Posts

উপন্যাস

মায়া গন্ডি পর্ব১০

August 8, 2025

Mohammad Nur

85
View

মায়া গন্ডি
.
পর্ব ১০
.
মোহাম্মদ নূর
.
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। সবার নজর ঘাটের দিকে। ঐশ্বর্য নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে। শান্তি তার মেয়েকে দেখে ক্লান্ত এক হাসি দিয়ে চোখের জল মুছে ফেলল। ঐশ্বর্যের কিছুতেই মায়ের এই অবস্থা সহ্য হচ্ছে না।

হুইলচেয়ারে বসে সে একবার বাবার দিকে তাকায়, একবার মায়ের দিকে। রবি মাথা নিচু করে ফেললেন। বাবার নির্বাক  নীরবতা দেখে আর বুঝতে বাকি রইল না—সবাই সবকিছু আগেই জানতো।

সে লঞ্চের ডান পাশে চলে আসে, হুইলচেয়ারের চাকা নিজেই ঘুরিয়ে উপর থেকে মায়ের দিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। শান্তি মনকে শক্ত করে নিচ থেকে ইশারায় চুপ করতে বলে, হিজাবটাও ঠিক করতে বলে। তখন নওয়াজ এসে ঐশ্বর্যকে নিচে নিয়ে আসে।

ঐশ্বর্য কিছুই বুঝতে পারছে না—কি হচ্ছে? কেন তার মাকে পুলিশ ধরবে?

নিচে নামতেই সে আর বসে থাকতে পারে না। দুর্বল শরীর নিয়েও হুইলচেয়ার থেকে উঠে গিয়ে মায়ের কোলে ঢলে পড়ে। শান্তি ঐশ্বর্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

ঐশ্বর্য কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,
— আম্মা, খুব ভয় করছে। এসব কি হচ্ছে? আমার কিছু ভালো লাগছে না, চলো আমরা বাড়ি যাই!

শান্তি নিজেকে কঠোর করে বলল,
— এইসব কী করছো তুমি এতো মানুষ এখানে? তুমি কিন্তু আমার শিক্ষার মর্যাদা রাখছো না, নিজেকে সামলাও। আমি ভয় পেতে মানা করেছি তুমাকে নিজেকে সাম্লাতে শিখ।

কিন্তু ঐশ্বর্য থামছে না। কেউ তাকে কিছু বলেও বোঝাতে পারছে না। সে আকাশকে বলল,
— শুনুন না? আমার মায়ের কি দোষ! ছেড়ে দিন না, আমি মাকে ছাড়া থাকতে পারবো না!

দুজন নারী কনস্টেবল ঐশ্বর্যকে আটকাতে আসে, কিন্তু আকাশ তাদের ইশারায় থামিয়ে দেয়। আর ঐশ্বর্য কে উদ্দেশ্য করে বলে,
— দেখুন, এখন কিছু করার উপায় নেই। সব প্রমাণ আপনার মায়ের বিরুদ্ধে।

তবুও কে শুনে কার কথা? ঐশ্বর্য কিছুতেই মানতে চাইছে না।
আকাশ বলল,
— আমি আপনার মাকে ছাড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো, যত দ্রুত সম্ভব।

তখন এদিকে রবি ও রেহানা এসে ঐশ্বর্যকে টানতে থাকে। তার কান্না আরও বেড়ে যায়।

এমন সময় নওয়াজ বলে উঠল,
— স্যার, উনাকে ছেড়ে দিন, আসল আসামি আমি। সেদিন রাতে আমার হাতেই খুন হয়েছিল। শান্তি কাকি আমাকে বাঁচানোর জন্য সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়েছেন।

সবাই নওয়াজের দিকে তাকায়। শান্তি কিছু বলে না। সে যেনো সব আগেই জানতো।

আকাশ কঠোর গলায় বলল,
— এটা কোনো খেলা না। আপনি যা বলছেন, ভেবে চিন্তে বলুন। আপনার ফাঁসিও হতে পারে।

নওয়াজ বলে,
— তবে তাই হোক। যদি আমার কোরবানিতে দুটো মন খুশি হয়, তাহলে আমি হাসিমুখে নিজেকে কোরবান করে দেবো।

ঐশ্বর্য তখনো মায়ের গলায় মুখ গুঁজে কাঁদছে যেনো জীবনের সব কান্না একসাথে ভেঙে পড়েছে।

