বেলি
কাজী ফাল্গুনী ঈশিতা
আজ বাড়ী থেকে বেরোতেই দেরি, ধুত্তরি! নিজের মনে ফুঁসতে ফুঁসতে বাস স্ট্যান্ডের দিকে চলেছে বেলি। টিউশনিতে ঠিক সময়ে যেতে না পারলে ছাত্রীদের মায়ের মুখে কালো ছায়া নামে। হাতখরচের টাকাটা বাড়ী থেকে চাইতে মোটেও ভাল লাগে না বেলির, তাই নিজের ক্লাস সামলে সপ্তাহে তিনটা টিউশনি করে সে। তাতে হাতখরচও হয়ে যায়, বাড়িতে কিছু সাহায্যও করা যায়।
খরচ বাঁচাতে অটোরিকশা না নিয়ে বাসে যায় বেলি। একশ টাকার মধ্যেই হয়ে যায়। সি এন জি নিলে প্রতিদিন তিন থেকে চারশো টাকার ধাক্কা!
ভিড় ঠেলে কোনমতে একটা লক্কড় ঝক্কর বাসে উঠল বেলি। বসতে না বসতেই কন্ডাক্টর এর কর্কশ কণ্ঠ ঃ “ভাড়া ডা দিয়েন আফা।”
“আরে মামা, দিমু তো ভাড়া, বাকিতে যামু নি? “ একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করতে করতে বিরক্তি ঝেড়ে দিলো বেলি।
প্রায় চল্লিশ মিনিটের রাস্তা আজ যেন ফুরতেই চাইছে না। ট্রাফিক জ্যামের যন্ত্রণায় ঠেলাগাড়ির গতিতে চলছে বাস। সাথে দুঃসহ গরম তো আছেই। গরমে অসুস্থ হয়ে কয়েকজন যাত্রী বমি করছে বাসের জানালা দিয়ে। ওড়নাটাকে আর একটু গুছিয়ে নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকায় বেলি। আরে সর্বনাশ! বেলা তিনটা প্রায়! সাড়ে তিনটার মধ্যে পৌঁছাতে না পারলে তো জবাবদিহি করতেই জীবন যাবে। দেরি হল কেন?
মিনিট পাঁচেক পরে হথাত টান লাগল বেলির ওড়নায়। পাশ থেকে ভেসে এলো মিষ্টি কণ্ঠস্বর ঃ
“একটা চকলেট নেন না, আফা।”
সামনে দাঁড়ানো আট নয় বছরের মেয়েটির হাতে লজেন্সের প্যাকেট। তার থেকে দুটো লজেন্স বেলির কোলে রেখে দিয়েছে সে। মেয়েটির রুক্ষ, বিবর্ণ চুলে হয়ত ঠিক মতো চিরুনি পড়ে না। শ্যামবর্ণ মুখটাও কেমন মলিন, তবে ভীষণ মায়াভরা এক জোড়া গভীর কালো চোখ। কোলে রাখা কফি ক্যান্ডি দুটো তুলে নিয়ে ওর হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট ধরিয়ে দিলো বেলি।
পাঁচ টাকার নোটটা হাতে পেয়ে হাসিতে ভরে উঠল মেয়েটির মুখ। অন্য যাত্রীদের দিকে এগোল সে, আরও বিক্রির আশায়। বেলির এটা দেখে ভাল লাগল যে মেয়েটি ভিক্ষা করছে না, আর অনেকেই কিনছে ওর লজেন্স।
আচমকা বেলির চোখে পড়ল, মাঝবয়সী এক ভদ্রবেশী পুরুষ যাত্রী, চকলেট নেওয়ার বাহানায়, খাবলে ধরেছে মেয়েটির বুকের কাছে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলেও সামলে নিলো মেয়েটি। ততক্ষণে বাস পৌঁছে গেছে বেলির গন্তব্যে। বাস থেকে নেমেও একটু আগে দেখা দৃশ্যটি ভেবে ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠল বেলির। ছিঃ! ওই বাচ্চা মেয়েটি ভদ্রলোকের নাতনির বয়সী হবে। এ কেমন মানসিক বিকারগ্রস্থ পুরুষ?
