ছায়া থেকে আলো
রাফি শহর থেকে ফিরছে। ট্রেনের জানালায় তার চোখ স্থির, কিন্তু মন অস্থির। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ, চাকরির খোঁজ চলছে, কিন্তু শহরের ব্যস্ততা, প্রতিযোগিতা, আর একাকিত্ব তাকে ক্লান্ত করে তুলেছে। সে ভাবে, “আমি কি ফিরে যাচ্ছি, না কি পিছিয়ে যাচ্ছি?” তার বন্ধুরা ঢাকায় চাকরি করছে, কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। রাফি নিজেও চেয়েছিল এমন কিছু, কিন্তু তার ভেতরে একটা টান—যেটা শহরের আলো ছুঁতে দেয় না।
বাড়িতে পৌঁছেই সে দেখে মা’র কাশি বেড়েছে, বাবার মুখে চিন্তার রেখা, আর ছোট বোন মীম তার পুরনো বই দিয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন আঁকছে। ঘরের বাতাসে যেন এক ধরনের চাপা অভাব, কিন্তু তার চেয়েও বেশি—নীরব ভালোবাসা।
মা তাকে দেখে হাসেন, কিন্তু সেই হাসির ভেতরে ক্লান্তি লুকানো।
“তুই তো শহরে ভালো করছিলি। আবার ফিরে এলি?”
রাফি উত্তর দেয়, “শুধু ফিরিনি মা, বুঝতে এসেছি—আমার জায়গাটা কোথায়।”
রাফি চাকরির জন্য আবেদন করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিদিনের খরচ, মা’র ওষুধ, মীমের স্কুল ফি—সব মিলিয়ে চাপ বাড়ছে। একদিন সে দেখে, মা চুপচাপ রান্না করছেন, বাবার পেনশনের টাকায় হিসাব মিলছে না, আর মীম তার পুরনো বইয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন লিখে রেখেছে।
রাফি নিজের ডায়েরিতে লেখে:
> “দায়িত্ব মানে শিকল নয়।
> দায়িত্ব মানে ছায়া—যা রোদে ঠান্ডা দেয়, আর ঝড়ে আশ্রয়।
> আমি যদি না থাকি, মা কে ওষুধ দেবে?
> বাবা কে শুনবে?
> মীম কে বলবে, ‘তুমি পারবে’?”
পরদিন থেকে রাফি বদলে যায়। সে স্থানীয় স্কুলে পড়াতে শুরু করে।
সন্ধ্যায় টিউশন নেয়।
রাতের বেলা ইউটিউব চ্যানেল চালু করে—“শিখি বাংলায়”, যেখানে সে বাংলা, ইংরেজি, আর ইতিহাস শেখায়।
তার ভিডিওতে সে বলে:
> “বন্ধুরা, দায়িত্ব মানে শুধু দায়িত্ব নয়।
> এটা ভালোবাসা।
> এটা এমন এক ছায়া, যা নিজে পুড়ে অন্যকে ঠান্ডা রাখে।”
তার ভিডিও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়।
একদিন, একটি এনজিও তার ভিডিও দেখে তাকে অফার করে—“আমাদের সঙ্গে কাজ করো, গ্রামের ছেলেমেয়েদের শেখাও।”
রাফি মা-বাবার সামনে বসে:
“আমি চাকরি পেয়েছি। কিন্তু এখানেই, এই শহরে। আমি তোমাদের ছেড়ে যাচ্ছি না।”
মা বলেন, “তুই তো আমাদের ছায়া। কিন্তু আজ তুই আলোও।”
বাবা বলেন, “তোর দায়িত্ব শুধু আমাদের নয়, সমাজেরও। তুই শিক্ষক, তুই পথপ্রদর্শক।”
রাফি মীমকে নতুন বই কিনে দেয়।
মীম বলে, “ভাইয়া, আমি ডাক্তার হবো। কিন্তু বই তো পুরনো।”
রাফি হাসে, “তুই বই নয়, স্বপ্ন পড়বি। আমি তোর পাশে আছি।”
রাফি বুঝে যায়, দায়িত্ব মানে শুধু খরচ চালানো নয়।
দায়িত্ব মানে—তাদের স্বপ্নকে নিজের স্বপ্নে রূপ দেওয়া।
দায়িত্ব মানে—নিজের জীবনকে এমনভাবে গড়া, যাতে অন্যের জীবনও গড়ে ওঠে।
সে একদিন ডায়েরিতে লেখে:
> “আমি যদি একা উড়ি, পরিবার মাটিতে পড়ে যাবে।
> তাই আমি উড়ি, কিন্তু তাদের সঙ্গে—তাদের স্বপ্ন নিয়ে।”