রবি বললেন,
— তুমি কী বলছো, একবার ভেবে দেখো।

শান্তি বলল,
নওয়াজ, আমি জানতাম তুমি কিছু একটা করবেই কিন্তু এটা করবে ভাবতেও পারিনি। আমি জানি না তোমার মনে কী চলছে, তবে আমি জানি, তুমি খুব ভালো ছেলে। এভাবে নিজের জীবন নষ্ট কোরো না। তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি। সামনে পুরো ভবিষ্যৎ পড়ে আছে।

নওয়াজ হেসে বলল,
— মনে শান্তি থাকলে কলঙ্কও বোঝা মনে হয় না। আপনারা আমার আপনজন, আপনাদের জন্য এতটুকু করলে আল্লাহ খুশি হবেন।
আকাশ আবার বলল সবটা এতো সোজা না আপনি একবার ভেবে দেখুন। শান্তি কাকি মহিলা মানুষ উনার শাস্তি কমানো যেতে পারে। কিন্তু আপনার টা কমবে বলে আমার মনে হয় না। আপনি প্লিজ জেদ ছেড়ে দিন। আমরা কোনো না কোনো ভাবে উনাকে ছাড়িয়েই নিবো কারন আমার বিশ্বাস কাকি এই কাজ কোনো ভাবেই করবেন না।

শান্তির চোখে পানি এসে গেল। সে নওয়াজ কে উদ্দেশ্য করে বলল,
আজ নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। তোমার মতো মহৎ মনের মানুষ বিরল।

নওয়াজ — ছি এই সব কি বলছেন হয়তো খুব কম দিনের পরিচয় আমাদের। কিন্তু আমি আপনাদের মাঝে আমার পরিবার খুজে পেয়েছি। আর আমি তো আপনার ছেলের মতোই ছেলেকে ছেলের কর্তব্য পালন করতে দিন।

আকাশ মাথা থেকে টুপিটা খুলে বলল,
আমি এই প্রথম কাউকে, অন্যের জন্য নিজেকে এভাবে বিলিয়ে দিতে দেখছি।

রবি বললেন,
তবে কি তুমি ঠিক করে নিয়েছো তবে বেশ তাই হবে কিন্তু মনে রেখো আমি তোমাকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে হলেও ছাড়িয়ে আনবো। এটা রহমান ছেলের ওয়াদা। এটা একজন মুক্তিযোদ্ধার ওয়াদা। আশা ভাঙবো না।

নওয়াজ বলল,
আমাকে ছাড়াতে হবে না আমি এমনি বেরিয়ে আসবো আল্লাহর উপর বিশ্বাস আছে আমার। তবে আমাকে কথা দিন আমি বেরিয়ে এসে আপনার কাছে যা চাইবো তাই দিবেন।

রবি কিছু একটা ভাবে শান্তির দিকে তাকায় শান্তি চোখের ইশারায় সম্মতি দেয়। তার পর রবি কথা দেই আমি ওয়াদা কোরলাম তুমি যা চাইবে তাই পাবে।

নওয়াজ বলল,
— আমি জেল থেকে বের হলে আপনাদের সালাম নিতে অবশ্যই আসবো।

আকাশ শান্তির হাত থেকে হ্যান্ডকাফ খুলে নিয়ে নওয়াজের হাতে পরিয়ে দেয়।
তার পর আকাশ বলল,
— তাহলে আমরা চলি!

তারা নওয়াজকে নিয়ে চলে যায়।

রবি তার পরিবার নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। ঐশ্বর্য মাঝ পথে অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তাই তারা একটি ভ্যান ভাড়া করে বাড়ি আসে।

বিকেল হয়ে এসেছে। ঐশ্বর্যের জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু শরীরে কোনো শক্তি নেই। ছয়দিন ধরে তার জীবন কেবল স্যালাইনের মাধ্যমে চলেছে।

বাড়িতে থমথমে পরিবেশ। ঐশ্বর্যের ঘরে একটি হ্যারিকেন জ্বলছে। ইউসুফ ও রেহানাও ঘুমিয়ে আছে।

ঐশ্বর্য দেয়ালে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। বাইরে পা দিতেই হোচট খায়, তবে পড়ার আগেই শান্তি তাকে ধরে ফেলে।

— এখন উঠলি ঐশি?
ঐশ্বর্য আবার কাঁদতে শুরু করে। শান্তি ধমকে বলল,
— এইসব কী ঐশি? কথায় কথায় কান্না করছিস! তোকে তো কতবার বলেছি, ভয় পেতে নেই।

