পোস্টস

গল্প

দ্য বাম্বি সিন্ড্রোম

৩০ মে ২০২৪

নূহা চৌধুরী

মূল লেখক নূহা চৌধুরী

মোহনার সাথে পরিচয়ের পর আমার প্রথম মনে হলো, ঠিক এমন একজন মানুষকেই আমি মনে মনে খুঁজতাম। প্রথমে ওর ব্লগ পড়তাম, ব্লগে মেয়েটা দিনলিপি লিখতো, মাঝে মাঝে পড়ে খুব হাসি পেতো আর মাঝেমাঝে মন খারাপ। প্রায়ই ওর লেখা পড়ে মনে হতো মেয়েটা আমার মতো ভাবে কি করে? 

তারপর আমাদের বন্ধুত্ব হলো। এই বন্ধুত্বটা আমার জীবনের সেরা ঘটনা। একটা মানুষ একটা বিশ্বাসের জায়গা হতে পারে তাইনা? এক পশলা বৃষ্টির মত স্বস্তি কাজ করে মোহনার সাথে কাটানো সময় গুলোর পর।  আমার জীবনের বত্রিশ বসন্ত পার হয়ে গেছে, মিড লাইফ ক্রাইসিসে পড়ার মতোন সময় হয়েছে কিনা বুঝতে পারিনা।  কৈশোর থেকে অনেক গুলো ভুল করার পর আমি এখন বেশ হিসেবী। কিন্তু মোহনা সাথে থাকলে হুটহাট বেহিসেবী হতে ইচ্ছে করে। মোহনাকে পাশে নিয়ে আমি গুনগুন করে গাইতে পারি, বেখেয়ালী কথা বলতে পারি, ইচ্ছে হলে চুপ করে বসেও থাকতে পারি।  নিশ্চুপ বসে থাকার মাঝেও যে স্বস্তি রয়েছে এই ব্যাপারটা ও প্রথম আমাকে অনুভব করায়।  
 
বাসা থেকে যে মানুষটার সাথে আমার গাঁটছড়া বেঁধে দেয়া হয়েছিলো তার নাম তৃণা। আপাত দৃষ্টিতে চমৎকার মেয়ে। স্যোশাল, হাসিখুশি, ক্যরিয়ারিস্ট। কিন্তু তৃণার সাথে আমি সুখি হতে পারলাম না । তৃণা ঢাকা শহরের মত সদা চঞ্চল, টানা অনেকদিন থাকার পর ক্লান্তি চেপে ধরে। আমার বরাবরই মনে হয় আমি হয়তো পরিযায়ী পাখি হতে চেয়েছিলাম। এক জায়গায় অনেকদিন আটকে থাকা আমাকে টানেনা। ন’টা পাঁচটা অফিস ক্লান্তিকর, নিয়ম করে শুক্রবার রাতের দাওয়াত ক্লান্তিকর, অসুস্থ চাচী শাশুড়ীকে কিংবা বড়খালাকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়াও ক্লান্তিকর। আমি বড়জোর তাদের জন্য বাসায় থেকে প্রার্থণা করতে পারি কিন্তু মেকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে দু হাতে দু ঠোঙ্গা ভর্তি করে আপেল কমলা নিয়ে হাসপাতালের সোফায় বসে পা দুলাতে পারিনা। তাই তৃণা পারফেক্ট বৌ হলেও আমি পার্ফেক্ট হাজব্যান্ড কিংবা পার্ফেক্ট জামাই হতে পারলাম না। মনের দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে বিছানার দূরত্ব বাড়লো। মাঝে মাঝে আমাদের বাসার দেয়ালে কান পাতলে তৃণার চাপা অথচ হিংস্র আওয়াজ শোনা যায় ।
 
মোহনা মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। পৃথিবীতে প্লেটোনিক লাভ বলে কিছু নেই যারা বলে আমার মনে হয় তারা ভুল বলে। আমি যে কয়দিন ধরে মোহনা কে চিনি তার প্রতিটি মূহুর্ত আমি মোহনাকে ভালোবেসেছি। শারীরবৃত্তীয় ভালোবাসা ছাপিয়ে মোহনা আমার কাছে শান্তির একটা জায়গা। আমরা একসাথে বসে মুভি দেখেছি, বই নিয়ে আলোচনা করেছি, শিল্পকলায় রঙ তুলির আলো ছায়া দেখে একই সাথে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকেছি। 
 
শুরু থেকেই আমি আর মোহনা জানি আমাদের কখনো এক হওয়া হবেনা। আমরা হয়তো কোন বৃষ্টির দিনে অফিস পেরিয়ে কাঁচ বেয়ে আসা জলের ছাট দেখতে দেখতে কফি খাবো, ভোর রাতে প্রিয় গান শুনতে শুনতে একে অপরের কথা ভেবে একটু মৃদু হাসবো, কখনো সখনো জীবন খুব বেশি কঠিন হয়ে গেলে আমাদের হাতের উপর হাত আমাদের স্বস্তি দিবে, জানাবে আমি আছি, তুমি আছো, আমরা একা নই কিন্তু আমাদের আসলে কখনোই একটা ঘর হবেনা।  
 
