গৃহবন্দী- সত্যিই কি?
কাজী ফাল্গুনী ঈশিতা
ইদানীং দুষ্টু সোনা করোনার ভয়ে সবাই গৃহ বন্দী। অনেক বন্ধু বান্ধবীরা বলাবলি করছেন ঃ “বাইরে বের হতে না পেরে হাঁপিয়ে উঠেছি।” ভাই, এই অপ্রতিরোধ্য জীবাণু যে আপনার দেহে প্রবেশ করেনি, শোকর করেন না! বাইরে বের হয়ে নিজেই নিজের পরিবারের জন্য অ্যাটম বোমা তৈরি হতে চান নাকি? দয়া করে ঘ্যানঘ্যানানি থামান! আবার অনেকে বলছেন বাড়ীতে বাচ্চাদের সামলানো কষ্ট হয়ে পড়ছে। কেন গো আপু? একটু বুদ্ধি খাটালেই তো হয়তো সম্ভব কচিকাঁচাদের সামলানো। ঘর বন্দী জীবন একটু কঠিন, কিন্তু অসম্ভব কি? দেখাই যাক না ঃ
খেলায় মাতি ঃ ছোট বেলায় চোর -পুলিশ খেলতে খুব ভালবাসতাম। বা নাম, দেশ, ফুল ফল। চার থেকে পাঁচ জনের এই খেলায় একজন একটা অক্ষর দেবে, বাকিরা সবাই সেই অক্ষরটা দিয়ে একজন মানুষের নাম (এটা নিজে বানানো যায়) , একটা দেশের নাম, ফুল আর ফলের নাম লিখল। যে সবচেয়ে বেশি লিখতে পারবে সে জিতবে। দাবা, লুডু, মনো পলি, ক্যারাম, ইত্যাদি নানা রকম বোর্ড গেম তো আছেই। অন্তক্ষরি ধরনের গানের খেলা ও খেলতে পারেন। যে বাবা মায়েরা সন্তানকে সাধারণত সময় দিতে পারেন না, তারা খেলার ছলে সময় দিন।
বই পড়ুন ঃ বইয়ের চেয়ে বড় বন্ধু কি আর কেউ আছে? বাড়ীতে থাকা যে বইগুলো পড়া হয়নি, পড়ে ফেলুন। ছোটদেরকেও বলুন চট জলদি পড়ে ফেলতে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী, এই চার বছর বই নিয়ে একটা মজার খেলা শিখেছিলাম স্কুলে। আমাদের সব ক্লাস শেষ হবার পর বাড়তি ১৫ মিনিট দেয়া হতো কোন একটা বই পড়ার জন্য, যার নাম ছিল সাইলেন্ট রিডিং পিরিয়ড। বোর্ডে একটা বড় চার্ট টাঙ্গানো হতো। আমাদের সবাইকে একটা করে বই শেষ করে বইয়ের নাম, লেখকের নাম সহ বইটি পড়ে আমি কি ভাবছি, তা নিয়ে দশ বারো লাইন লিখতে বলা হতো। এই রিপোর্ট দেখার দায়িত্বে যে কোন একজন শিক্ষক/ শিক্ষিকা থাকতেন। (এ চর্চা শুরু করেছিলাম যার হাত ধরে, প্রিয় সেই শিক্ষিকা রুমা মিস কর্কট রোগের কাছে হার মেনেছেন কিছুদিন আগে, লিখতে গিয়ে আজ ওনার মুখটা খুব মনে পড়ছে) । শর্ত ছিল, এক লেখকের তিনটার বেশি বই পড়া যাবেনা।প্রতি পাঁচটা বই শেষ করতে পারলে একটা চকোলেট বার আর একটা কোকের বোতল পুরষ্কার পেতাম। বছর শেষে যে তিনজন সবচেয়ে বেশি বই পড়ে শেষ করতে পারতো, সেই তিনজনকে নিয়ে আলাদা ভাবে বেড়াতে যেতেন প্রিন্সিপাল স্যার সহ বাকি শিক্ষক শিক্ষিকারা। পড়াশোনার চাপে পড়ে তখন আমার ভাগ্যে কয়েকবার ওই চকোলেট আর কোক ছাড়া আর কিছু জুটত না। তবে বই পোকা এই আমার লেখার নেশার আগুনে ঘি পড়েছিল ওই খেলায়। আর ছিল বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের স্কুল ভিত্তিক বই পড়া কর্মসূচী। দুয়ে মিলে আমার বাংলা আর ইংরেজি, দুটো ভাষার ভিত্তি বেশ শক্ত হয়ে গিয়েছিল, আলহামদুলিল্লাহ্। তাই আজ হয়তো বাংলায় লিখতে পারি, ওই পড়া পড়া খেলা থেকেই আজ ইংরেজি ভাষা শেখানো আমার পেশা। এরকম বইয়ের খেলা নিজেও খেলুন, সন্তানকেও খেলান, বৃথা যাবে না আশা করি।
