Posts

গল্প

ছোট্ট একটা ভালবাসা

August 3, 2025

Kazi Eshita

194
View

কাজী ফাল্গুনী ঈশিতা 


 

হাতে ধরা কাঁচের গ্লাস সজোরে মেঝেতে আছড়ে ফেললেন লাইলি বেগম। ঝনঝন শব্দে  ভেঙ্গে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল সেটা। শরবতের একটা ছোট খাটো পুকুর তৈরি হল মেঝেতে। 

ওহ আচ্ছা! ওই দেশে তো কাজের বুয়া নাই, না? আমাকে নিয়ে যাওয়া মানে তো   বিনি পয়সার একটা কাজের বুয়া পাওয়া, তাই না? 

আহ, লাইলি, আস্তে... মেয়েটা পাশের ঘরে ঘুমুচ্ছে। 

স্ত্রীকে থামানোর চেষ্টা করছেন শামসুজ্জামান। তাদের একমাত্র মেয়েটা  জন্মেছে মস্তিষ্কে টিউমার নিয়ে। মেয়ের চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাবার চেষ্টা করছেন শামস, তবে কেন যেন সব চেষ্টাই বৃথা যাচ্ছে। 

এত বার চেষ্টা করে ক্লান্ত লাইলি এখন আর দেশ ছাড়তে চাইছেন না, তার এক কথা, বাংলাদেশে সব সম্ভব। 

আরে রাখ তোর বিদেশ! তোর কথা শোনে কে রে ঘাটের মড়া?  তুই দুরে  গিয়া মর  গা যাহ! 

লাইলি রেগে গেলে তার কথার ভেতর শোভন আর অশোভন শব্দের এক শ্রুতিকটু খিচুড়ি  তৈরি হয়, শামসের তা অজানা নয়। 

স্ত্রীর অহেতুক রাগের তীব্র চিৎকার ভেদ করে শামসের কানে এসে লাগল মিষ্টি, শিশু কণ্ঠের ডাক ঃ বাবা! 

তীর বেগে পাশের ঘরে ছুটলেন শামসুজ্জামানঃ  বাবা এসে গেছি, মামনি! 

খাটে শোয়ানো  বছর দুয়েকের কন্যার প্রাণ জুড়ানো হাসিতেই সব  ক্লান্তি ধুয়ে গেল বাবার। 

কষ্টিপাথরের  মত গায়ের রং, ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে। তবে মাথাটা শরীরের তুলনায় বেশ বড় । এই হাসি দেখেই শামসের মা নাতনির নাম রেখেছিলেন তাবাসসুম। তবে নাতনির জন্মের মাস আটেক পর  আচমকা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন দাদী। 

দু কামরার ফ্ল্যাটে স্ত্রী কন্যা, আর পাশের ফ্ল্যাটে ছোটভাইয়ের বন্ধু সিরাজ। এই নিয়েই আপাতত  শামস এর ভুবন।  কৃষ্ণা সিরাজকে ডাকে শিপ বলে।  তা নিয়ে মাঝে মাঝে বেশ ঠাট্টা চলে তিনজনে ঃ 

কিরে, আমার মেয়ে তো ভেড়া বানিয়ে ছাড়ল তোকে, ভাই। 

ভাইঝি ভেড়া ডাকে তো ডাকুক, কোনই সমস্যা নাই 

ভেড়া, ঘোড়া, খেলনা...। কৃষ্ণা যে আর কি কি বানাবে সিরাজকে আল্লাহ্‌ই জানেন!  কাণ্ড দেখে হেসে বলতেন লাইলি। 

ইন্টার্ন চিকিৎসক সিরাজের এখনো পুরোপুরি চিকিৎসক হয়ে ওঠা হয়নি। কৃষ্ণার ছোটখাটো সমস্যায় সিরাজ কৃষ্ণাকে দেখে যায় মাঝেমধ্যে।  আর সমস্যা না হলেও সিরাজকে শামস নিজেই নিয়ে আসেন বাড়িতে, কৃষ্ণা শিপকে খুঁজছে যে! 

বেশ কিছুক্ষণ পর শামস যখন কৃষ্ণার ঘরের বাইরে এলেন, দেখা গেল  বাবার ঘাড়ে চড়ে ছোট্ট ছোট্ট দুহাত দিয়ে বাবার মাথায় ঢোল বাজাচ্ছে মেয়ে। 

কি গো, অগ্নি কন্যা প্রীতিলতা, এখনো রেগে আছেন বুঝি? তরল কণ্ঠে বলতে বলতে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে গেলেন শামস। 

জড়িয়ে ধরার আগমুহূর্তে ছিটকে দু পা পেছনে সরে গেলেন লাইলিঃ সূর্যের তেজ কি খুব বেশি নাকি আজ? মেয়েটা যে ঘাড়ে সে খেয়াল আছে, খোকা? তোমার আক্কেল হবে কবে? 

শামস ও ছাড়ার পাত্র ননঃ  রাতকে রাতেই  জড়িয়ে ধরি, তবে? 

