প্রথম অধ্যায়
খবির সাহেবের ঘরে আনন্দ আর ধরে না, এতটা খুশির খবর তার জীবনে আর আসেনি, ভবিষ্যত আসবে কিনা সেটা আল্লাহ পাক ভালো বলতে পারবেন, আজ দুদিন যাবৎ তাকে এবং তার স্ত্রীকে নিয়ে এতটা আলোচনা হচ্ছে যে রীতিমতো তারা ভাইরাল হয়ে উঠেছেন , গত দুদিন হলো তার স্ত্রী যশোর সদর হাসপাতালে চার চারটি সন্তান জন্ম দিয়েছে, সন্তানগুলো জন্মের পর পরই পুরো হাসপাতাল জুড়ে একটা খুশির খবর ছড়িয়ে যায়, হাসপাতালে নার্স এবং ডাক্তাররা এতটা খুশি মনে বোধহয় কখনো তারা কাজ করেননি, যখনই যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করার পাশাপাশি এই খবরটাও তারা একে অপরকে দিয়ে দিচ্ছেন, হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডের ১৪ নম্বর বেড সবার কাছে যেন দর্শনীয় বস্তু হয়ে উঠেছে। হাসপাতালের বড় ডাক্তার সাহেব বেশ কয়েকবার এসে খোঁজখবর নিচ্ছেন, এবং নার্সদেরকে বারবার বলছেন এদের সেবার কোন ত্রুটি না হয়। বাচ্চাগুলো জন্মের পর পর টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে আন্ডারলাইন করে দেখানো হচ্ছে, কয়েকটা স্থানীয় এনজিও সংস্থা খবির সাহেবের স্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবং তারা আশ্বস্ত করেছেন তার সবরকম সাহায্য করতে প্রস্তুত, তবে সবচেয়ে বড় খুশির খবর হল এখনো মা এবং বাচ্চারা সবাই সুস্থ আছেন। খবির সাহেবও খুব খুশি কারণ তিনি ভেবেছিলেন চার চারটি সন্তান জন্মের পর তার স্ত্রী অসুস্থ পড়বেন কিন্তু তার স্ত্রীকে দেখে এতটাই প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে যে তিনি আরো বোধহয় কয়েকটা সন্তান জন্ম দিলেও তার কোন সমস্যা হত না।
এই খুশির মধ্যেও খবির সাহেবের মনে একটা কষ্ট হচ্ছে, সব টিভি চ্যানেলগুলো এসে তার স্ত্রী এবং বাচ্চার ভিডিও করছেন, কয়েকটা মিডিয়া এসে স্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়ে গেল, কিন্তু দুঃখের বিষয় তার সাক্ষাৎকার কেউ নিচ্ছে না, এই ঘটনার মূল কারিগর যে তিনি এ কথা কেউ মনে করছে না। এটাকেই বলে অদৃষ্ট।
খবির সাহেব ঢাকায় কোম্পানিতে একটা ছোটখাটো চাকরি করেন গত বছর তিনি যখন বিবাহ করেন প্রথমে স্ত্রীকে ঢাকায় রেখেছিলেন। সন্তান সম্ভাবনা হলে নিরাপত্তার কথা ভেবে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তারপরে এই সাফল্য, চার চারটি সন্তান জন্ম দিয়ে মা- বাচ্চারা সুস্থ থাকা সত্যিই আল্লাহ পাকের অশেষ রহমত ছাড়া সম্ভব নয়। তাও আবার নরমাল ডেলিভারি, হাসপাতালে সব ডাক্তার মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রিলিজ করার দিন খবিরের স্ত্রীকে তারা সংবর্ধনা দিবেন, এ যুগে যখন একটা বাচ্চা ডেলিভারির ক্ষেত্রে সিজারিং এর প্রয়োজন হয় সেখানে চার চারটা বাচ্চা নরমাল ডেলিভারি নিঃসন্দেহে হাসপাতালে ডাক্তারদের বিশাল সাফল্য এটাকে তারা সংবর্ধনার মাধ্যমে স্মরণীয় করে রাখতে চান । খবির সাহেব তার অফিস থেকে সাত দিন ছুটি নিয়েছিলেন তার স্ত্রী ডেলিভারির জন্য , খবরটা যখন অফিসের বড় সাহেব কে জানালেন, বড় সাহেব খুশি হয়ে আরো সাত দিন ছুটি মঞ্জুর করলেন। হাসপাতাল থেকে বিদায়ের দিন বিশাল সংবর্ধনার মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদেরকে বিদায় জানালেন, আকাশে একটি চাঁদ উঠলে মানুষ খুশি হয়,খবির সাহেব চার চারটি চাঁদ একসঙ্গে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরে আসলেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়
……………..