সবাই মিলে শিখি ঃ পরিবারের কর্তা হয়তো অঙ্কে বেশ ভাল, তবে সন্তানটি অঙ্কের ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপে। প্রাইভেট শিক্ষক নয়, বাবা নিজেই বসে পড়ুন সন্তানের সাথে অঙ্ক কষতে। বাড়ীর গিন্নির রান্নার হাত বেশ, তবে কর্তা মশাই চা বানাতে গেলেও হাত পোড়ান! যান না, চা বানানো, রুটি বানানো জাতীয় সহজ কাজ গুলো শিখে নিন গিয়ে স্ত্রীর কাছ থেকে, কাজে দেবে। স্বামীর হয়তো বাগানের শখ, স্ত্রী গাছের গ বোঝেন না। শেখান না রে ভাই শখের বাগান করা। এসব করতে গিয়ে আরও মজবুত হোক সম্পর্কের বাঁধনগুলো। বাড়ীর প্রবীণ সদস্যটির সাথে সময় কাটান, তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুড়ি আপনাকে অনেক কিছু শেখাবে। আনাড়ি রাঁধুনি আমি এখন সহজ রান্না গুলো শিখছি বড় বোনেদের কাছে। আর ওরা ইংরেজি পত্রিকা পড়তে বসে এই শব্দের মানে কি? ওই বাক্যে কি বোঝাল? করতেই থাকে। আমার বেশ লাগে চলমান অভিধান হয়ে থাকতে। বাড়ীর ছোটদের বয়স অনুযায়ী ঘরের কাজ শেখানোর সময় এখন। সব কিছু কিন্তু ক্লাস রুমে শেখাবে না। আর যেহেতু শিক্ষকতা আমার পেশা, ছাত্র ছাত্রীদের ভুলি কি করে? থেকে থেকে আমার মেসেঞ্জার এ টুং টাং, “এটা বুঝিনাই, ওটা করে দেন!” উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী আমার ভাগ্নিটিও আছে এ দলেঃ “খালামনি, প্যারাগ্রাফ লিখে দাও, বা লিখেছি, দেখে দাও।” বেশ আছি প্রাপ্তবয়স্ক খোকা খুকুর দল নিয়ে।
নিজের যত্ন জরুরী ঃ ঠিকমতো খাওয়া, প্রয়োজনমত ঘুম, গোসল ইত্যাদি বিষয়গুলো খেয়াল রাখলে অনাহুত অতিথির মতো শরীরকে আক্রমণ করতে চাওয়া স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো এড়ানো যাবে। মনের যত্নও খুব দরকার। বিষণ্ণতা নামের মামদো ভুতকে মনের ঘরে ঢুকতে দেবেন না কিছুতেই। ও কিন্তু সেই দুষ্টু সোনা করোনার থেকেও খারাপ। একবার সুযোগ পেলেই আপনার জীবনের ঘাড়টি মটকে দেবে সে।
শখের তোলা আশি টাকা ঃ প্রাণ খুলে গান ধরুন। টি ভি তে শিক্ষামূলক কিছু দেখুন। সেলাই করুন, বা আপনার মনের রঙে সাজিয়ে তুলুন নিজেকে। নিজে ভালো থাকলে চার পাশের সবাইকে ভালো রাখতে পারবেন।
প্রার্থনায় শান্তি ঃ নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করুন। ধর্মীয় স্বাস্থ্য বলতেও স্বাস্থ্যের একটি দিক আছে। প্রার্থনার শক্তিকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা হয়তো কারও নেই। আমি যেমন সেজদাতে যে শান্তি পাই তা আর কোথাও পাই না। কোরআন পাঠেও পাই এমন শান্তি, তবে এ কাজটি এখনো শিখছি আমি।
ঘরে থাকুন, দুষ্টু সোনা করোনা থেকে দুরে থাকুন, ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
1st April, 2020
Email: eshitawrites@gmail.com
দ্রষ্টব্য ঃ তিন দিন পরেই জন্মদিন আমার। যদিও জানি জন্মদিন মানেই কবরের এক পা কাছে চলে যাওয়া, তবু বাড়ীর ছোট মেয়ের জন্মদিনে ঘরোয়া ছোট্ট একটু আয়োজন থাকে। প্রতি বছর নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করি গত বছর থেকে আরও ভালো মানুষ হয়ে ওঠার। নিজের মনকে আর একটু পরিষ্কার করার। এ মুহূর্তে সুবিধা বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই নিজস্ব কিছু কারণে।জন্মদিনে অন্য সবার সাথে আমি নিজেই নিজেকে ছোট্ট কিছু উপহার দেই। হতে পারে সেটা বই, নতুন কোন লেখা, আঁকা, বা নতুন কিছু শেখা। এ বছর নিজেকে কি উপহার দেওয়া যায় বুদ্ধি দেবেন পাঠক? নিজের মাথায় কিচ্ছু আসছে না যে!