Posts

গল্প

কৃষ্ণকলি -২

August 3, 2025

Kazi Eshita

138
View

কৃষ্ণকলি - ২ 

কাজী ফাল্গুনী ঈশিতা 


 

পাশের বাড়ীর থেকে ভেসে আসা মাউথ অর্গানের সুর বেশ মন দিয়েই শুনছিল কৃষ্ণা। এ দেশে পিয়ানো আর বেহালা বেশ জনপ্রিয়, তবে কৃষ্ণার প্রিয়  প্রতি শনি রবিবার পাশের বাড়ির এই মন কেমন করা সুর।  এই বংশীবাদক  কৃষ্ণার অচেনা কেউ নয়।  এই ভিনদেশ, ভিন্ন ভাষার সমুদ্রে  পড়ে  কৃষ্ণা যখন কুল খুঁজে পাচ্ছিলো  না, তখন তাকে পথ দেখিয়েছিল হামিদ। হামিদুর রহমান। 

হামিদের জন্ম আমেরিকায়, তাই সে জন্মসূত্রেই মার্কিনী। তবে হামিদ কৃষ্ণার মতই মনে প্রাণে বাঙালী।  এ দেশের কয়েক মণ মাখন দেওয়া কেক নয়,  হামিদকে জন্মদিনে তার মা গুড়ের সন্দেশ আর পায়েস বানিয়ে দেন। হামিদ বলে, অত মাখন খেয়ে কে রোগ বালাই বানায়? আমার পায়েসই ভাল। 

হামিদের মা তানিশা রহমান আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে এদেশে এসেছিলেন ছাত্রী হয়ে, দু চোখে  অনেক স্বপ্ন নিয়ে।  পারিবারিকভাবেই বিয়ে করেছিলেন বাবার বন্ধুর ছেলে মারুফ উর রহমানকে।  একমাত্র ছেলের জন্মের পর  মারুফ ছেলের মুখ দেখে নাম রেখেছিলেন হামিদ - বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে। 

শামস এর মতই হাসিখুশি পরিবার ছিল মারুফ- তানিশার।  তবে আমেরিকায় এসে যে কোন কারণেই হোক,  মারুফ ঠিক  অত ভাল চাকরী পান নি। তবে ভাল গাড়ি চালাতে পারতেন বলে উবার/লিফট  এ গাড়ি  চালাতেন। নিজের কাজ নিয়ে বেশ খুশি ছিলেন মারুফ।  স্ত্রীকে বলতেন, এই ভাল।  নিজের ইচ্ছায় নিজের উপার্জন।  

কিন্তু বিধি বাম!   তিন বছর আগে একদিন রাতে উবার চালাতে গিয়ে  এক মাতাল ড্রাইভারের নেশার বলি হলেন মারুফ।  পেছনের গাড়িচালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সজোরে  আঘাত হানে মারুফের গাড়িতে। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গাড়ি থেকে পুলিশ মারুফকে যখন উদ্ধার করে, ততক্ষণে তিনি না ফেরার দেশে। তাই হামিদের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকলেও ছেলেকে বেশিদূর  গাড়ি চালাতে দিতে নারাজ মা তানিশা। 

বিভোর হয়ে হামিদের বাজনা শুনছিল কৃষ্ণা।  সে নিজেও কি -বোর্ড এ সুর তোলে মাঝে মধ্যে।  আর এখন হামিদ যে দেশাত্মবোধক গানের সুরে বুঁদ ছিল, সেই একই সুর  কৃষ্ণা নিজেও বাজায় তার যন্ত্রে।  কি মনে হোল কৃষ্ণার কে জানে, হামিদের সাথে সে বাজানো শুরু করল একই গান।  

চমকে উঠলেন লাইলি-শামস। বাহ, বেশ লাগছে তো! “বাজা, মামনি...” শামস উৎসাহ যোগান মেয়েকে। তবে বেরসিক  ক্রিং ক্রিং বাদ সাধল সঙ্গীতচর্চায়। “আরে ধুর ফোন...” বিরক্তি ঝেড়ে দিলেন লাইলি। 

ফোন এর ওপাশে  বাংলাদেশ আর সাথে অতি পরিচিত একটা নাম দেখে  গান মাথায় উঠল কৃষ্ণা র ঃ “হ্যালো, শিপ, কেমন আছ?” 

