তাকে আমি যখন প্রথম দেখেছিলাম তখন সে এত্তোটুকুন। আধো আধো ভাঙা কন্ঠে দুই একটা শব্দ বলতে পারে। সম্পূর্ণ একটা বাক্য বলতে তখনো সে শিখেনি। সে উঁচু কিছু দেখলেই সেটা ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করত- মাঝে মাঝে সফল হলে দু এক পা সামনে এগিয়েই ধপাস করে পরে যেত।
আমি যখন প্রথম তার ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুল ছুঁতে গেলাম - আমার ভীষণ হাত কাঁপছিলো। এ জীবনে অনেক পাপ করেছি এই দু হাত দিয়ে- সেই হাত দিয়ে এক জোড়া নিষ্পাপ হাতের আঙ্গুল ছুঁতে আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো। আমি হাত সরিয়ে নিলাম- কিন্তু সে অবাক করে দিয়ে তার নিষ্পাপ হাতের ছোঁয়া আমাকে দিলো।
ওর ছোঁয়ায় আমার এক মূহুর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো আমিও ওর মতোই নিষ্পাপ হয়ে গেছি।
সময় বয়ে যাচ্ছে। ও ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিলো। ওর আধো আধো ভাঙা কথা আমি মুগ্ধ হয়ে মন দিয়ে শুনতাম। আমি জানি আমার পৃথিবী ওকে ছাড়া অসম্পূর্ণ।
তারপর পেরিয়ে গেল কয়েক বছর- ও শুধু একটা শব্দ না- শত শত বাক্য প্রতিদিন ননস্টপ বলতেই থাকে। ওর গল্পের ঝুড়ি থেকে কথা আর শেষ হয় না যেন। ও দৌঁড়াতে থাকে- এখানে যায় - সেখানে যায়। আর আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। ওর চঞ্চলতা, ছুটোছুটি -আমার বুকে মাঝেমাঝে এলোপাথাড়ি ঝড় তুলে দিতো- যদি পড়ে গিয়ে ব্যথা পায়! তবুও আমি চাইতাম- ও পাখির মতো উড়তে শিখুক। পাখি যেমন পুরো আকাশ জুড়ে বিচরণ করে- কোনো ভয় তাকে কাবু করে না- ওকেও যেন কেউ পায়ে বেঁড়ি পড়াতে না পারে- স্বাধীনতার সবটুকু স্বাদ ও উপভোগ করুক।
এই ছোট্ট পাখি একদিন অনেক বড় হলো। ওর দিকে এক মিনিট তাকিয়ে থাকলেই আমি সারাদিনের সব ক্লান্তি ভুলে যেতাম। ওর মধ্যে একটা ঐশ্বরিক শক্তি ছিল- যেখানেই যেত চারপাশটা একদম জীবন্ত করে ফেলতো।
ওকে দেখার পর থেকে মন খারাপ বলে কোনো কিছু আমার জীবনে এক্সিস্ট করে নাই। রাতে ওর নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখটা আমাকে আবার নতুন করে বেঁচে থাকার শক্তি যোগাতো। আমি জানতাম আমার মতো সুখী মানুষ খুব কম-ই আছে দুনিয়ায়। যার পাশে এরকম জলজ্যান্ত এক ঐশ্বরিক শক্তি বাস করে সে সুখী না হয়ে যাবে কোথায়!
তারপর …
তারপর একদিন সবকিছু উলটপালট হয়ে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ ও আমার দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল। একটা চিরকুট ফেলে গেল- "চির জন্মের শখ ছিল পাখি হওয়ার- শখ পূরণ করতে যাচ্ছি- পাখি তো কোথাও আবদ্ধ থাকে না- আসমানে পাড়ি জমাচ্ছি তাই। ভালো থেকো।"
সে সত্যিই সত্যিই পাখি হয়ে উড়ে গেছে- আকাশে ঘুরে বেড়ায়। দীর্ঘ বছর তার সাথে আমার দেখা হয় না।
তবে আজকাল একটা হলুদ রংয়ের পাখি প্রায়-ই আমার বারান্দায় আসে... এই পাখিটাই আমার সেই ছোট্ট পাখি কিনা আমি জানি না। কিছু হয়তো বলার চেষ্টা করে- আমি ওর ভাষা বুঝতে পারি না।