ভাবী, টেনশন?
একটা বিজ্ঞাপন ছিলো এরকম- এক দম্পতির কাছে একটি রিকন্ডিশনড গাড়ী বিক্রি করবার চেষ্টা করছেন একজন এজেন্ট। তিনি গাড়ীর নানা গুণকীর্তন শেষে বলেন, ৯৯% ওকে, শুধু ব্রেকটা কাজ করে না মাঝে মাঝে। এই তথ্য জেনে দম্পতির আক্কেল গুড়ুম হওয়া চেহারা দেখে এজেন্ট বলেন, ভাবী, টেনশন? এই বিজ্ঞাপনের গল্পটা এই লেখায় বলার প্রাসঙ্গিকতা খুব একটা নেই। কেবল লেখার শিরোনামটা কোত্থেকে আসলো সেটাই বলতে চাইলাম। ওই সময় এই সংলাপটা খুব হিট ছিলো, যদিও বিজ্ঞাপনটা কোন পণ্যের সেটাই এখন আর মনে নেই।
আমার বাচ্চা যখন ছোট ছিলো, ওকে স্কুলে নিয়ে যেতাম তখন অবাক হয়ে দেখতাম এক বাচ্চার মা অন্য বাচ্চার মাকে ভাবী বলে ডাকেন। অনেক বাচ্চার বাবাদের কেউ কোনোদিন দেখেওনি। অথচ ডাকাডাকির সময় সেই অদৃশ্যমান ভাইয়েরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতো, ভাইয়ের স্ত্রীকেই তো ভাবী বলা হয়! এই নারীরা অনেকেই পরস্পরের নাম পর্যন্ত জানতেন না। অমুকের আম্মু ভাবী তমুকের আম্মু ভাবী ডেকে নিজেরা নিজেদের চিহ্নিত করতেন এই নারীরা।
আমি এই কালচারটাকে পাঠ করতাম পুরুষতান্ত্রিক যন্তরমন্তর ঘরে মগজধোলাই হয়ে আসা নারীদের নাম্বনেস হিসাবেই। আমার বাচ্চার ক্লাসমেট বন্ধুদের মায়েদের মধ্যে যারা আমার বয়সে বড় তাদের নাম ধরে আপু আর যারা ছোট তাদের নাম ধরে ডাকতাম। আমাকে কেউ ভাবী বলে ডাকলেও নিষেধ করতাম। আমার বাচ্চার সেই সময়ের বন্ধুদের নাম মনে না থাকলেও সেই মায়েদের সবার নামই আমার মনে আছে- শুচিদি, পনি আপা, চৈতী আপু, শিউলী, শাওন, চৈতালি- প্রত্যেকেই যে যার নামে আমার স্মৃতিতে স্পষ্ট।
ভাবী শব্দটা নিয়ে নানা রকমের রঙ্গরসিকতা পুরুষেরা সব সময় করে থাকেন। গুলশানের ভাবী বলে একটা টার্ম সামাজিক মাধ্যমে চালু দেখি। এর অর্থ কী আমি তা স্পষ্ট জানি না। জানতে চাইও না। এর কনোটেশন খুব মর্যাদাকর কোনও কিছু হবে তেমন মনে হয় না। পর্নোগ্রাফিক কিছু হওয়াও আশ্চর্য নয়।
এই যে ভাবী বা বৌদি নিয়ে রসিকতা, তা একেবারে নতুনও নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একাধিক ছোটগল্পে ‘ ঠাট্টা সম্পর্কের আত্মীয়া’ বলে কিছু পার্শ্বচরিত্রদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। লোকগানে ভাবী দেওর বা বেয়াই ধরণের সম্পর্ক নিয়ে গান আছে। সেসব গানও যথেষ্ট মনোমুগ্ধকর! যেমন- ছাতা ধরো রে দেওরা, হাতে লাগে ব্যথা রে হাত ছাইড়া দেও সোনার দেওরা রে, ওরে ভাবীজান নাও বাওয়া মর্দলোকের কাম, ও ননদী আর দু’মুঠো চাল ফেলে দে হাড়িতে ঠাকুরজামাই এলো বাড়িতে- এই সকল গান যে আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ এ কথা অস্বীকার করবার কোনও উপায় নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে এইসব গান সৃষ্টি হয়েছে এমন সব সময়ে যখন নারীর আত্মপরিচয়ের টানাপড়েন তেমন ছিলো না। বিবাহের মাধ্যমে একজন নারী নতুন পরিবারে গেলে তার পিতৃমাতৃপ্রদত্ত নাম বদলে নতুন নাম দেওয়া হতো, এমনও পড়েছি বাংলা গল্পউপন্যাসে।