খবির সাহেবের বাড়িতে যেন মেলা বসেছে , আত্মীয়-স্বজন গ্রামবাসী সবাই যেন একসঙ্গে ভেঙ্গে পড়েছে তার চার সন্তানকে দেখার জন্য, সত্যিই চাঁদের হাট বসেছে খবির সাহেবের বাড়িতে। খবির সাহেবের মা গর্ব করে গ্রামবাসীকে বলতে লাগলেন, ছেলের বিয়ে দিলে জাত বংশ দেখে দিতে হয়, আমার বৌমা ভাগ্যলক্ষী হয়ে এ সংসারে এসেছে,
গ্রামের বন্ধুরা এসে তাকে অভিনন্দন জানালো কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলল তুই কোন পীরের মুরিদরে আমরা সেই পীরের মুরিদ হব।
খবির সাহেব ধার্মিক লোক, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন গরু জবাই করে গ্রামবাসীকে খাওয়াবেন, কিন্তু তার স্ত্রী সালমা এতে বাধ সাধলো বলল এগুলো পরে করা যাবে আপাতত চারটে বাচ্চা কিভাবে সামলাবো এটা নিয়েই ভাবো, খবির সাহেব স্ত্রী কথা খুব একটা ফেলেন না, তিনি স্ত্রী কোথায় সাঈ দিয়ে বললেন তাহলে বড় করে একটা মিলাদ দিয়ে দেই, আল্লাহর রহমতকে সাক্ষী হিসেবে রাখতে হয়। খবির সাহেব তাহাজ্জুদ নামাজ খুব একটা মিস করেন না , আজ নামাজ পড়তে উঠে ঘুমন্ত অবস্থায় চারটি সন্তানকে দেখে তার হৃদয়ে একটা শান্তির বাতাস বয়ে গেল , তার স্ত্রী সালমা এত রাতেও জেগে ছিলেন স্বামী কে দেখে বললেন আল্লাহপাক যখন আমাদেরকে এত বড় রহমত দিয়েছেন , আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি দুটি বাচ্চাকে মাদ্রাসায় পড়াবো, স্ত্রী কথায় খবির সাহেব আনন্দিত হলেন , স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন নিজের শরীরের দিকে একটু খেয়াল রেখো, চার- চারটি সন্তানের মা তুমি, তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে ওরাও তো অসুস্থ হয়ে পড়বে , সালমা মৃদু হেসে বলল ও তুমি ভেবোনা, আমি এতটুকু দুর্বল হয়নি, চারটি সন্তানের মুখে তাকালে আমার সব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যায়।
খবির সাহেব স্ত্রীকে খুশি করার জন্য বললেন মেয়ে দুটি একদম তোমার মত হয়েছে, ভাবছি তোমার নামের সাথে মিল রেখে তাদের নাম রাখবো। আর ছেলে দুটি তো আমার মত হয়েছে তাই তাদের নাম তুমি রেখো, কথা শুনে দুজনে একসঙ্গে হেসে উঠলে
ঘর থেকে খবির সাহেবের মা জোর গলায় বললেন, বৌমা তোমার আক্কেল জ্ঞান কি! এখনো জেগে আছো! তুমি অসুস্থ হলে বাচ্চাগুলোর কি হবে একবার ভেবে দেখেছো, ঘুমিয়ে পড়ো আমি এখন বাচ্চাগুলোকে দেখছি। মানুষের বুড়ো বয়সে সব কিছুর লোপ পেলেও কিছু কিছু মানুষ কানে তারা বেশি শুনতে পায়, তিনি তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন আমার নাতি পুতির নাম নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না ও আমি আগেই ঠিক করে রেখেছি। খবির সাহেব আর দেরি না করে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে চলে গেলেন।
তৃতীয় অধ্যায়
.....................