কৃষ্ণাকে ততক্ষণে ছিনিয়ে নিয়েছেন মাঃ  উঁহু, রাতে কোন দুষ্টুমি চলবে না, অন্তত এক সপ্তাহ। 

সময় টা বলায় যা বোঝার বুঝে নিলেন শামসঃ তাই হবে মহারানী। তবে আলিঙ্গন আমার পাওনা। 

জড়িয়ে ধরতে নেই মানা, তবে এখন না!  বলে খিলখিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে মেয়েকে বুকে নিয়ে ছুটে পালালেন লাইলি। 

বছর ত্রিশের লাইলির শারীরিক গঠন তেমন আকর্ষণীয় নয়।  মাত্র পাঁচ ফুট দু ইঞ্চি  লম্বা, কিঞ্চিত স্থূল ও বটে। মাথায় একসময় এক ঢাল লম্বা চুল ছিল, সেটাকে ছেঁটে ঘাড় পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন এখন। অর্থনীতির ছাত্রী ছিলেন, ছিলেন তুখোড় বাচিক শিল্পী।  মাস্টার্স পড়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের  নবীন বরণ অনুষ্ঠানে লাইলির কণ্ঠে জীবনানন্দ শুনে প্রেমে পড়েছিলেন শামস। দু বছরের প্রণয়, পরিণয় পর্যন্ত গড়িয়েছিল সত্যি তবে তার জন্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি দুজনকে। 

অন্যদিকে শামসুজ্জামান ঢাকার একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের  উচ্চপদে কাজ করেন।  কৃষ্ণার জন্মের পর মেয়েকে সময় দিতেই অধ্যাপনায় ইস্তফা দেন লাইলি।  মেয়ের সাথে সময় কাটানো শামস এর কাছেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। 

সেদিন সকালে  কৃষ্ণা বেশ খোশমেজাজে থাকলেও সন্ধ্যা থেকে প্রচণ্ড জ্বর, বমি আর সাথে তারস্বরে  কান্না।  বাবা মা বুঝলেন, বেশি সময় নেই হাতে।  শামস আর কোন উপায় না দেখে ধাক্কাতে থাকেন পাশের ফ্ল্যাটের দরজায়। 

উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান শামসের অপরাধ ছিল মধ্যবিত্ত লাইলিকে বিয়ে করা।  দরিদ্র, পাতিলের তলার চেয়েও  কালো, মোটা ছেলের বউকে  মেনে নিতে পারেন নি শামসের বাবা কাম্রুজ্জামান।  অন্যান্য অনেক আত্মীয়রাও নাক সিটকেছিলেন ঃ  আমাদের চৌকস  ছেলের পাশে এ মেয়ে বড় বেমানান! 

শামসুজ্জামান এ সময় পাশে পেয়েছিলেন ছোট ভাই শরীফ আর মা শাহিনাকে। শাহিনা জামান  নিজের গলার সোনার হার খুলে পুত্রবধূকে পরিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন ঃ মা, তোমার বাইরের  আবরণটা কেমন তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।  মনের সৌন্দর্য দিয়ে তুমি আমার  ছেলে আর আমার পরিবারটা বেঁধে রাখতে পারবে কিনা সেটাই আসল কথা। 

হই হই করে উঠেছিল শরীফ।  আরে ভাবি, রাখো তোমার  দর্শন ধারী, আমার আগে গুণ বিচারী। তুমি কি কি জানো সেটা আগে বল। তার বলার ধরনে হেসে ফেলেছিল সবাই। 

বমি করতে করতে নেতিয়ে পড়া কৃষ্ণাকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন লাইলি।   ঘুম চোখে সিরাজ বেরিয়ে এসে কৃষ্ণাকে কোলে নিয়ে রিকশাতেই হাসপাতাল ছুটল।  কৃষ্ণার বাবা মার ও রিকশা ভরসা। 

প্রায় অচেতন মেয়েকে অস্ত্রোপচার কক্ষে ঢুকিয়ে দিয়েই তসবিহ পড়তে বসলেন দুজনে।  সিরাজের যুক্তি ছিল, মানছি ঝুঁকিপূর্ণ, তবে বাংলাদেশে  যেখানে জোড়া লাগা যমজ শিশু আলাদা করা হয়, কত জটিল  কাজ করা হয়, তো এটা কেন হবেনা? 

একপর্যায়ে শামস ক্লান্ত হয়ে স্ত্রীর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বোজেন।  একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে একমনে প্রার্থনা করতে থাকেন লাইলি। অসুস্থ মেয়ে ফেলে ঘুমুতে পারেননি মা। 

১৫ ঘণ্টার অস্ত্রোপচার শেষে কৃষ্ণা সুস্থ হয়েই ফিরেছিল বাড়িতে।  এখন হয়ত সে খেলায় মগ্ন তার প্রিয় শিপ এর পিঠে চড়ে।  সিরাজের মত মানুষেরাই প্রমাণ করে, বাংলাদেশের সব ডাক্তার কসাই হন না। 

দ্রষ্টব্য ঃ কাল্পনিক গল্প আমি লিখি কম, তবে এটার ২% বাস্তব, বাকিটা আমার কল্পনা।  আরবি শব্দ শামস অর্থ সূর্য, আর লাইলি অর্থ রাত।  তাবাসসুম মানে মুচকি হাসি। পাঠকের ভাল লাগবে আশা করি। 




 

22nd December 2019



 

Comments

    Please login to post comment. Login