কিন্তু এই সময়ে কোনও নারীই বিশেষ একটি পুরুষের স্ত্রী বা বিশেষ একটি পরিবারের বধূ হিসেবে পরিচিত হন না, হতে চানও না। ভাবী বলে এখন কেবলমাত্র সেই সকল নারীকে নির্দেশ করে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা হয় যাদের কোন এক অদৃশ্য ভাইয়ের স্ত্রী হয়ে সেই ভাইয়ের সন্তানসন্ততি লালনপালন করা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। সন্তান পালনের মতো একটি টোয়েন্টিফোর সেভেন কাজকে ছোট করে দেখাও পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। নারীরা বিনাবেতনে সন্তান পালনের কাজ বন্ধ করে দিলে পুরুষের জন্য উত্তরাধিকারদের বড় করে তোলা এমন ব্যয়বহুল হয়ে যাবে যাতে অর্থনীতিতে বিরাট অদলবদল তৈরি করতে পারে। ফলে নারীর এই মাগনা গৃহশ্রম ও সন্তানপালনের পেশাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাই এই পুরুষাধিপত্যবাদী সভ্যতার জন্য নিরাপদ।
গত সপ্তাহেই সামাজিক মাধ্যমে একটি জিনিস দেখলাম। ময়মনসিংহে এনসিপির পদযাত্রার ভিডিও আপলোড করেছে কেউ। কমেন্ট সেকশনে একজন লিখেছে, সামনে থেকে ভিডিও করলে না কেন? আসলেই কত মানুষ হয়েছে দেখা যেতো। যিনি ভিডিও আপলোড করেছেন তিনি জবাব দিলেন, আমি তো মানুষ দেখতে যাইনি, আমি গেছি জারা ভাবীকে দেখতে।
এই জারা ভাবী সম্বোধন কিন্তু ওই নেটিজেন আবিষ্কার করেনি। এনসিপি ময়মনসিংহের আগে কোনও এক জেলায় সমাবেশ করেছে যেখানে সারজিস আলমকে দেখা গেছে তাসনিম জারাকে ভাবী বলে সম্বোধন করে শ্লোগান দিতে। জারাকে দেখা গেছে মিটিমিটি হাসতে। তাসনিম জারা একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। তার স্বামী কে আমার জানা নেই, হতে পারে তার স্বামীর বাড়ী ওই জেলায়। কিন্তু সে জন্যই কি একজন আত্মপরিচয়ে সম্পন্ন নারীকে ভরা মজতিশে ভাবী ডেকে রঙ্গরসিকতা করা যায়?
এনসিপি নামের দলটি নারীপ্রসঙ্গে শুরু থেকেই একটার পর একটা ব্লান্ডার করে যাচ্ছে। এর আগে একটি ইসলামব্যবসায়ী রাজনৈতিক দল নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের প্রকাশ্যে গালিগালাজ করে। এনসিপির শীর্ষ নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ সেই মঞ্চে উঠে বক্তব্য দেয় কিন্তু নারীসমাজকে কুরুচিকর গালিগালাজের কোনও প্রতিবাদ করেন না। এরপর হেফাজতে ইসলাম নামের ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ পাঠানো হয় যেখানে এনসিপির দুই নেত্রী ছিলেন অগ্রগামী। কিন্তু তারা সেই নোটিশ পাঠান ব্যক্তিগত জায়গা থেকে, দলের পরিচয়ে নয়।
এনসিপির আর এক নেত্রী সামান্তা শারমিন গণমাধ্যমের সামনে নারীদের জন্য ড্রেসকোড প্রবর্তনের কথা বলেছিলেন। সেই সামান্তাই এখন বলছেন সকল কমিটিতে নারীদের প্রান্তিক করা হয়েছে। এনসিপি যে নারীদের প্রান্তিক করে বা করছে তার আরও নানা উদাহরণ রয়েছে। সারওয়ার তুষার নামের একজন নারীপ্রশ্নে বিতর্কিত ব্যক্তি এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। নীলা ইসরাফিল বলে একজন নারী নেত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে বলেও খবর এসেছে। উমামা ফাতেমার পদত্যাগ বিষয়েও সকলে ইতোমধ্যে অবগত।
দুর্নীতি, জনগণের পয়সায় দামী গাড়ী ও হেলিকপ্টার চড়া, এইচএসসি পরীক্ষার বারোটা বাজিয়ে গোপালগঞ্জে রোডমার্চ করা, প্ল্যানচেট করে মুজিববাদের ভূত নামিয়ে জনগণকে জুজুর ভয় দেখানো ইত্যাদি ব্যাটাগিরির কাহিনী নাহয় এই লেখায় বাদই দিলাম। আজ এনসিপি তাদের চব্বিশ দফা দাবী উত্থাপন করেছে। এই দফাগুলোর মধ্যে দশ নম্বরে রয়েছে নারীর অধিকার ক্ষমতায়ন ইত্যাদি। দেখে আমার হাসিই পেয়েছে। এনসিপি নামক এখনও নিবন্ধন না পাওয়া অথচ দেশের প্রধান দলগুলোর একটি হয়ে ওঠা দলটির নারী নেতা ও কর্মীদের প্রতি একটি কথাই বলতে চাই- আপনাদের দেখলে মায়া লাগে আপুরা। আপনাদের দেখলে মনে কষ্ট চেপে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে বলতে ইচ্ছে করে- ভাবী, টেনশন?