প্রায় ১৪ দিনের মাথায় খবির সাহেব তার অফিসে কাজে যোগ দিলেন, অফিসের সবাই তাকে অভিনন্দন জানালো, ম্যানেজার সাহেব খুব খুশি, তিনি খবির সাহেবের কাঁধে হাত রেখে বললেন আমরা অফিসের সবাই ভাবছি আমরা আপনাকে একটা সংবর্ধনা দেব, এ তো যেমন তেমন কথা নয়, চার -চারটে বাচ্চা একসঙ্গে জন্ম দেওয়া একমাত্র মহাপুরুষদের পক্ষে সম্ভব, ম্যানেজার আরো বললেন এমডি সাহেবকে খবর টা দিয়েছি তিনি খুব খুশি হয়েছেন এবং তিনি আপনাকে একটা স্পেশাল বোনাস দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলেছেন। আমি দু একদিনের মধ্যে সেটা আপনাকে ব্যবস্থা করে দেব, অফিসের সহকারী ম্যানেজার সেলিম সাহেব এই খুশিতে তিনি খুশি হতে পারলেন না, কারণ তিনি প্রায় পাঁচ বছর যাবত বিবাহ করেছেন এখনো সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি, চেষ্টার কোন ত্রুটি করছেন না , ডাক্তাররা এক প্রকার না জবাব দিয়েছেন, তাই তিনি মুখ ভার করে বললেন এত খুশির কি আছে বাচ্চা কি আর কারো হয় না, ম্যানেজার সাহেব থামিয়ে দিয়ে বললেন, সেলিম সাহেব আপনি কি এটাকে স্বাভাবিকভাবে দেখছেন,অন্য কারো হলে চার চারটি বাচ্চা একসঙ্গে জন্ম দিতে চার বছর সময় লাগতো খবির সাহেব সেটা এক বছরে করিয়ে দেখিয়েছেন, এটাকে আপনি একটা বড় অ্যাসিভমেন্ট হিসেবে দেখবেন না, আমার এরকম হলে তো আমি রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন করতাম, খবির সাহেব ম্যানেজার সাহেবকে মিষ্টি খাওয়ানোর কথা বললে ম্যানেজার সাহেব বললেন না- না আপনাকে করতে হবে না আমি আপনার পক্ষে অফিসের সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছি , ম্যানেজার সাহেব যুবক মানুষ এখনো বিয়ে-শাদী করেননি ,তবে অত্যন্ত রসালো লোক, কেন এখনো বিয়ে করেননি সেটা পরে একদিন ম্যানেজারের সাথে আলোচনা করে জেনে নেব, কিন্তু তিনি খবির সাহেবকে অত্যন্ত ভালোবাসেন কারণ খবির সাহেব কখনো অফিসে দেরি করে আসেন না, এবং অফিসের কাজে কোন গাফিলতি করেন না।
বিকেল বেলায় খবির সাহেবের এম ডি রায়হান চৌধুরী অফিসে আসলেন তিনি খবির সাহেবকে অভিনন্দন জানালেন এবং আশ্বস্ত করলেন তিনি যশোরে যেয়ে তার বাচ্চাদেরকে দেখে আসবেন। বিকেলবেলা অফিস শেষে বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেতে ম্যানেজার তাকে বললেন আজ আপনি আমার সাথে যাবেন, এমডি সাহেব তেজগাঁর কারখানায় আছেন ওখান থেকে তার সাথে দেখা করে আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেব, যাবার পথে ম্যানেজার সাহেব খবির সাহেবের বাচ্চাদের জন্য একটি শো রুম থেকে অনেকগুলো কাপড়চোপড় কিনলেন এবং বললেন আমার তরফ থেকে এগুলো আপনার বাচ্চাদেরকে উপহার আর সামনের সপ্তাহে আপনাকে আমি আরো দুদিন ছুটি দেব বাচ্চাদেরকে দেখে আসবেন, কি এবার খুশি তো, খবিরের সাহেব ম্যানেজার যে তাকে এতটা ভালোবাসেন সেটা তিনি জানতেন, সেটা অফিসের কাজের ক্ষেত্রে, বাইরে নয়,কিন্তু আজ তার ভুল ভাঙলো, খবির এবার সাহস নিয়ে বললো স্যার এবার একটা বিয়ে করে ফেলেন, সন্তানের মুখ দেখলে পৃথিবীর সব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যায়, ম্যানেজার সাহেব নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন, তিনি গাড়ির গতি একটু কমিয়ে বললেন হ্যাঁ আপনাকে দেখে এবার সাহস হচ্ছে , দেখবেন এবার খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলব এই বলে তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।
