বন্ধন- দ্বিতীয় পর্ব
মৃত্যু কি, বুঝে ওঠার আগেই আচমকা সেই শেষ দেখার ধকল সইতে পারিনি সেদিনের সেই ছোট্ট আমি। ওই কুঁচকে যাওয়া চামড়া আর শামুক ভরা কান দেখে চোখের সামনে কালো পরদা নেমে এসেছিল জীবনে প্রথমবার। আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে দাঁত লাগা। এরপর বহু বছর দুঃস্বপ্নের হানা, রাতে চোখ বুজলেও দেখতে পেতাম শেষ দেখা সেই মুখ। চমকে জেগে উঠতে হতো।
লেলু মারা যাবার পর বেশ কিছু বছর বাড়িতে ওর জন্মদিন আর মৃত্যুদিনে মিলাদ মাহফিল করা হতো (এখন এ আয়োজন মসজিদে করা হয়, বাড়িতে নয়।) এই মিলাদের তদারকির ভার বড়দের সাথে আমারও থাকত। মিলাদ মানেই কিছুটা থমথমে, একটু অন্য রকম পরিবেশ। অন্তর্মুখী আমি তখন একটু একটু করে সবার সাথে মিশতে শিখছি। আছে কিছু বন্ধু বান্ধবীও, যারা আমায় বেশ বুঝত।
তেমনি এক মিলাদের দিন, সাল ২০০৬। আমি বড়দের সবার চোখের আড়ালে, নিজের উথলে ওঠা আবেগকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় ছিলাম। সবার সামনে কান্নাকাটি পোষায় না আমার। নোকিয়া ১১১০ এর আওয়াজে ঘোর কাটল। স্ক্রীন এ ভেসে উঠল একটা নাম, যে মানুষটা আজ আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ঃ রিফাত।
পাঠক ভাবছেন কি? প্রেমে পরেছি আমি? হা হা! মোটেও না। শুনুন তবে।
সে আমার সহপাঠী ২০০৫ থেকে, বয়সে আমার থেকে প্রায় আড়াই বছরের ছোট যদিও । ততদিনে বেশ ভাল বন্ধুও বটে। আমি তো স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছিলাম, হুট করেই প্রশ্নঃ-
“কি হল কি? গলা কাঁপে কেন তোর?”
“কাঁপে মানে? বেশি শুনিস কানে? কাঁপবে কেন?”
এবার ওর কণ্ঠে কিছুটা শাসন ঃ-
“আমি তোর গলার স্বর চিনি। তোর গলা কাঁপা মানেই কোন সমস্যায় আছিস, ঝেড়ে কাশ, নয়ত ফোন কাটলাম কিন্তু! “
আর পারলাম না। বন্ধুবান্ধবদের থেকে লেলু কাহিনী আড়ালেই ছিল, কারণ এ বিষয়টা নিয়ে কথা বলতাম না বললেই চলে। তবে সেদিন ওকে বলতেই হল, এবং ইনি ভদ্রলোক, কথার মাঝে কান্নাও বুঝতে পারলেন।
পুরোটা সময় নিয়ে শুনল সে । তারপর তার একটাই কথা ঃ “মৃত্যুকে এখনো হয়ত দেখিনি তোর মত, জানিনা। কিন্তু এটা জানি, আমার কোন বড় বোন নাই। বলছি না, ওনার জায়গাটা আমাকে দিয়ে দে, সেটা সম্ভব ও না কোনদিন। তবে আমাকে যদি যোগ্য মনে করিস, তবে তোর মনে আমার জন্য একটা জায়গা বানাস। তোর কান্না থামবে, আমি ও বোন পাব।”
ওর কণ্ঠে আকুলতা ছিল, থমকে গেছিলাম শুনে। কিছুটা রেগেই জবাব দিলাম ঃ “কি চাইছ বুঝে চাইছ তো ছেলে? আবেগ বাড়িয়ে ধাক্কা দেবার ধান্দা নয় তো এটা?”
হাল্কা হাসি শুনতে পেলাম অপর প্রান্তেঃ “বুঝেই বলছি”
এরপর থেকে বন্ধু থেকে পরিচিত, সবার এক প্রশ্ন শুনে আসছি ঃ “রক্তের সম্পর্ক নেই, তবু এরা পারে কি করে? একজনের মুখ থেকে কথা পড়ার আগেই আর একজন বুঝে নিচ্ছে, চিন্তা ধারা প্রায় এক এদের। যে মেয়ের আসে পাশে যে কোন ছেলে যাওয়ার আগেও কুড়ি বার চিন্তা করে, এই একটা মানুষকে সেই মেয়ে কেমন পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরতে পারে। আর এ ছেলেও তো কম না, এমনিতে কারাতে র পাঁচে যে কাউকে ধরাশায়ী করে ফেলা, একটু গম্ভীর, ধিরস্থির মানুষ, বোনের সামনে সে চার বছরের শিশু হয়ে যায়? কিসের টানে? দূরত্বও এদের সম্পর্কে প্রভাব ফেলে না? এ যুগে এটা হয়?
এখন যেমন আমি যুক্তরাষ্ট্র, আর রিফাত বাংলাদেশে, তেমনি ২০০৯-২০১২ রিফাত ছিল যুক্তরাজ্যে, আর আমি তখন বাংলায়। কারণ? কি আবার? লেখাপড়া! তবে যাই হোক না কেন, মুঠোফোনের বার্তা বাক্সে একজন আর একজন এর জন্য কিছু না কিছু রেখেই দেই, হোক সে গান, ছোট্ট চিঠি, বা ছবি। গানে লেলুর মত রিফাত ও বেশ সুরেলা। ওর সেই মৃদু হাসির মায়ায় বাঁধা পড়েছিলাম, আজও বেঁধেই রেখেছে। কখনো অভিমানে যদি বলেও বসি, যাহ, চলে যা, ফেলে দিলাম তোকে, হালকা হাতে জড়িয়ে বলবে ঃ ফেলে দিবি? ফেলে দেখা তো। বলেই সেই হাসি। আজ লেলু কে মনে পড়ে তো লম্বা ডাক ছাড়তে পারি ঃ রিফু, কই রে আমার বিলাই টা? সাথে সাথেই উত্তর আসে ঃ এইযে আপু, আছি তো।
ফেলে দেব একে? আমার ঘাড়ে কটা মাথা? একে ফেলতে গেলে নিজেই আহত হতে হবে। ভাল থাকুক পৃথিবীর সব ভাই বোনেরা। ভালবাসি তোকে, রিফু।
(দ্রষ্টব্য ঃ এক জনের কথা বলেছি এ পর্বে, এমন আর এক জন আছে জীবনে, আর ও কিছুটা ছোট সে আমার থেকে। এদের জন্য আজ প্রতিমুহূর্তে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই, আর লেলুর আত্মার শান্তি কামনা করি। )