ঐশ্বর্য তার কোলে মাথা রেখে খুব নরম শুরে ডাক দিলো
— আম্মা...
শান্তি অজান্তেই ঐশ্বর্য কে জরিয়ে একটা প্রশান্তি ময় হাশি দিলো।
শুধু এই একটা মায়াভরা ডাকেই শান্তির মন গলে যায়।

— তুমি আর কখনো আমার থেকে দূরে থাকবা না। তোমাকে না দেখলে আমার ভালো লাগে না আম্মা

— ধুর পাগল মেয়ে কই গেলাম আমি? আমি তো আছিই।

শান্তি মেয়ের এই পাগলামি কথা শুনেই মনে শান্তনা ফিরিয়ে আনে। সে বুঝে যায় মেয়ের মনে কিছু চলছে।

শান্তি — আমি তোর জন্য রান্না করছি। খাবি আয়।
ঐশ্বর্য — এখন কিছুই খাবো না।
শান্তি — আমি নিজে খাইয়ে দেবো।
ঐশ্বর্য — কিন্তু আমার খিদে নেই।
শান্তি — না থাকলেও খেতে হবে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ—একফোঁটা শক্তি নেই শরীরে।

ঐশ্বর্য আর কিছু না বলে শান্তির হাত ধরে খেতে বসে। শান্তি ভাত মেখে খাইয়ে দেয়।

— তাড়াতাড়ি খেয়ে নে পরে ওষুধ খেতে হবে।
ঐশ্বর্য খেয়ে ওষুধও খেয়ে নেয়।

শান্তি খেয়াল করে—ঐশ্বর্য কিছু একটার ভাবনায় ডুবে আছে। হয়তো সে রাতে যা হয়েছে, তা এখনো মনে গেঁথে আছে।

হঠাৎ সে বলল,
— আম্মা, পুলিশ তোমাকে কেন ধরেছিলো?
শান্তি থতমত খেয়ে বলে,
— আরে থাক, বাদ দে এইসব কথা পরে শুনিস।
ঐশ্বর্য আবার জিজ্ঞেস করলো, 
— না আম্মা, বলো। আমার মন শান্ত হচ্ছে না যে।

শান্তি, শান্ত গলায় বলল,
— এখন এসব কথা শোনার সময় না। আয় তোকে কিছু দেখাই।

সে ঐশ্বর্যকে নিয়ে ঘরে আসে, আলমারি খুলে একটা সিন্দুক বের করে। ঐশ্বর্য অবাক—এই সিন্দুক তো সে কখনো দেখেইনি।

ধুলো জমে আছে। শান্তি কোমর থেকে চাবি বের করে খুলে ফেলে। ভেতরে কিছু পুরনো খাম, চিঠি আর তিনটি শাড়ি।
শান্তি অস্ত্র ভেজা চোখ নিয়ে বলল,
— এইগুলো উর্মি রেখে গেছে যাওয়ার আগে। আর একটা চিঠি ছিলো আমার জন্য।

ঐশ্বর্য চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো

উর্মির চিঠি:

**“মা, তোমার মতো দ্বিতীয় কেউ নেই। ছোট থেকে তোমার শিক্ষা পেয়েই আমি বড় হয়েছি। রহমান বাড়ির প্রতিটি কোনায় কোনায় নিজেকে জোরিয়ে রেখেছিলাম। খুব মায়া জন্মেছে এইবাড়িটির প্রতি। কিন্তু আমি এই নরকে থেকে তোমার ওপর অত্যাচার আর সহ্য করতে পারছি না। আমি রফিককে ভালোবাসি, সেও আমাকে অনেক ভালোবাসে।
আমরা দূরে কোথাও সংসার করবো। সিন্দুকে একটা খামে আমাদের ঠিকানা আছে। বাবাকে বলে দিও, যেদিন তোমার উপর বিশ্বাস ফিরবে—সেদিন আমাকে চিঠি পাঠিও।
এই সিন্দুকে কিছু জিনিস ও কিছু চিঠি আছে যা একান্তই ঐশ্বর্যের জন্য।
যেদিন মনে হবে ঐশ্বর্য কষ্টে আছে, ওকে চিঠিগুলো দিও। ওকে যত্নে বড় করো। আমি গর্ব করে একদিন বলবো—আমার বোন কঠিন পরিস্থিতিতেও এক রাজরানির মতো বড় হয়েছে।

ভালো থেকো।
ইতি—উর্মি”