ছাত্রীদের বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়াতেই পোষা বেড়ালের ম্যাও কানে এলো বেলির। এ বাড়ির গিন্নি শখে বেড়াল ছানা পোষেন।
“তুমি আজও দেরি করলে নিলুফার? এভাবে চললে আর পড়াতে আসার দরকার কি?”
সায়রা হকের হুংকারে আত্মা কেঁপে উঠলেও কিছু বোঝাল না বেলি। মুখে বলল ঃ “রাস্তায় অনেক জ্যাম তাই...”
বেলিকে দেখেই ছুটে এলো বিনি আর রিনি। প্রায়ই আপুকে মায়ের অহেতুক বকুনি থেকে বাঁচায় যমজ দুবোন।
“আপুকে তুমি কিচ্ছু বলবে না!” সমস্বরে বলে উঠল বিনি রিনি।
“ওদের জন্য এ যাত্রা বেঁচে গেলে মেয়ে, এরপর থেকে দেরি করলে আর চাকরি থাকবে না, মাথায় থাকে যেন!” উচ্চস্বরে কথাগুলো বলে চলে গেলেন তিনি।
বেলি বসল দ্বিতীয় শ্রেণী পড়ুয়া দুই বোনকে নিয়ে। দুজনকে প্রায় দশটা বিষয় বোঝাতে একটু মাথার খাটুনি হয়, তবে মাস শেষে পাওয়া টাকার অঙ্কটি ওর জন্য কম নয়। বিনিকে জ্যামিতি বোঝাতে বোঝাতে নিজের একরঙা সালওয়ার কামিজের দিকে তাকায় বেলি। ছোটবোন মিলিও বলে দিয়েছিল নতুন পোশাক নিয়ে আসতে। মাত্র এক বছরের ছোট হওয়ায় দুবোনের একই মাপ। আজ বেতন দেবার দিন, সায়রা হকের মেজাজ চড়া দেখে বেশ ভয় লাগছে বেলির।
“আপু আমার এই ইংরেজি অনুবাদ টা ঠিক আছে? দেখত?
রিনির প্রশ্নে সম্বিত ফেরে বেলির। “এইতো দেখছি, দাও...”
একটু পরেই চা আর নোনতা বিস্কুটের ট্রে হাতে ঘরে ঢোকেন সায়রা হক। বেলির হাতে একটা ছোট্ট সাদা খাম ধরিয়ে ওর অগোছালো চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে চলে যান। এ মহিলার “দুঃখিত” বলার এটাই নিয়ম। মায়ের স্বভাব বিনি রিনিও জানে।
“আপু, আজ মাম্মার একটু জ্বর এসেছে তো, তাই মাম্মা ফায়ার হয়েছিল তখন। এখন দেখো মাম্মা আইস হয়ে গেছে।”
বিনির কথায় হেসে ফেলে বেলি। অসুস্থ হলে আচমকা রেগে যান মিসেস হক, জানে বেলি। খামটা ব্যাগে ঢুকিয়ে, বাসে কেনা কফি ক্যান্ডি দুটো বিনি রিনির হাতে ধরিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিলো সে।
দুদিন পর টিউশনিতে যাবার পথে আবার সেই মেয়েটিকে দেখল বেলি, একইভাবে বাসে লজেন্সের প্যাকেট হাতে। সেই রুক্ষ চুল আর গভীর কালো চোখ। পরনের ফ্রকটা বেশ ছেঁড়া। বেলি ইশারায় কাছে ডাকল ওকে।
“এই মেয়ে , আমাকে আজকে দশটা লজেন্স দাও, আমার অনেক ভাল লাগে খেতে। ভিড় বাসে নামতে না পেরে বেলির পায়ের কাছেই বসে পড়ল মেয়েটি। কথায় কথায় বেলি জানলো, ওর নাম ফুলি। কাছেই বস্তিতে মায়ের সাথে থাকে সে। মা আশেপাশের বাড়িতে যে কাজ করে, তাতে ভদ্রসমাজ ছুটা বুয়া বলে ডাকে তার মাকে। ফুলি ভিক্ষা করতে চায় না, তাই লজেন্স বিক্রি করে সাহায্য করে মাকে। সন্ধ্যার পর যায় পথশিশুদের স্কুলে। মেয়ে জন্ম দেবার “অপরাধে” ফুলির বাবা ওর মাকে ছেড়ে আর একটা বিয়ে করেছে, কারণ তার বংশের বাত্তি চাই।
“আফা, মায়ে কইসে মাইয়ারা বংশে বাত্তি দিবার পারে না, তাই বাপে আর একখান মা আন্সে ...”