তৃণা চেষ্টার কোন কমতি রাখেনি। মেয়েটা আমাকে শুরুর দিকে কিছুটা ভালোওবেসেছিল বলেই আমার ধারণা। আমিও চেষ্টা করিনি তা নয়। কিন্তু চা খেতে খেতে যে বেল্কনিতে দাঁড়িয়ে আমাদের গল্প করার কথা ছিলো, তৃণা সেখানে গল্প করতে আসতো ঠিকই, সে গল্পে আমি থাকতাম না। সেই গল্প জুড়ে থাকতো হল্যান্ড থাইল্যান্ড ট্রিপ, গুচির নতুন পারফিউম, মানোলোর কাটা কাটা ডিজাইনের জুতো। বেশিরভাগ সময় তৃণা ই বলতো আমার কাছে পরিষ্কার হতো না। মনে হতো ঘোলাটে শব্দরা আকার বেঁধে মাথার চারপাশে ঘুরে বেড়াছে। ডিজল্যাক্সিয়ায় আক্রান্তের মত সব উলট পালট, আমি এই কথা গুলো চিনি কিন্তু সাজাতে পারিনা। যেখানে কম্ফোর্ট নেই সেখানে একটা ঘর হয়তো হয় কিন্তু সংসারটা ঠিক হয়ে ওঠেনা। 
 
বাম্বি সিন্ড্রোম বলে ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে। ছোটবেলায় দেখা ওয়াল্ট ডিজনীর ক্ল্যাসিক সিরিজের পঞ্চম সৃষ্টি সেই বাম্বিকে আমাদের মনে আছে তো না? বড় বড় চোখের বাম্বি কে নিয়ে এই গাল ভরা নাম যার মূল বক্তব্য হচ্ছে ছোট্ট এক হরিণ ছানা মানব সভ্যতাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বন ছেড়ে আসে। তার চোখ ভরা আগ্রহ আর কাছ থেকে মানুষ দেখার ইচ্ছা। হরিণ ছানাটি  মনুষ্য স্পর্শের কাছাকাছি আসার পর তাকে  বনের প্রাণীরা আর আপন করে, নিজেদের করে কাছে টেনে নিতে নিতে পারে না। কারণ মানব স্পর্শের কারণে ছোট্ট হরিণ ছানাটি তার মাঝে থাকা বুনো ঘ্রাণ হারিয়ে ফেলেছে। আর সেই সাথে হারিয়ে ফেলেছে বনে থাকার সকল যোগ্যতা।  
 
আমার পরিবার আমার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য যে মানবীর স্পর্শে আমার মঙ্গলময় জীবন চেয়েছিলো, সেই স্পর্শের সাথে সাথে আমার সত্যিকারের আমি হতে পারার সমূহ সম্ভাবনা মিইয়ে গেছে। আমি পথ হারা হরিণ ছানার মত শহর আর বনে ঘুরে বেড়াই। কাউকে আপন করে পাইনা। যেখানে আপন করে কাউকে পাই তাকে আঁকড়ে ধরতে পারিনা। আমরা হয়তো পাশাপাশি বসে থাকি, আমাদের মনে দূরত্ব হয়তো সময় পরিমাপের এককে এক ন্যানো সেকেন্ড কিন্তু আমাদের সত্যিকারের দূরত্বও আসলে শত আলোকবর্ষের সমান। দূর থেকে নক্ষত্র দেখার মত মোহনা আমাকে আন্দোলিত করে। মোহনা নক্ষত্রের মতোই হলুদ, নক্ষত্রের মতোই অস্পৃশ্য।   হয়তো একটু সাহসী হতে পারলেই জীবন অন্যরকম হতে পারতো। , হৈমন্তীর বরের মত মোহনাকে বুকে চেপে ধরে ‘আমি পাইলাম ইহাকে পাইলাম’ আউড়াতে পারতাম। ইকারুসের মত মোমের ডানা মেলে হয়তো আমি ওর কাছাকাছি যেতে পারতাম।  আমার কম্ফোর্ট জোন মোহনা হয়তো আমাকে পুড়িয়ে দিতো। গলে যেতাম হয়তো আমি।   কিন্তু আমি সাহসী নই। আমি একই সাথে প্রচন্ড হিসেবী এবং প্রচন্ড ভীতু মানুষ।  সমাজের বানিয়ে দেয়া দেয়াল ভেঙ্গে আমার আর মানুষ হয়ে ওঠা হয়না। আমি পথ হারানো হরিণ শাবক হয়ে ঘুরে বেড়াই।