শান্তি বলল,
উর্মি আমার জীবন থেকে যাওয়ার পর আমার দিন গোলো খুব কষ্টে কেটেছে। আমি নিজেকে খুব কষ্টে সামলেছি। আমি ওর দেওয়া ঠিকানা মতো অনেক খোঁজ চালিয়েছি কিন্তু পাইনি।

ঐশ্বর্যের চোখে পানি আসে, মুখে হালকা হাসি।
— আম্মা, আমি জানতাম বুবু আমার জন্য কিছু না কিছু রেখে গেছেন।

শান্তির মুখ মলিন হয়ে যায়।
ঐশ্বর্য বলল 
— আম্মা,
এগুলো আমি ঘরে নিয়ে যাই? আমি সব গুলো চিঠি পড়ে দেখতে চাই।

শান্তি — চল, ঘরে দিয়ে আসি।

ঐশ্বর্য ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে, হ্যারিকেন জ্বালিয়ে চিঠিগুলো দেখে। সবগুলোতে ১, ২, ৩ করে নম্বর দেওয়া। সে এক নাম্বার চিঠিটা তুলে নেয়—

চিঠি – ১

“ঐশি অনেক ভাবনা চিন্তা করে লিখতে বসেছি। কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। কোনো তারিখ দিলাম না। শুধু মনে রাখ, এই দিনগুলো যদি তুই বুঝতে পারতি, তাহলে কখনো ভুলতে পারতি না।
যদি এই চিঠিগুলো তোর হাতে আসে, তাহলে বুঝে নিস—আমি আর রহমান বাড়িতে ফিরবো না।
আমাদের বাবা-মায়ের বিয়ে হয় যখন, আমার তখন ৯ বছর বয়স। হয়তো এখন বুঝিস না, তবে এটাও জেনে রাখ হয়তো তুই জানিস আম্মা তোকে বলেছে হয়তো—আমি তোর আপন বোন না।
আমার মা আমাকে জন্ম দিয়ে মারা যান। তখন থেকেই দাদু আমাকে সহ্য করতে পারতেন না। গ্রামের মানুষ বলতো—আমি নাকি নিজের মাকে খেয়ে নিয়েছে। ছি আমাদের গ্রামের মানুষের কি ধারণা। তুইই বল একটা অবুঝ শিশু কি করে নিজের মাকে মেরে ফেলতে পারে!
বাবা এইসব সহ্য করতে না পেরে আবার বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন শুধু মাত্র আমার জন্য । তখন বাংলাদেশের খুব করুন অবস্থা। পাক বাহিনীরা খুব উতপাত বারিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার আগে কপালগুণে মা বাবার সাথে বিয়েতে রাজি হন, আর আমাকে নিজের মেয়ের মতো গ্রহণ করেন। আম্মাও শুধু মাত্র বিয়েতে রাজি হয়েছিলো আমার চখের দিকে তাকিয়ে। 
গ্রামে সবাই বলতো—সৎ মা ভালো না। কিন্তু মা আমাকে কখনো বুঝতেই দেননি আমি তার আপন সন্তান না। এই গ্রামের মানুষের যতোটা ধারণা মা আমাকে তার থেকেও বেশি আগলে রেখেছেন।
এদিকে টানা নয় মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। আরেক দিকে আমাদের জীবনে তুই এলি। তর জন্মের পর তো আমার জীবনে নতুন আলো দেখতে পাই। আমি মায়ের রিন শোধ করার জন্য চিন্তা করে নেই তোকে এমন ভাবে বড় করবো জেনো মায়ের কোনো কৈফিয়ত না থাকে। আমি তোকে প্রথম কোলে নিয়েই তোর এমন ফুটফুটে চেহারা এতো সুন্দর মুখোস্রি দেখে বলেছিলাম—ওর নাম হবে ওর চেহারার মতো ওর নাম হবে ঐশ্বর্য। মা তখনি বলেছিলেন—এটাই নাম থাকবে তোর। আজ থেকে আমার ছোটো মেয়ের নাম ঐশ্বর্য।

কিন্তু সুখ তো আসেই দুঃখের আহ্বান জানিয়ে
আমাদের আনন্দময় জীবনে কাল ঘনিয়ে আসলো ১৯৭৮ সালের শুরুতে। এক অভিশাপ রহমান বাড়িতে পা রাখে… আমাদের জীবনের মোড় ঘুরে যায় সেদিন থেকেই”

ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
পর্ব ১১ আসছে শীঘ্রই পাশে থাকবেন ধন্যবাদ 

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Kazi Eshita 3 months ago

    তারপর কি হলো?