শুকনো গোলাপ
চতুর্থ পর্ব
আজ শুক্রবার।
মকবুল চৌধুরী পাশের গ্রামের বড় মাছের আড়তে গেছেন মাছ কিনতে। এখানে পুকুরে চাষ করা ভালো মানের মাছ পাওয়া যায়। সেখানে গিয়েই দেখা হয়ে যায় সেই দুর্ঘটনায় পড়া ছেলেটার সাথে।
ছেলেটাকে সুস্থ দেখে মকবুল চৌধুরীর মন ভরে গেলো।
তবে ছেলেটা জানত না, তিনিই ছিলেন সেই অজানা পথচারী, যিনি অজ্ঞান অবস্থায় তাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন।
তাই তার খোঁজখবর নেওয়ার পর ছেলেটি খানিকটা অবাক হয়।
ভেতরে ভেতরে খুশিও হয়...
কুশল বিনিময় শেষে মাছ কিনে বাড়ি ফিরে আসেন মকবুল চৌধুরী।
বাড়ি ফিরে রাবেয়া চৌধুরীকে বললেন,
"বেশ কিছুদিন আগে যে ছেলেটা দুর্ঘটনায় পড়েছিল, সে এখন বেশ ভালো আছে। খুবই ভদ্র ছেলে। সেদিন দুর্ঘটনার পর আমার খুব খারাপ লেগেছিল। আজ তাকে সুস্থ দেখে ভালো লাগছে।"
আজকের বড় মাছটা খুব ভালো ছিলো, আর দামটাও ছিল মোটামুটি সস্তা — দিয়েছে সেই ছেলেটাই।
তানিশা এসব কথা কিছুই শুনেনি।
দুপুরের খাবার শেষ করে সে আবারও খুলে নেয় সেই চিঠিটা।
বারবার কেন যেন মন চায় পড়ে যেতে…
পরীক্ষা সামনে।
এইসব ভাবতে থাকলে তো রেজাল্ট খারাপ হবে!
মনকে শক্ত করে সব কিছু গুছিয়ে ড্রয়ারে রেখে দেয় তানিশা।
এভাবেই দেখতে দেখতে বৃহস্পতিবার আবার চলে এলো।
আজকের চিঠিতে শুধু অভিযোগ, আর অভিযোগ—
“এই যে গোলাপ কুমারী,
তুমি কি নীরবই রয়ে যাবে…?
তোমার কি আমাকে কিছুই বলার নেই…?
আমার গোলাপ দেখে কি তোমার ঐ গোলাপ-রাঙা ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ফুটে না…?
নাকি বেচারা গোলাপ দুমড়ে মুচড়ে পড়ে যায় জানালার বাইরে?
তুমি কি জানো...
তুমি আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছো...
আমার কল্পনার রাজ্যে শুধু তোমারই বসবাস...
শয়নে-স্বপ্নে-জাগরণে কেবল তুমি...
প্রতিটি নিঃশ্বাসে তোমার নাম উচ্চারিত হয়...
একফোঁটা রক্ত ঝরে পড়লে, তাতেও দেখি তোমার নাম লেখা।
ওগো মনের রানী...
তোমার কাছে তো আসতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু তুমিই তো আসতে দিলে না!
তোমাকে চোখ ভরে দেখতে চেয়েছিলাম…
তাও দিলে না।
কি নিঠুর তুমি…
আমার জন্য কি তোমার মন একটুও দুরুদুরু করে না…?
আজ না হয় দূরে আছি।
কিন্তু সামনে আমাদের দেখা হবেই।
এখন থেকে আর গোলাপ দেবো না — সামনে তোমার পরীক্ষা।
আগে তা শেষ হোক, তারপর সারাজীবন কথা বলা যাবে।
তুমি মন দিয়ে পড়ো।
আমি আমার হৃদয় পাথর করে রাখছি।
তোমাকে আর বিরক্ত করবো না।
নিজের খেয়াল রেখো।
খোদা হাফেজ।
চিঠির সবটা বুঝে উঠতে পারলো না তানিশা।
“কাছে আসতে চাওয়া…
আমি নাকি মানা করেছি...?
কিন্তু আমি তো তাকে দেখিইনি এখনো!
তাহলে মানা করলাম কিভাবে...?”
যাক, এসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে।
এখন একটাই লক্ষ্য — পরীক্ষা।
মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে।
তানিশা ভাবলো, ছেলেটাও জানে সামনে তার পরীক্ষা।
তাই নিজ থেকেই সরে গেছে।
এই মনোভাবটা ভালো লেগে গেলো তার।
এমন যত্নশীল মানুষই তো জীবনে দরকার…
পরীক্ষা এল, চলেও গেল।
তানিশা খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েছে।
আর দেবে না-ই বা কেন?
এসএসসিতে ছিল এ-প্লাস।
এইচএসসিতে খারাপ করলে চলবে নাকি?
এখন শুধু অপেক্ষা, কবে রেজাল্ট বের হবে।
এতদিন পর প্রথমবার মেয়েটা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারলো।
এই পুরো সময়টা, পরীক্ষার চাপে কিছুই ভাবতে পারেনি সে।
তবুও মনের কোনো কোণে শুকনো গোলাপ আর চিরকুটগুলো বারবার উঁকি দিয়েছে।
আজ তানিশা আবার একে একে সেসব খুলে বসেছে।
চোখের সামনে ঘুরছে সেই চিঠির লাইনগুলো।
“তুমি তো আমাকে আসতে দিলে না…”
এই লাইনটা বারবার কাঁটার মতো বিঁধছে তানিশার মনে।
সে ভাবছে—
ছেলেটা এমন বললো কেন?
আমি কি সত্যিই কোনোভাবে তাকে বাধা দিয়েছি…?
নাকি... আমার কোনো অজানা অভিমানে সে আমায় ভুল বুঝেছে…?