বেলি শুনে মনে মনে রাগে ফুঁসতে থাকে। আরে এই বংশের বাত্তি পৃথিবীতে আসেই তো মাইয়াদের জন্য, সেটা কেন ভুলে যায় অকৃতজ্ঞ পুরুষেরা? ফুলির দাদীও তো মাইয়াই ছিলেন, তাইনা? কই, বাড়িতে তো বেলির আব্বা আছেন, তিনি তো এভাবে ভাবেন না? তাঁকে তো বেলি- মিলি কেউ কোনদিন ছেলের জন্য হাপিত্যেশ করতে দেখেনি। বেলির আম্মাও তো খুশি দুই মেয়ে নিয়ে। সেদিন ফুলির হাতে বিশ টাকার একটা সবুজ নোট ধরিয়ে বাস থেকে নেমেছিল বেলি। দ্বিগুণ হাসিতে ভরেছিল ফুলির মলিন মুখ।
দুদিন পরেই কোরবানির ঈদ। ঈদুল আযহায় নতুন কাপড় অনেকেই কেনে না, তবু মিলির আবদার রাখতে বিনি রিনির বাড়ি যাবার আগে কাপড়ের দোকানে ঢুকল বেলি। হাতে প্রায় আড়াই হাজার টাকার মতো। খুব বেশি দামি কাপড় কোনদিন পছন্দ নয় বেলি বা মিলির। আকাশী নীলের ভেতর সাদা ফুলছাপ দু সেট সেলাইবিহীন সালওয়ার কামিজ তুলে নিলো বেলি। তখনি চোখে পড়ল লালের ভেতর কালো নকশাকাটা একটা ফ্রক। বেলির চোখের সামনে ভেসে উঠল ফুলির গভীর কালো চোখ। নিজেদের কাপড়ের বাজেট থেকে কিছু টাকা কমে গেলেও বেলির মনে একটা অদ্ভুত শান্তি ভর করল ফ্রকটা কেনার পর। সেদিন বাসে ফুলির গোটা লজেন্সের প্যাকেটটা কিনে নিয়েছিল বেলি। ওটা হাতে পেয়ে বিনি রিনির আনন্দ দেখে কে? আর ফ্রকটা দেখে কেঁদে ফেলেছিল ফুলি ঃ “আফা গো, মেলা দিন নতুন জামা চোখে দেহি নাই...” ওদের হাসিতেই পূর্ণতা পেয়েছিল বেলির ঈদ।
দ্রষ্টব্য ঃ শ্রদ্ধা, সেই সকল পুরুষকে, আমার জীবনে যারা কেউ শিক্ষক, কেউ ভাই, কেউবা প্রিয় বন্ধু। ভালবাসা, সেই সব নারীদের, যারা শিক্ষিকা, বোন বা বান্ধবী হয়ে আগলে থাকেন আমায়। ভাল খারাপ তো নারী পুরুষ উভয় গোত্রেই থাকে, খারাপটুকু বর্জন করে আমরা কি ভালটাই গ্রহণ করতে পারিনা?
19th August 2019
.