গাড়ির ভেতরে নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে।
মিস্টার আমান ড্রাইভ করছেন ঠিক পাশে বসে আছেন তৃষা —
চোখের সামনে দিয়ে দ্রুত পেছনে ছুটে যাচ্ছে গাছপালা, পাহাড়, মাঠ, আর স্মৃতির মতো সরে যাচ্ছে মুহূর্তগুলো।
পাশের সিটে বসে আছেন তৃষা।
তিনিও চুপ—
মনে অজস্র প্রশ্ন, দ্বিধা, অনিশ্চয়তা।
এই প্রথম এত কাছাকাছি থেকেও কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না।
গাড়ির ভিতরের এই নিঃশব্দতা যেন একেকটা ভারী নিঃশ্বাসে পরিণত হচ্ছিল।
এদিকে আরিয়ান বারবার তৃষাকে মেসেজ পাঠাচ্ছিলো—
> “পৌঁছেছো?”
“তুমি ঠিক আছো তো?”
“আমি জানি আজ অনেক কিছু ঘটেছে… কিন্তু আমরা তো আবার একসাথে হচ্ছি, তাই না?”
তৃষা সব ম্যাসেজ দেখছিলো, কিন্তু উত্তর দিচ্ছিল না।
মিস্টার আমান পাশে বসে আছেন—
তাদের মধ্যে এখনো সম্পর্কের বাঁধন, অন্তত কাগজে কলমে।
আর তার সামনে বসে আরেকজনের সাথে গোপনে কথা বলা তৃষার কাছে ভদ্রতাবিরোধী মনে হচ্ছিল।
একসময় মন খারাপ করে ফোনটা অফ করে রাখলো তৃষা।
চোখ নামিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো…
সেখানে যেন নিজেরই প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছিল,
একটা দ্বিধাগ্রস্ত মেয়েকে,
যে নিজের চাওয়া না চাওয়ার মাঝখানে প্রতিদিন একেকটা রক্তাক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছে।
অন্যদিকে, আরিয়ান ফোনে রিপ্লাই না পেয়ে বিরক্ত হয়ে উঠছিল।
তার মনটা অস্থির হয়ে পড়লো।
তার মনেই আসছিল—
“তৃষা কি আবার দূরে সরে যাচ্ছে?”
“না কি এখনো আমানকে কিছু বলছে না?”
আরিয়ানের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো অসংখ্য চিন্তা।
সে জানে, সে দেরি করে ফেলেছে।
কিন্তু এবার আর দেরি করতে চায় না—
তৃষাকে ফিরে পেতে চায়…
সম্পূর্ণরূপে।
গাড়িটি থামলো এক ফিলিং স্টেশনের পাশে।
মিস্টার আমান গাড়ি থেকে নেমে গ্যাস ভরাতে দিলেন।
তৃষা চুপচাপ বসে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন।
হঠাৎই সামনে এসে দাঁড়ালো একটি ছোট্ট মেয়ে—
হাতে ছোট ছোট মালা, কিছু ফুল আর চুড়ি।
মেয়েটির চোখে অনুরোধ, গলায় কাঁপা কাঁপা স্বর—
“আপা, একটা নেন না… অনেক উপকার হবে…
এই ফুলগুলো নেন, এই মালাটা আপনাকে খুব মানাবে…”
মেয়েটিকে দেখে মিস্টার আমান একটু বিরক্ত হলেও—
তার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল, যা অবহেলা করা যায় না।
মেয়েটি বারবার বলছিল—
“এই ফুলটা নেন আপা, প্লিজ…
আপনার জন্যই বানিয়েছি মনে হয়…”
তৃষা একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাকালেন আমানের দিকে।
মিস্টার আমান কিছু না বলেই পকেট থেকে টাকা বের করলেন—
সব ফুল আর মালা কিনে নিলেন।
তারপর একটুখানি নরম গলায় বললেন,
“তোমার নাম কী?”
“সালমা।”
“সালমা, এই কার্ডটা রাখো। এটা তোমার মাকে দিও। তাকে বলো আমাকে যেন ফোন করে।
তোমার আর এই কাজ করতে হবে না। তোমার এখন স্কুলে যাওয়ার সময়। ঠিক আছে?”
তারপর মেয়েটির হাতে তিন হাজার টাকা ধরিয়ে দিলেন।
সালমা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল—
“আপনি তো বেশি টাকা দিচ্ছেন! আমার দরকার মাত্র পাঁচশো টাকা…”
মিস্টার আমান হালকা হেসে বললেন,
“বাকি টাকা রাখো, এটা তোমার স্কুলের জন্য।
মায়ের কাছে গিয়ে বলো—আজ থেকে সালমা স্কুলে যাবে।”
তৃষা এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেলেন।
একটা মৃদু হাসি মুখে ফুটে উঠলো।
মেয়েটি মালা আর ফুল এগিয়ে দিলো তৃষার দিকে।
তৃষা ধন্যবাদ জানিয়ে ফুল হাতে নিলেন।
মিস্টার আমান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
“আসলে মেয়েটির প্রয়োজন ছিল… তাই কিনলাম।”
তৃষা তাকিয়ে বললেন,
“আপনি সবসময় যাদের প্রয়োজন, তাদের পাশে দাঁড়ান।
এই জিনিসটা আমাকে খুব টানে। খুব ভালো লাগে আপনাকে দেখে।”
মিস্টার আমান কিছু না বলে তাকিয়ে থাকলেন।
তৃষা একটু থেমে আবার বললেন—
“রাগ না করলে একটা কথা বলি?”
আমান মাথা হালকাভাবে নাড়লেন।
“আপনি এত হ্যান্ডসাম… এত সুপুরুষ… দেখতে অসাধারণ…
আপনার পছন্দের কেউ নেই?”
মিস্টার আমান একটু চমকে উঠে তাকালেন তৃষার দিকে—
তারপর হালকা মুচকি হেসে বললেন,
“থাকলে আপনাকে বিয়ে করতাম…”
তৃষা একটু থমকে গেলেন, কী বলবেন বুঝতে পারলেন না।
কিন্তু আমান নিজেই পরিস্থিতি হালকা করে বললেন—
“আসলে পছন্দের কেউ ছিল না কখনও।
ছোটবেলায় বাবা-মা এক্সিডেন্টে মারা যান।
তখন থেকেই দাদীর কাছে মানুষ হয়েছি।
আর বাবা বিশাল একটা ব্যবসা রেখে গেছেন…
এই সব সামলাতে সামলাতে জীবন কোথায় চলে গেছে, খেয়ালই করিনি।
নিজের কথা কখনও ভাবিনি।”
তৃষা চুপ করে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন সবকিছু।
তার চোখে কিছুটা মায়া, কিছুটা শ্রদ্ধা, আর কিছু এক অজানা অনুভব।
আর মিস্টার আমান নিজের মনে একটাই কথা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল—
> “তোমাকে যখন প্রথম দেখলাম… বিয়ের সাজে…
সেই মুহূর্তেই বুঝে গেছিলাম… আমি হেরে গেছি।”
চলবে....