খবির সাহেব যখন বাসায় ফিরলেন তখন দশটা বেজে গেছে, তিনি খিলগাঁয়ে একটি চাকরিজীবী মেসে থাকেন, অন্যান্য দিন হলে তিনি গোসল দিয়ে নামাজ পড়ে শুয়ে পড়তেন,কিন্তু আজ তার কিছুতেই ঘুম আসতে চাইছে না , বিছানায় শুয়ে তার চার চারিটি বাচ্চার মুখটা চোখের সামনে ভেসে আসতে লাগলো, হৃদয়ের এত প্রশান্তি, এত সুখ, স্বস্তির নিঃশ্বাস, অনাবিল আনন্দে তার হৃদয়টা ভরে উঠলো, তিনি বারবার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে লাগলেন, সারাদিন ক্লান্তিতে তার চোখে একটু তন্দ্রা নেমে এসেছিল, এমন সময় তার মোবাইলে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে রিং বেজে উঠলো, তিনি ভেবেছিলেন বোধহয় তার বাড়ি থেকে তার স্ত্রী সালমা রিং করেছে, কিন্তু যখন দেখলেন অপরিচিত নাম্বার কলটি রিসিভ না করে শুয়ে পড়লেন, মোবাইল আবার বেজে উঠল, এবার তিনি কলটা রিসিভ করলেন, ওপার থেকে যার কণ্ঠটি ভেসে আসলো এর জন্য খবির সাহেব একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না,
ওপার থেকে যিনি কল করেছিলেন তিনি পরিচয় দিলে খবির সাহেব সোজা বিছানা থেকে উঠে বসলেন, এবং সালাম বিনিময় করলেন। চৌধুরী সাহেব বললেন, খবির সাহেব আপনি আগামীকাল তেজগাঁয়ে কারখানায় আমার সাথে দেখা করে তারপরে মতিঝিলের অফিসে যাবেন, আপনার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে, আর একটা কথা, আগামী সপ্তাহে আমি পরিবারসহ যশোরে আপনার সন্তানদেরকে দেখতে যাব আশা করছি এতে আপনার পরিবার অনেক খুশি হবে, এখন রাখছি আগামীকাল দেখা হবে আল্লাহ হাফেজ।
খবির সাহেবের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো, এই পাঁচ বছর চাকরি জীবনে তার এমডি কখনোই তাকে রিং করেনি, তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।
সকালে ঘুম থেকে ওঠে নামাজ আদায় করে খবির সাহেব নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই তেজগাঁও অফিসে পৌঁছালেন। সেখানে তার এমডি রায়হান চৌধুরী এবং তার স্ত্রী উভয়ে উপস্থিত ছিলেন। তারা দুজনেই খবির সাহেবকে খুব সমাদর করলেন। এবং তাদের বাচ্চাদেরকে তারা যে দেখতে যাবেন সেটা তারা পুনরায় বক্ত করলেন। খবির সাহেবের পাঁচ বছর চাকরি জীবনে এত বড় সমাদর বা সম্মান তিনি কখনোই পাননি, আনন্দে তার বারবার চোখ ভিজে যেতে লাগলো। এমডি সাহেবের সাথে সালাম বিনিময় করে তিনি যখন মতিঝিলের অফিসে আসলেন, তখন ম্যানেজার জানালেন এমডি সাহেব আপনাকে সাত দিনের ছুটি দিয়েছেন ইচ্ছা করলে আজকে আপনি বাড়ি চলে যেতে পারেন।
খবির সাহেব আর দেরি না করে যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন , বাড়িতে যখন পৌঁছালেন তখন রাত দশটা বেজে গিয়েছে, পরদিন সকাল বেলায় বাড়ির সবাইকে যখন তার এমডি সাহেবের আসার কথা কথা জানালেন, সবাই অবাক হলেও আনন্দিত হলেন, আস্তে আস্তে এমডি সাহেবের আসার খবরটি গ্রামের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল , গ্রামবাসীরা খবির সাহেবের এমডিকে এক বিশাল সংবর্ধনা দেবেন বলে স্থির করে ফেললেন, নির্দিষ্ট দিনে খবির সাহেবের এমডি গ্রামে আসলে পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রামবাসীরা তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিল,
এমডি সাহেব খবির সাহেবদের বাচ্চাদের জন্য বিপুল পরিমাণ খেলনা, পোশাক এবং মিষ্টান্ন এনেছিলেন, এমডি সাহেবের স্ত্রী খবির সাহেবের চারটে বাচ্চাকে পৃথকভাবে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ আদর করলেন এসব দেখে গ্রামেবাসিরা খুবই খুশি হলেন এবং তাদের খবির যে এক ফেরেশতার স্বরূপ মানুষের আন্ডারে চাকরি করে বলে সবাই প্রশংসা করতে লাগলেন । গ্রামের সবাইকে আনন্দ সাগরের ভাসিয়ে সন্ধ্যার দিকে এমডি রায়হান চৌধুরী যশোর ত্যাগ করলেন।
