
পর্ব- ১০: আঁচলে চন্দ্র ঢেকে
টিভি স্টেশনের দালানটা অবশ্য তাঁর অনেকদিনের চেনা। রাজধানীর পথ ঘাট অলিগলির প্রতিও তাঁর দুর্নিবার আকর্ষণ। ইচ্ছা ছিল একদিন সারাদিন প্রিয় সাইকেল নিয়ে প্রাণ খুলে শহরময় ঘুরবেন। সে আশার প্রদীপে কয়েক বছর আগে তিনি নিজেই জল ঢেলেছেন। সাইকেল নিয়ে বাগানেই থাকার কথা ছিল তাঁদের। সেদিন দুই বোন কী মনে করে যেন হঠাৎ এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন। কে আগে দৌড়ে গিয়ে সাইকেলে বসতে পারে, দেখা যাক? বড়বোনের আগেই সাইকেল নাগালে পেয়ে খুশিতে উদ্বেল হয়ে আর পিছন ফিরে চাইলেন না বালিকা শিল্পী, দ্রুতগতিতে বের হয়ে গেলেন বাগান ছাড়িয়ে রাস্তায়। দশ এগারো বছরের মেয়ে হঠাৎ সাইকেল নিয়ে ব্যস্ত মহাসড়কে উঠে হতভম্ব হয়ে গেলেন বোধহয়। একটার পর একটা গাড়ি শক্ত ব্রেক কষে থামছে আর চাকার আওয়াজে গা শিরশির করে উঠছে। মাঝরাস্তায় নির্বাক দাঁড়িয়ে আমাদের প্রিয় গায়িকা। কোনদিকে যাবেন কী করবেন বুঝতে পারছেন না! একটা দানব চেহারার ট্রাক প্রায় তাঁর গা ঘেঁষে গিয়ে একটা গাছে গিয়ে আটকালো। ভয়ানক সেই ভুলের ফাঁদে পড়ে জীবনে প্রথম তিনি বুঝেছিলেন মানুষের জীবনগুলো কতো নিশ্চিতভাবে অনিশ্চিত!
লাহোর শহরটাও ঘুরে দেখার ইচ্ছা ছিল খুব। কিন্তু সুযোগ হলো কোথায়? এবার নিয়ে প্রায় তিরিশ বার এসেছেন অথচ শালিমার বাগ যেতে পারলেন একবার কেবল, মাত্র দেড় ঘন্টার জন্য। এ যাত্রায় ইচ্ছা আছে কোনো এক ফাঁকে পুরো এক বেলা শালিমারের স্বচ্ছ জলে নিজের ছায়া দেখে কাটাবেন। আদৌ সম্ভব কি না কে জানে? কমপক্ষে পঁয়ত্রিশটা গান রেকর্ড করতে হবে, চারটা আলাদা আলাদা ভাষায়!
ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ তেমন না হলেও, এবারের লাহোর যাত্রা সঙ্গীতের শাহজাদীর কাছে খুব খুব বিশেষ। পাঞ্জাবি ভাষার এক মহান সুরকার এই দফায় তাঁর জন্যে এক ছবিরই পাঁচটা গান রেখেছেন। তালের ঝংকার, রাগিনীর সূক্ষ্মতা আর লয়ের বিস্তারে সেই গানগুলো একটা আরেকটার চেয়ে সেরা। এতো এতো গান গাইতে হয় তাঁকে ইদানিং যে কোনো নির্দিষ্ট গানের বাণী নিয়ে আজকাল ভাববার অবকাশ মেলে না। তবে আজ ভাববেন বলে ঠিক করলেন। শত চেষ্টার পরেও এবার একটা উর্দু গানের ঘোর থেকে তিনি বের হতে পারছেন না। সকাল থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত মোট সাতটা গান শেষ করতে হয়েছে। স্টুডিও থেকে যখন বের হলেন, মধ্যরাত। খোলা আসমানের নিচে, বলতে গেলে, প্রায় মায়ের আঁচল ধরে দাঁড়ালেন সাড়াজাগানো তরুণ গায়িকা। রাতজাগা চোখ। মনের ভেতর কবিতার মতো অগাধ স্নিগ্ধতায় শেষ গানটার কথাগুলো বাজছে। কী চমৎকার ছিল সুর তাল ছন্দ মিলিয়ে সবকিছু! প্রিয় সুরকার যখন খালি গলায় গানটা তুলে দিচ্ছিলেন, তাঁর বার বার মনে হচ্ছিল এই সঙ্গীত উর্দুভাষী জনগণ চাইলেও কোনোদিন ভুলতে পারবে না। অমর সুর আর মহাকাব্যিক শব্দ বাক্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, তিনি গাইলেনও একেবারে অন্তর ঢেলে।
