Posts

সমালোচনা

পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সবুজ রক্ষার শপথ ভেঙে জাফলংয়ে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব!

August 11, 2025

S. M. Shoaib Tasin

104
View

পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সবুজ রক্ষার শপথ ভেঙে জাফলংয়ে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব!
 

এস. এম. শুআইব ত্বাসীন

ছবি : সংগৃহিত 

জাফলং বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত এক অনুপম নৈসর্গিক ভূখণ্ড, যেখানে নদীর কলতান, পাহাড়ের সবুজ প্রলেপ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার মহিমা দীর্ঘকাল ধরে মানুষের হৃদয় জয় করে এসেছে। এই ভূখণ্ড শুধু পর্যটন আকর্ষণই নয়, বরং একটি অমূল্য ইকোসিস্টেম, যা স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ও নদীর জীবনধারার অপরিহার্য অংশ। অথচ সাম্প্রতিক সময়ের পাথর উত্তোলনের লাগামছাড়া দৌরাত্ম্য এই সমগ্র সৌন্দর্যকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। এই ধ্বংসযজ্ঞের কেন্দ্রবিন্দুতে যে বিরোধাভাসটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা হলো বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের অবস্থান ও ভূমিকা।
বিগত সময়ে তিনি ছিলেন রাস্তায় রাস্তায় সংগ্রামী এক পরিবেশযোদ্ধা। পান্থকুঞ্জ পার্ক রক্ষা আন্দোলনসহ অসংখ্য পরিবেশ আন্দোলনের প্রথম সারির সংগঠক ছিলেন তিনি। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই উদ্যানকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে তিনি বছরব্যাপী আদালত, সংবাদমাধ্যম ও রাজপথে লড়াই চালিয়েছেন। তখন তার কণ্ঠে উচ্চারিত হতো মহৎ ও ন্যায়সংগত বাণী, যা জনমতকে জাগ্রত করত এবং রাষ্ট্রীয় উদাসীনতাকে চ্যালেঞ্জ জানাত। কিন্তু এই আন্দোলন আজও চলমান, এবং আন্দোলনের যৌক্তিকতা অটুট থাকা সত্ত্বেও এর কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এখনও অনিশ্চিত। আর এই অনিশ্চয়তার মূলে রয়েছেন সেই মানুষটি, যিনি আজ ক্ষমতার কেন্দ্রে আসীন হয়ে এসব প্রশ্নের সরাসরি দায় এড়াচ্ছেন।

৫ আগস্ট ২০২৪-এ স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর তিনি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হলেন, পরে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও নিলেন। এখান থেকেই শুরু হলো দ্বিচারিতার এক নতুন অধ্যায়। ২০২৫ সালের জুন মাসে জাফলং পরিদর্শন শেষে তিনি ঘোষণা দিলেন, সিলেটের কোনো পাথর কোয়ারি আর ইজারা দেওয়া হবে না এবং অবৈধ পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেইসঙ্গে ইকো-ট্যুরিজমের মাধ্যমে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও পাথরশ্রমিকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতিও করলেন। কিন্তু এই ঘোষণার পরও বাস্তবে দেখা গেল সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। ক্ষমতার চেয়ারে বসার পর থেকেই জাফলং-এ পাথর উত্তোলনের এক মহোৎসব শুরু হলো। জাতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, গত নয় মাসে সিলেট অঞ্চলে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। একাধিক মোবাইল কোর্ট অভিযান চালিয়ে পাথর বোঝাই নৌকা ও ট্রাক জব্দ করা হলেও পাথর উত্তোলনের লাগাম টেনে ধরা যায়নি। পাথরের মিছিল থামেনি, বরং প্রশাসনিক উদাসীনতার ছায়ায় আরও বিস্তৃত হয়েছে।

এখানেই প্রকাশ পায় এক নির্মম বৈপরীত্য। যে মানুষটি একসময় আদালত ও রাজপথে লড়াই করে অবৈধ দখল ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন, তিনি আজ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আসনে থেকেও সেই একই আন্দোলনগুলোকে বিজয়ের পথে নিয়ে যেতে পারছেন না। পান্থকুঞ্জ হোক বা জাফলং, তার প্রতিশ্রুতি ও নীতিবাক্যের বিপরীতে বাস্তবতার হিসাব ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারাচ্ছে তার সবুজ পরত, নদীর স্বচ্ছ জল হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক প্রবাহ, আর শহুরে উদ্যানগুলো হারাচ্ছে তাদের অস্তিত্ব।

এই দ্বিচারিতা শুধু একজন ব্যক্তির নৈতিক স্খলন নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পরিবেশনীতির অন্তর্গত এক কাঠামোগত সংকটের প্রতিফলন। যখন পরিবেশ রক্ষার প্রশ্ন ক্ষমতার ভারসাম্যে আটকে যায়, তখন আন্দোলনের চেতনা হারিয়ে যায় রাজনৈতিক আপসের অন্ধকারে। জাফলং ও পান্থকুঞ্জ আজ দুটি প্রতীক, যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নাগরিক সবুজায়ন উন্নয়নশীলতার নামে ধ্বংসযজ্ঞের দ্বন্দ্বে আক্রান্ত। যদি কথার সঙ্গে কাজের এই বৈষম্য দূর না হয়, তবে আমাদের দেশ হারাবে তার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য, আর ইতিহাসে রয়ে যাবে কেবল ক্ষমতার কপটতার কালিমা।

এস. এম. শুআইব ত্বাসীন 
১১ আগস্ট ২০২৫
মহানগর প্রজেক্ট, হাতিরঝিল

ছবি : সংগৃহিত

Comments

    Please login to post comment. Login