চতুর্থ অধ্যায়
………………
কিন্তু জীবন সব সময় সরলরেখায় চলে না মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক, মানুষের বাইরেরটা দেখে যদি ভেতরটা চেনা যেত, তাহলে পৃথিবীতে এত বিশ্বাস-অবিশ্বাস বিবাদ- কলহ, হিংসা- বিদ্বেষ থাকতো না। মানুষ তার জীবনে চাওয়া পাওয়ার হিসাব মিলাতে মিলাতে একসময় হয়তো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায় , তবুও হিসাব মেলেনা, এটাই পৃথিবীর নির্মম বাস্তবতা।
খবির সাহেব আজ তিনদিন হলো ঢাকায় এসে তার কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন, দিনও কাটছিল ভালো, এমডি রায়হান সাহেবের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই এত বড় দিল- দরিয়া লোক বাইরে দেখে বুঝায় যায় না, আজ এমডি রায়হান সাহেব ম্যানেজার এবং তাকে তার বাসায় নিমন্ত্রণ করেছেন, এইবার প্রথম নয় এর আগেও কয়েকবার এমডি সাহেব অফিসের সবাইকে তার বাসায় দাওয়াত করে খাইয়েছেন। দাওয়াত খেয়ে কি একটা কাজে ম্যানেজার সাহেব বেরিয়ে গেলেন, খবির সাহেবও বেরিয়ে যেতে চাইলে রায়হান সাহেব তাকে বসতে বললেন , এইবার তিনি তার আসল কথা পাড়লেন, রায়হান সাহেব খবির সাহেব কে উদ্দেশ্য করে বললেন কিভাবে কথাটা আপনাকে বলব এই কয়টা দিন তাই নিয়ে ভাবছিলাম, আপনি তো জানেন আমাদের একমাত্র কন্যা সন্তান আমেরিকার থাকে। আর সাত বছর হল তার বিবাহ হয়েছে, কিন্তু তাদের কোন সন্তান নাই , ভবিষ্যৎ আর হবেনা এভাবে ডাক্তারা জবাব দিয়েছেন, তাই ভাবছি আপনার সন্তানের মধ্য থেকে যদি একটা সন্তান আমার মেয়েকে দত্তক দেন তাহলে আমার মেয়ে বড়ই খুশি হবে। আমি ইচ্ছা করলে অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নিতে পারতাম, কিন্তু আপনি জানেন বাবা মায়ের চরিত্র সন্তানের চরিত্রের উপর অনেকটা প্রভাব ফেলে, তাই আপনার সন্তান থেকে একটি দত্তক নেব বলে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনি ধার্মিক লোক,বিশেষ করে আপনার স্বভাব চরিত্রে, কর্মে কখনো আমরা ত্রুটি দেখিনি , এসব দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, রায়হান সাহেবের স্ত্রী অত্যন্ত কাতর কণ্ঠ বললেন আপনার তো চারটি সন্তান একটা দিলে আপনার কোন ক্ষতি হবে না, আপনার একটি সন্তানের বিনিময়ে আমার মেয়ের মুখে হাসি ফুটবে, দয়া করে একবার ভেবে দেখুন। আপনার সন্তান আমার মেয়ে আমেরিকায় নিয়ে সেখানেই মানুষ করবে, অনেক বড় হবে এর বিনিময়ে আপনাকে আমরা দশ লাখ টাকা দিব, ঢাকায় এসে আপনার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ফ্লাটে থাকতে পারবেন এর জন্য ফ্ল্যাটের কোন ভাড়া আপনার দেওয়া লাগবে না। প্লিজ একবার ভেবে দেখুন।
খবির সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন এতে ভাবার কি আছে স্যার, আল্লাহপাক মেহেরবানী করে আমাকে চারটি সন্তান দিয়েছেন একটা সন্তান নিয়ে যদি আপনার মেয়ে খুশি হয় এত আনন্দের কথা আমি রাজি স্যার, এসব নিয়ে স্যার একেবারেই ভাববেন না, চারটি সন্তানের মধ্যে আপনার যেটি পছন্দ হয় তাকেই আপনাদের হাতে আমি তুলে দেবো। রায়হান সাহেব খুব ধীরস্থির ঠান্ডা মাথার মানুষ, খবির সাহেব কে বললেন আপনি সহজ সরল লোক, বিষয়টিকে আপনি যত সহজ ভাবে ভাবছেন অতটা সহজ নাও হতে পারে, যদি হয়ে যায় খুবই ভালো, আগামীকালই আপনি বাড়িতে চলে যান, আপনার স্ত্রী এবং মাকে বিষয়টা ভালোভাবে বুঝান, কোন আপত্তি না থাকলে আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসবেন।
শেষ অধ্যায়
…………….