শাম্মা বানকে দূর রেহতে
ক্যায়সে পারওয়ানে সে হাম
ধাড়কানো সে গীত উভরে
অউর লাবো পার ছা গায়ে
আপ দিলকি আঞ্জুমান মে
হুসন বানকার আ গায়ে
প্রেম বিরহ মানুষের জীবনকে আসলে অবিশ্বাস্য রকম অবাস্তব করে তোলে। প্রেমিকের অযান্ত্রিক মন ভয়ে বা ভালোবাসায় এমন সব দুর্বার অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়, যেগুলোর কোনো লৌকিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এইসব মন-উপচানো অভিজ্ঞতার বেলায় কখনো কখনো আপন পরের ভেদ থাকে না।
যে কবিরা তাঁর জন্যে মন খুলে গান লেখেন তাঁদের কারও কারও সাথে স্টুডিওতে পরিচয় হয়, বাকিদের সাথে কোনোদিন কোথাও দেখা হয় না। বিনা সাক্ষাতেই তাঁরা এই অনুভূতিকাতর গায়িকার সাথে কথা বলেন বহমান ছন্দ-ভাষায়। মৃত কবিদের গানও তাঁকে গাইতে হয় অনেক সময়। রেডিওতে যেমন প্রাচীন একটা গজল গাইলেন সেদিন। গজলের কথায় আবার অলৌকিক গভীরতা! গাইতে গিয়ে রীতিমতো ধ্যান করতে হয়। হারিয়ে যাওয়া যায় হৃদয় নিংড়ানো কাব্যের ছায়া আবছায়ায়।
কবিতায় বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতেই তাঁর একমাত্র বোনের বিয়ে ঠিক হলো, কপাল গুণে, এক কবি পরিবারে। সুদর্শন বরের বাবা সিন্ধি ভাষায় অসংখ্য অমর চরণ লিখেছেন। তিনি মূলত পীর। আধ্যাত্মিক সাধনার পাশাপাশি রাজনীতিও করেন। তবে জমকালো সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি চির স্মরণীয় কবি। সেই কবির লেখা কালজয়ী কিছু গান অদূর ভবিষ্যতে গাইবেন আমাদের বিচিত্রতম কণ্ঠস্বর। নিজের ভাষা সংস্কৃতি থেকে এতো দূরের মানুষের মনেও তিনি পৌঁছে যাবেন অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। সিন্ধু অঞ্চলের আবহমান জীবনধারা এতো নিজের করে তুলে আনবেন ভিন্নভাষী গলায় যে, কবি নিজেও, এই কণ্ঠের তুলনাহীন বয়ে চলা শুনে ব্যকুল হবেন।
বিয়ের রঙিন সন্ধ্যা থেকে দুই বোনের একসাথে গাওয়া ছবির গানগুলো ক্রমাগত বাজছে। আমাদের প্রিয়তম গায়িকার মনে তখন আনন্দ বিলাপ দুই বিপরীত অনুভূতি একসাথে খেলে যাচ্ছে। জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত খুব কম সময়ই বোনকে ছাড়া থেকেছেন তিনি। এমনকি স্কুলে গিয়েও বোনকে অনুসরণ করতেন ছায়ার মতো। আর একসাথে সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটাতেন লাহোরে যাওয়া আসার পথে। স্টুডিওতেও দুই সহোদর হাসতে হাসতে অনেক কঠিন গান গেয়ে যেতে পারতেন খুব অনায়াসে। ঘরে ফিরে রেকর্ডিং এর ভুলত্রুটি নিয়ে হেসে গলে পড়তেও সময় লাগতো না কারও। আজকের পর থেকে দুই জন দুই ভিন্ন বাড়ির বাসিন্দা। প্রতিদিন আর দেখা হবে না, অযথা লাগামহীন আলাপগুলো সহজে আর জমবে না!
