শহরের শেষ বাসের অপেক্ষায় রাশি দাঁড়িয়ে ছিলো বাসস্ট্যান্ডে। বিকেল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি এখন থেমে গেছে, কিন্তু বাতাসে ছিলো একটু শীতল স্নিগ্ধতা। তার মাথায় কাজের চিন্তা, মনও ভারাক্রান্ত, দিনভর অফিসের ক্লান্তি তার চোখে স্বপ্নের জায়গা কমিয়ে দিয়েছিলো। বাস এসে থামল; রাশি উঠে উঠলো সামনের দিকে একেবারে জানলার পাশে।
অল্পক্ষণ পরে বাসে উঠে এক যুবক, যার হাতে ছিলো পুরনো ক্যামেরা। তার নাম অর্পণ। ঢেউ খেলানো কালো চুল আর মৃদু হাসি তার চেহারায় এক অনির্বচনীয় শৈশবের জাদু এনে দিচ্ছিলো। সে জানলার পাশে এসে বসল, আর রাশির দিকে একটু তাকিয়ে বলল,
“এই বাসটাই কি তোমার স্বপ্নের গন্তব্য?”
রাশি হালকা হেসে বলল, “স্বপ্ন? না, আমি শুধু একটা অজানা জায়গায় যেতে চাই যেখানে সব সমস্যার সমাধান থাকে।”
অর্পণ তার ক্যামেরা খুলে এক ঝলক ছবি তুললো বাসের ভিতর। “জীবনের ছবি যেমন ক্যামেরায় জমে থাকে, তেমনি কখনো কখনো আমাদের মনেও স্মৃতির ছবি জমে যায়, যা আমাদের পথ দেখায়।”
রাশি ভেবেছিলো, এ কি কোনও কবিতার লাইন? না, এই অচেনা যুবকের কথা তার মনকে খেয়াল করিয়ে দিচ্ছিলো জীবনের অন্যরকম রঙ।
বাস চলতে লাগলো, আর দুজনের কথোপকথন শুরু হলো। অফিস, জীবনের চাপ, স্বপ্ন আর ভালোবাসা নিয়ে তারা জানাশোনা করলো। অর্পণ বললো, “আমি এখানে একটি অদেখা শহর খুঁজতে এসেছি, যেখানে আমার হারানো স্মৃতিগুলো অপেক্ষা করছে।”
রাশি বলল, “অদেখা শহর? এমন শহর কোথায়?”
“যে শহর কেবল আমাদের হৃদয়ে থাকে, বাস্তবে নয়,” অর্পণ চোখে আশার ঝলক নিয়ে বলল।
বহুক্ষণ বাস চলল। রাশি বুঝতে পারল, এই অজানা অর্পণ যেন তার জীবনের সেই হারানো কিছুকে ফেরানোর জন্য এসেছে। তাদের কথাবার্তা মিষ্টি হয়ে উঠল, আর তাদের মনেও শুরু হলো এক অদ্ভুত সম্পর্কের আগুন জ্বালানো।
বাস যখন শহরের শেষ স্টপেজে পৌছালো, রাশি জানত না এই যাত্রা তার জীবনের শেষ নয়, বরং এক নতুন অধ্যায়ের শুরু। বাস থেকে নেমে তারা একসাথে হাঁটতে লাগল অন্ধকার শহরের পথে, যেখানে তারা একে অপরের চোখে নিজেদের ভবিষ্যতের গল্প খুঁজে পেল।
শহরের অলিগলিতে হেঁটে হেঁটে তারা এক মফস্বল কফি শপে গিয়ে বসলো। সেখানে অর্পণ তার ক্যামেরা খুলে কয়েকটা ছবি দেখালো—পুরনো শহরের গলি, হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির প্রতিচ্ছবি। রাশি মনে করল, কত কিছু হারানো হয়ে গেল তার জীবনে, আর এই অজানা যুবক যেন নতুন করে সেই স্মৃতিগুলো ফিরিয়ে আনছে।
“তুমি কি কখনো ভেবেছো,” অর্পণ বলল, “আমরা জীবনকে কত সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারি যদি হারানো মুহূর্তগুলো ধরে রাখতে পারতাম?”
রাশি হেসে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন। জীবনের অনেক বাধা থাকে।”
অর্পণ বলল, “বাধাগুলোই তো আমাদের ভালোবাসার গল্পকে মিষ্টি করে তোলে।”
রাশি প্রথমবারের মতো কারো কাছে এতটা খোলা মন দিয়ে নিজের ভাবনা শেয়ার করল। সে বুঝতে পারল ভালোবাসা মানে শুধু কথা বলা নয়, বোঝাপড়া আর বিশ্বাসও।
দিনের আলো হ্রাস পেতে শুরু করল, কিন্তু তাদের কথাবার্তা থামল না। রাতের নীল আকাশের নিচে, তারা দুজনে একে অপরের হাত ধরে শহরের পথে চলতে লাগল।
পরদিন সকালে রাশি অফিস যাওয়ার পথে ভাবছিলো, এই অর্পণ কি তার জীবনে নতুন আলো আনবে? কি এই অদেখা শহর সত্যিই তার স্বপ্নের ঠিকানা?
তারা দুজন দিনের পর দিন দেখা করলো, একসাথে শহরের খুঁজে বেড়ালো, স্মৃতির শহরে হারিয়ে গেলো। একদিন অর্পণ রাশিকে তার নিজের ছোট্ট স্টুডিওতে নিয়ে গেলো। সেখানে পুরনো ছবির আলমারি, ক্যামেরার সংগ্রহ আর কাগজে লেখা কবিতা ছিলো। রাশি বুঝতে পারল, অর্পণ শুধু একজন ফটোগ্রাফার নয়, সে একজন স্বপ্নদ্রষ্টাও।
এক সন্ধ্যায় অর্পণ বলল, “তুমি কি আমার সঙ্গে একটা যাত্রায় যাবা? যেখানে শুধু আমাদের গল্প থাকবে, আর বাইরের সব কিছু থেমে যাবে।”
রাশি একটু ভয়ে, কিন্তু তার হৃদয় নাচতে লাগল। সে বলল, “আমি তোমার সঙ্গে যাবো, যেখানে তুমি আমাকে নিয়ে যাবে।”
তারা দুজন একসাথে নতুন এক জগতে পা দিলো—যেখানে ভালোবাসা ছিলো একমাত্র সত্য।
বছর গড়িয়ে গেলো, কিন্তু রাশি আর অর্পণের ভালোবাসা যেমন গাঢ় হলো, তেমনি তাদের জীবনও নতুন রং পেলো। তারা একসাথে বড় হলো, স্মৃতির শহরকে ছুঁয়ে বেড়ালো, আর অদেখা শহরের শেষ বাসের যাত্রা হয়ে উঠলো জীবনের এক অবিস্মরণীয় গল্প।