অংকের নিয়মে দুইয়ে দুই-চার মিলানো খুবই সহজ, কিন্তু জীবন নামক অংকে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলানো কতটা কঠিন তা ভুক্তভোগিরাই জানেন। খবির সাহেব বাড়িতে এসে বিষয়টা তার স্ত্রী সালমাকে জানালে সালমা এর উত্তরে বলল রাত্রে তোমাকে এর উত্তর দেবো এখন নয়। রাত্রে দুটার দিকে সালমা তার স্বামী খবির সাহেবকে ঘুম থেকে উঠালেন, পাশে ঘুমানো চারটি বাচ্চার দিকে তাকিয়ে বললেন এর মধ্যে কোন সন্তানটিকে তুমি বিক্রি করতে চাও সেই সন্তানটি আমি তোমার হাতে তুলে দেব, খবির সাহেব তার কাছের সন্তানটার দিকে তাকালেন বাচ্চাটি ঘুমিয়ে রয়েছে, মাঝে মাঝে মৃদ হাসছে খবির সাহেবের মনে হল এখনই সে বাবা বলে যেন খবির সাহেবের গলা জড়িয়ে ধরবে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এ সন্তানটিকে তিনি বিক্রি করবেন না। এরপরে তারপরের সন্তান, এভাবে তিনি চার চারটি সন্তানের দিকে তাকালেন, চারটি সন্তানই যেন খবির সাহেবের মনে হল বাবা বলে এখনই তার কোলে উঠবে, খবির সাহেব পিতৃস্নেহে কাতর হয়ে পড়লেন,তিনি নিজেকে সামলাতে পারলেন না, চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে তার স্ত্রীর সালমা কে বললেন, সালমা তুমি আমাকে কঠিন পরীক্ষায় ফেললে, কোন সন্তানটিকে তো আমি ত্যাগ করতে পারবো না। সালমা বেগম নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না, চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে স্বামীকে বললেন বাবা হয়ে যদি না পারো আমি মা হয়ে কিভাবে সন্তানকে না দেখে থাকতে পারবো একবার ভেবে দেখোছো, তুমি তোমার পরিকল্পনা বাতিল কর।
পাশের ঘর থেকে খবির সাহেবের মা সব কথা শুনছিলেন, তিনি ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন আল্লাহ পাক আমাদের যা দিয়েছেন তাই নিয়ে সুখী হব ইনশাল্লাহ... রুজি ও সন্তানের ফয়সালা আসমানে হয় জমিনে নয়। আল্লাহ পাক যাকে যা দিয়েছেন তাকে তাই নিয়েই খুশি থাকতে হয়। এর ব্যতিক্রম করতে গেলে বিপদ নেমে আসে, তোমার কোম্পানির মালিক জ্ঞানী লোক তাকে সব কথা বুঝিয়ে বললে তিনি নিশ্চয় বুঝবেন।
তারপরের দিনই খবির সাহেব ঢাকা এসে তার এমডি সাহেবকে বিষয়টা খুলে বললেন, এমডি সাহেব খবরটা শুনে খুশি হলেন, না রাগ করলেন খবির সাহেব তার কিছুই বুঝতে পারলেন না। তারপরের দিনই অফিসে এসে দেখলেন তাকে কর্তব্য-কাজে অবহেলার কারণে শোকজ করা হয়েছে।
খবির সাহেব সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেললেন, তিনি পরের দিনই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে আসলেন।
সমাপ্ত