ডাঃ সিরাজ সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করেন এই  কণ্ঠস্বর টা শোনার জন্য।  অপেক্ষা করেন সিরাজের স্ত্রী কাজল ও।  আর সিরাজের আট বছরের ছেলে শুভ র কাছে কৃষ্ণা পু মানেই সব মুশকিল আসান। 

আরে ধুর, তোর ভাই ভাল থাকতে তো দিল না রে মা... সিরাজের কণ্ঠে কৃত্রিম কান্নার আভাস। 

এই, খবরদার, শুভ কে কেউ কিচ্ছু বলেছ তো মরেছ!  

বোন এর গলায় আদর এর আভাস পেয়ে শুভ  শুরু করল ফোঁপানো, দেখ না কৃষ্ণা পু, আব্বু খালি বকে! 

কাজল সাবধান করলেন, এই কৃষ্ণা, লাই দিস নারে! আদর পেয়ে বাঁদর মাথায় চড়েছে একেবারে! 

সিরাজের ছেলে শুভ, আর শরীফের সমৃদ্ধ,  দুজনই কৃষ্ণার চোখের মণি।  এদের কান্না কৃষ্ণা মোটেই সহ্য করতে পারেনা। 

অন্যদিকে চাচা চাচীর সাথে কোনরকম বেয়াদবি ও করা যাবেনা যে। ! কৃষ্ণা কাজলকে বলে ঃ চাচী দাড়াও,  there’s always two sides of the story, তোমাদের কথা শুনেছি, শুভ র কথাও শুনি। 

মুগ্ধ হন কাজল। কে বলবে এ মেয়ের বয়স মাত্র পনেরো?  ছেলে একটু কিছু না পেলেই অস্ত্র হিসেবে কান্নাকে ব্যাবহার করে, শুভ কাঁদলে সিরাজ একেবারে গলে যান। কাজল বিরক্ত হন এ হেন ছিঁচকাঁদুনে আচরণে। কিন্তু কৃষ্ণা কি করে এত শান্ত থাকে?  আর ওদেশে থেকেও এত নম্র? আবার অন্যায় দেখলে কৃষ্ণা নিজেই রুখে দাঁড়ায়, সে খালি হাতে আত্মরক্ষার সব কৌশল জানে! কাজল মাঝে মধ্যে লাইলিকে প্রশ্ন করেন ঃ কোন জাদু জানো ভাবী তুমি? কিভাবে বড় করেছো ওকে? 

লাইলি হাসেন কাজলের প্রশ্নে। “জাদু  জানি না বোন, ওকে শুধু দেখাই কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। বাকিটুকু সে নিজেই করে। আমরা শুধু পথ দেখাই ব্যাস। 

কৃষ্ণা কিছুটা ভাইয়া ... সোনা ... করে শুভ র কান্না থামায়। জানে,  শুভ র ও কৃষ্ণা পুর মত  পোষা কুকুর ছানা চাই। কৃষ্ণার সাথে থাকা টফিকে দেখে লোভ হয়েছে তার। 

“এই শিপ, দাও ওকে ওর টফি কিনে... বলতে বলতে কৃষ্ণা নিজেই বলে, ও, না! হবেনা তো! “ 

এইটাই তো বোঝাতে পারছিনারে এই কান্নার সমুদ্র কে, বল না কি করি?  সিরাজের কণ্ঠে এবার ক্লান্তি। 

আসলে এপার্টমেন্ট এ, তাও বাংলাদেশে, কুকুর চাইলেও রাখা টা মুশকিল, বিশেষ করে যদি ভাড়া বাড়ি হয়। আমেরিকাতেও অনেক বাড়ীতে পোষা প্রাণী রাখার অনুমতি নেই।  কৃষ্ণা একটু সময় নিয়ে ব্যাপারটা বোঝাল শুভ কে। 

তবে আমার অন্যকিছু চাই - নাছোড়বান্দা শুভ। 

আচ্ছা শিপ, তবে তুমি মাছ কিনে দিও ওকে। প্রস্তাব দিল কৃষ্ণা। কিরে শুভ, চলবে তো? 

আচ্ছা আব্বু তোকে একটা নয়, দুটো goldfish কিনে দেবে হুম?  সম্মতি দিলেন ডাঃ সিরাজ। 

শুভর এখনো চোখে জল, তবে মুখে হাসি। 

তুই আজ বাঁচালি মা... ইশারায় বলে ফোন কাটলেন কাজল। 

(চলবে) 

2nd January 2020



 

Comments

    Please login to post comment. Login