আমাদের শ্রেষ্ঠ গায়িকা সেই বিয়ের দিন জীবনে প্রথম একমাত্র ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। সারারাত মন খারাপ করে জানলা খুলে বসে ছিলেন ছোট ভাইয়ের নরম দুই হাত ধরে। বাবা মায়ের এই তৃতীয় সন্তানের জন্ম সুরের রানির জীবনের এখন পর্যন্ত সুন্দরতম ঘটনা। ভাইয়ের জন্ম হয় শরৎকালে, তাঁর নিজের বয়স তখন সাত বছর। মা যেদিন হাসপাতাল থেকে ভাইকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন, চারিদিকে মনে হচ্ছিল ঈদ নেমে গেছে। বিকেল থেকে একে একে এই শহরের সব আত্মীয় বন্ধুরাও এলো। সবাই চলে গেলে প্রায় মাঝরাতে খাবার টেবিলে বাবা হাসিমুখে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। পুরো ঘর তখন সুখবরের স্বর্ণ গন্ধে ঘেরা।
ঢাকায় আমাদের একটা নিজস্ব বাড়ির দরকার ছিল খুব। আই ওয়াজ ট্রায়িং টু ফাইন্ড ওয়ান অ্যাট অ্যারাউন্ড দ্য সেন্টার অভ দ্য সিটি। খুশির খবর হচ্ছে অবশেষে পেয়ে গেছি। ইন ফ্যাক্ট, অর্ধেক কেনাও হয়ে গেছে!
বাবার বহুদিনের ইচ্ছা চাকরি জীবন একটু গুছিয়ে নিতে পারলেই ঢাকায় গিয়ে থিতু হবেন। তাঁর ছাত্রজীবনের বেশিরভাগ বন্ধু ও প্রায় সব আত্মীয় স্বজন ঢাকায় থাকেন।
তোমরা বড়ো হয়ে গেলে আমরা বুড়া বুড়ি দুইজন বাকি জীবনটা ঢাকায় কাটাতে চাই।
মা এরই মধ্যে বাড়িটার জন্য একটা নামও ঠিক করে ফেলেছেন তাঁদের পাঁচজনের ইংরেজি নামের পয়লা অক্ষর দিয়ে। বাংলায় সে নামের অর্থ দাঁড়ায় “স্বপ্ন”। সেই স্বপ্নের বাড়িতে সংসার শুরু করতে তাদের আরো অন্তত পনেরো বছর লেগে যাবে। ততদিনে ঢাকা একটা স্বাধীন দেশের রাজধানী।
ঢাকার ছবিতে গান গাওয়ার শখ ছিল তাঁর বলতে গেলে ক্যারিয়ারের প্রায় শুরু থেকেই। রেডিওতে প্রথম বাংলা গান গাওয়ার সময় এই ইচ্ছা আরো প্রবল হয়। কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলেন নি কখনো। অবশেষে বোনের বিয়ের সপ্তাহ খানেক আগে সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত প্রস্তাব এলো। বাংলা গানটা নিয়ে লাহোরে এসেছিলেন গীতিকার, সুরকার এবং ছবির পরিচালক। এক গান ছবিতে দুইবার বাজানো হবে। পুরুষ কণ্ঠে গাইবেন যিনি তিনিও আছেন সাথে।
আমরা ঢাকা থেকে খুব আশা নিয়ে এসেছি একটা গান নিয়ে। বাংলা ছবির গান। আপনি যদি কষ্ট করে একদিন একটা বেলা সময় দিতেন!
