!
রুপা আপন মনে বিরবিরিয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছে আর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে। তার বিড়বিড়িয়ে কথা বলার জন্য রিমির ঘুম আসতে সমস্যা হচ্ছে তাই সে বলে ওঠলো "কেরে অহনো ঘুমাসনা কা? ফুফুরে ডাকবাম?" রুপা : "রিমি? "
রিমি ঘুমের ঘরে বললো "হু কো।"
রুপা : "ফুলবানুর সাথে কি হতে পারে আন্দাজ করতে পারিস?"
রিমি একটু বিরক্তি সরে বললো " আমি কেমনে জানতাম, আমি কি সে সময় আছিলাম নাকি? "
রুপা : "আচ্ছা তুই ঘুমা "
তিনজন ঘুমিয়ে পরে। পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই তারা তিনজন জানালার দিকে খেয়াল করলো কে জানি তাঁদের দেখছে, মুখ স্পষ্ট না হলেও তারা সেই ছায়া মূর্তিটি দেখে বুঝতে পারলো কোনো পুরুষ মানুষ।
তারা তিনজন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে রুম্পাকে ডাকলো।
রূপমা : "কি অইছে ডাকস কেরে?"
রেনু : "আম্মা জানালার ধারে জানি কেডা আমগো দেখতাছে।"
রুম্পা চমকে ওঠে জানালার দিকে তাকালো, সে কিজানি আন্দাজ করে বললো "আইচ্ছা তোরা ফজরের নামাজ পইড়া লো আমি দেখতাছি।"
তারা তিনজন রুম্পার কথামতো ফজরের নামাজ পরে পড়তে বসলো বারান্দায়।
আর অন্যদিকে রুম্পা ওই পুরুষালি অবয়বের পিছু নিলো, ওই পুরুষালি অবয়বটা তাঁদের বাড়ির পিছনে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলো।
রুম্পা এতক্ষনেও আসছেনা দেখে রুপা রুম্পাকে খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির পিছনে এসে দাঁড়ালো।
রুম্পা যেইনা ওই পুরুষের মুখটা দেখবে ঠিক তখনি রুপা এসে বললো " আম্মা এখানে আসলে যে?
কে ওই লোকটা আম্মা? "
রুম্পা পিছনে ফিরতেই দেখে লোকটি আর সেখানে নেই। রুম্পা কেমন একটা ভয়ার্থ ভাবে পিছনের ওই বড় বট গাছটার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে বললো " আমি তার মুখটা দেখতে পাইনাই, চো বাড়ি চো। "
দুইজন বাড়ি আসলে রুম্পাকে আক্কাস আলী বলেন "আমি বাজারে যায়তাছি, কিছু লাগবো তোমাগো লাগলে কও বাজার থেকে আহনের সময় আনবাম আমি।" রুম্পা কিছু বলার আগেই রুপা বললো " আব্বা আমার খাতা লাগবে। "
আক্কাস আলী : " আইচ্ছা আনবাম। "