আদনানের হাতে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটা চিঠি পৌঁছাতো। ঠিক বিকেল ৫টা ৩৭ মিনিটে। প্রেরকের নাম থাকতো না, শুধু কাগজে একটা ছোট্ট ফুল আঁকা থাকতো কোণায়—জবার ফুল।
চিঠির ভাষা ছিল অদ্ভুত। যেন কেউ অতীতের ভেতর থেকে লিখছে—
“তোমার চোখে যে অস্থিরতা, আমি তা চেনি। তুমি আজো আমাকে মনে রেখেছ, তাই না?”
আদনান প্রথমে ভাবছিল এটা কার খেলা! কলেজে সে চুপচাপ একজন, বন্ধুবান্ধব কম, হাসির চেয়ে চিন্তাই বেশি। কিন্তু চিঠিগুলো তার ভেতরের কোনো পুরোনো স্মৃতির দরজা খুলে দিচ্ছিল ধীরে ধীরে।
একদিন এক চিঠিতে লেখা ছিল—
“পুরনো লাইব্রেরির সেই জানালার পাশে আমি আজো বসে থাকি। একবার এসো।”
আদনান গিয়েছিল। খুব ইচ্ছে করে গিয়েছিল। লাইব্রেরির পুরনো জানালার পাশে কেউ ছিল না। কিন্তু জানালার পাল্লায় ছিল একটি ছোট্ট কাগজ গোঁজা—
“তুমি আসবে জেনেই আমি এলাম না।”
দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। আদনান ক্রমে এই অচেনা চিঠির লেখিকাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলো। কে সে? কেমন দেখতে? কেন সে লুকিয়ে ভালোবাসছে?
তারপর হঠাৎ একদিন চিঠিতে একটি নাম লেখা থাকলো।
“আমি আদিবা।”
আদনান থমকে গেলো। আদিবা—এই নামটি সে বহু বছর আগে শেষ শুনেছিল। ছোটবেলায় একসাথে খেলত তারা। হঠাৎ করে একদিন আদিবার পরিবার শহর ছেড়ে চলে যায়। যোগাযোগের সব পথ বন্ধ হয়ে যায়।
চিঠিগুলো তাহলে সেই আদিবার?
তবে সে কোথায় আছে এখন? কেন দেখা দিচ্ছে না?
একদিন চিঠির ভাষা বদলে গেল—
“আমার সময় ফুরিয়ে আসছে, আদনান। আমি অনেক দূরে। চোখের সামনে থেকেও ধরা দিই না। কিন্তু তুমি যদি সত্যিই চাও, আমি একবার তোমার সামনে আসবো। শেষবারের মতো।”
আদনান চিঠির প্রতিক্রিয়ায় এবার নিজেই একটা চিঠি লিখে লাইব্রেরির জানালায় রেখে এল—
“এসো, আদিবা। একবার এসো। আমি অপেক্ষা করবো।”
পরদিন সে লাইব্রেরির জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করল। ঠিক সূর্য ডোবার আগে, একটা পায়ের আওয়াজ শোনা গেল।
একটি মেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। চোখের ভেতর এক সমুদ্র নীরবতা। চেহারা যেন চেনা, আবার অচেনাও।
“তুমি আদিবা?” —আদনান জিজ্ঞেস করল।
মেয়েটি হেসে বলল—
“আমি ছিলাম আদিবা। এখন আমি শুধু তোমার স্মৃতি। তুমি আমাকে ডাকো, আমি আসি। কিন্তু তোমার বাস্তবে আমি নেই।”
আদনান হতভম্ব।
“তাহলে এতদিন তুমি...?”
মেয়েটি চোখ নামিয়ে বলল—
“তোমার চিঠিগুলো আমি পাই না, আদনান। কারণ আমি তো আর এই দুনিয়ার কেউ না। সেই বছর, যেদিন আমাদের বাসা ছাড়ার কথা ছিল, সেদিনই আমার শেষ রাত ছিল এই পৃথিবীতে। কিন্তু তোমার জন্য… আমি থেকে গেছি। এই লাইব্রেরির জানালার পাশে… প্রতিদিন।”
আদনানের চোখে জল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা বাস্তব কি না, জানে না। শুধু জানে, তার হৃদয়টা এখনো আটকে আছে ওই অদেখা চিঠির ভেতর।
শেষবারের মতো আদিবা বলল—
“ভালো থেকো, আদনান। যদি কখনো এই জানালার পাশে আবার আসো, একটা জবা ফুল রেখে যেও। আমি বুঝে নেব—তুমি আমাকে আজো মনে রেখেছো।”
তারপর হাওয়ার এক ঝাপটায় মেয়েটি যেন মিলিয়ে গেল।
সেই দিন থেকে আদনান আর কোনো চিঠি পায় না।
তবে আজো, প্রতি বছর সেই নির্দিষ্ট দিনে, সে একটি জবা ফুল রেখে আসে সেই পুরনো জানালার পাশে।
🌿 শেষ নয়, তবুও শেষ
ভালোবাসা হয়তো সবসময় পূর্ণতা পায় না🥀☘️
তবু কিছু ভালোবাসা থেকে যায়—🌺🌿চিরকাল… অদৃশ্য হয়ে🥀🍃