কথা বলছেন সুরস্রষ্টা নিজে। কণ্ঠে অসীম আগ্রহ নিয়ে লোকটা এতো সুন্দর করে ব্যাখা করছেন ছবির গল্প, গানের কথাগুলো! একটু পর সাথে থাকা পুরুষ শিল্পীকে অনুরোধ করলেন গাইতে। প্রথম অন্তরা শেষ হতেই আবার থামতে ইশারা করলেন।
আমরা ট্র্যাক করিয়ে রাখবো। আপনার বেশি সময় নষ্ট করবো না।
চার ভদ্রলোকের সবাই বয়সে অনেক বড়ো অথচ কী সম্মানের সাথে সম্বোধন করছেন একজন কিশোরীকে। তার উপর সুরটা সত্যিই অনবদ্য। তাছাড়া, মাতৃভাষার ছবিতে গেয়ে তৃষ্ণা মেটানোর অপার সুযোগ আবার কবে আসবে কে জানে? তাই ‘না’ বলার প্রশ্নই আসে না।
অবশ্যই গাইবো। এতো সুন্দর কথা, সুর! কিন্তু আমাকে একটু্ ডাইরিটা দেখতে হবে আগে। বাকি সবাইকে তো আগে থেকে শিডিউল দেয়া।
শেষমেশ অনেক চেষ্টার পর একটা বেলা ফাঁকা করতে পেরেছিলেন আমাদের ব্যস্ততম গায়িকা। লাহোরের ভিনভাষী স্টুডিওতে পাঁচজন বাঙালি সেদিন একসাথে ভেসে গিয়েছিলেন তাঁদের নিজেদের একান্ত সুর দরিয়ায়।
যে কুড়ায় কাচের গুঁড়ো
পথের ধারে হীরে ফেলে
আঁচলে চন্দ্র ঢেকে
সে হয় খুশি পিদিম জ্বেলে
ছবির গল্পে দেখা যাবে পটলচেড়া চোখের এক অপরূপ নায়িকা লজ্জায় লাল হয়ে সারা বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে গানটা গাইছে। রেডিওতে গান শুনে প্রেমে পড়েছে। তাই ছেলেটার অদেখা ছবি মনের ভেতর এঁকে নিয়ে গাইতে হবে। গাইতে গিয়ে প্রিয় শিল্পী ঢাকার বাড়িটা একবার দেখে নিলেন স্বপ্নিল চোখে। কল্পনা করতে লাগলেন সেই বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে নামছেন তিনি। আড়ালে লুকিয়ে সেই অচেনা ছেলেটা তাঁর অন্তরা সঞ্চারী সবকিছু তন্ময় হয়ে শুনছে। গীতিকার প্রেমের মতো মনমাতানো কথা লিখলেও, প্রতি শব্দের ফাঁকে জমে আছে বিরহী আশঙ্কার শীতল বরফ।
গান শুনে ভালো লাগে যারে
এতো দেখে চেনোনিকো তারে
ঠিকানা তোমার বলো কবে
সুরের রেখায় এঁকে দেবে?
জানি দেবে না, দেবে না!
গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে
বলো কী হবে?
বাংলা ছবির জন্য গাইতে গিয়ে তিনি জানলেন আরেক পেশাগত সত্য। সিনেমার কাহিনীর মাঝে গান আসলে স্বপ্ন হয়েই আসে। মানুষ যাপনের ক্লান্তি ভুলতে বড়ো পর্দায় আশ্রয় নেয়। বাস্তব জীবনের নিষ্ঠুরতা ভুলে কিছু সময়ের জন্য ভেসে যেতে চায় রঙিন সমুদ্রে। আর এই স্বপ্ন রচনার সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব বেশিরভাগ সময় একজন গায়ক বা গায়িকার কাঁধে এসে পড়ে। বিষাদকাতর হোক বা প্রেমময় - ছবির গানগুলো গাইতে হয় বাস্তবের দীনতা, মলিনতা ভুলে। কণ্ঠ হতে হয় অম্লান, প্রতিটি উচ্চারণে চাই স্পষ্ট আবেগ। অভিনেত্রীর সুন্দর মুখছবিও মাথায় রাখতে হয় গাওয়ার সময়। তাঁর ব্যক্তিত্ব অভিব্যক্তি থেকেও সংগ্রহ করতে হয় অজস্র জরুরি উপকরণ।