Posts

চিন্তা

ট্যারিফ যুদ্ধ ও অতি নব্য সাম্রাজ্যবাদ!

August 3, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

80
View

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্কনীতিকে নিছক অর্থনৈতিক প্রতিরোধ বললে ভুল হবে। বরং এটি একবিংশ শতকের নতুন উপনিবেশায়নের সূক্ষ্মতম মারণাস্ত্র।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গেল ২ এপ্রিল এক নির্বাহী আদেশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেন। সেই তালিকায় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, মিয়ানমারসহ বহু দেশ রয়েছে। ওই আদেশ অনুযায়ী, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়, যা ছিল তালিকার উপরের দিকে। বাংলাদেশের শুল্ক ১৫ ভাগ‌ কমিয়ে এখন ২০ ভাগ করা হয়েছে। অন্য দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের ওপর ১৯ শতাংশ, আফগানিস্তানের ওপর ১৫, ভারতের ওপর ২৫, ব্রাজিলের ওপর ১০, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ১৯, মালয়েশিয়ার ওপর ১৯, মিয়ানমারের ওপর ৪০, ফিলিপাইনের ওপর ১৯, শ্রীলঙ্কার ওপর ২০ ও ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ওয়াশিংটন।

এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন সরাসরি বার্তা দিয়েছে -যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করতে হলে তাদের শর্ত মানতে হবে। তবে কৌশলটা এখানেই শেষ নয়। ৯ এপ্রিল হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়, এই শুল্ক আদেশ তিন মাসের জন্য স্থগিত থাকবে। অর্থাৎ, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সঙ্গে দর-কষাকষির জন্য একটি জানালা খোলা রাখা হয়। আর সেই জানালার ভেতর দিয়ে ঢুকবার সুযোগ রাখা হলো বোয়িং নামের অসীম হাওয়া।

বাংলাদেশ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিমান প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান বলেছেন, “বোয়িংয়ের ব্যবসা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নয়।” সত্য। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক আদেশের পরপরই এই সিদ্ধান্ত, আর তা থেকে শুল্ক ছাড়ের সম্ভাব্যতা, এটাকে নিছক ব্যবসায়িক লেনদেন বলা যায় না।
বোয়িংয়ের বিমান কেনার এমন সিদ্ধান্ত শুধু বাংলাদেশ নয় -ভারত ও ভিয়েতনাম কিনছে ১০০টি করে, ইন্দোনেশিয়া ৫০টি। বোয়িংয়ের বই খুললেই দেখতে পাওয়া যাবে -এটা কেবল একটি বিমান বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের পাতা নয়, এটা সাম্রাজ্যবাদের সমসাময়িক রূপরেখা।

এখনকার যুদ্ধ গোলাবারুদের নয়, ট্যারিফ আর ট্রেড ডিলের। বাণিজ্য ঘাটতির অজুহাতে ট্রাম্প প্রশাসন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এক নতুন প্রভাব বলয় তৈরি করতে চাইছে। এই 'ট্যারিফ ওয়ার' আসলে এক নিরব অর্থনৈতিক চক্রান্ত। দেশের অর্থনীতি যখন বড় শুল্কের চাপ নিতে পারে না, তখন তা নীতিনির্ধারকদের দুর্বল করে তোলে, রাষ্ট্র পরিচালনায় অনিশ্চয়তা তৈরি করে। এই সুযোগে আন্তর্জাতিক শক্তির 'ডিপ স্টে'ট' কার্যকর হয়ে ওঠে। বাধ্যগতভাবে আমরাও হয়ে উঠি বিশ্বমোড়লদের ক্রীড়নক।

খোদ মার্কিন লেখক জন পারকিন্সের বিখ্যাত বই 'Confessions of an Economic Hitman'-এ এমন অর্থনৈতিক চক্রান্তেরই ছায়া রয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে, কিভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে করপোরেট পুঁজি ও রাজনীতির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনামের মতো মধ্যম আয়ের দেশগুলো এখন সেই ট্যারিফ-নির্ভর পরোক্ষ আগ্রাসনের শিকার।

বাংলাদেশের অর্থনীতির গঠনগত বাস্তবতা ও এভিয়েশন খাতের সক্ষমতা বিবেচনায় ২৫টি বোয়িং কেনার সিদ্ধান্ত আলোচনার দাবি রাখে।  চরম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বড় উদাহরণ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বহরে অযথা বিমানের সংখ্যা বাড়িয়ে দেশের কী ফায়দা হবে? আমাদের বিমানে কারা চড়বে? বাস্তব চাহিদার ভিত্তিতে কি এই সিদ্ধান্ত, নাকি একপ্রকার কূটনৈতিক চাপের ফল? শুল্ক মওকুফের শর্ত হিসেবে বোয়িংয়ের পণ্য কিনে নেওয়ার প্রবণতা ভবিষ্যতে আমাদের বিদেশনীতি ও স্বাধীন অর্থনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। উপরন্তু শোনা যাচ্ছে আরো বড় বড় 'দেবে আর নেবে'র বিনিময়ে বাংলাদেশের ট্যারিফ সামান্য কমেছে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আমরা একসময় "ব্রিটিশ খেদাও" আন্দোলন করেছিলাম। আর এখন, অতি নব্য অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে "মার্কিন খেদাও" বলার সাহস আমরা অর্জন করতে পারব আর কবে? সেই সক্ষমতা আমাদের আদৌ কোনোদিন হবে? নাকি আমরা পরোক্ষ শাসনের নতুন ভারে মাথা নিচু করেই থাকব?

ট্যারিফ কমানোর সিদ্ধান্তে আমাদের ব্যবসায়ীদের চাপ হয়ত কিছুটা কমাবে, অন্তর্বর্তী সরকারও রাজনৈতিকভাবে কিছুটা ইতিবাচক ধারায় থাকবে; কিন্তু বোয়িংয়ের পাখায় চেপে আমরা যে এক নতুন উচ্চতায় উড়তে চাইছি -সেই আকাশটা আসলে কার? চালকই বা কে? আর গন্তব্যই বা কোথায়? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের নীতিনির্ধারকদেরই খুঁজতে হবে আজ এখনই।

লেখক: সাংবাদিক 
১ আগস্ট ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login