📝 সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ
ঢাকার এক তরুণী মেহজাবিন, পেশায় সাংবাদিক, একদিন আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কভারেজের জন্য ইস্তানবুল যায়। সেখানে দেখা হয় আদনান নামে এক রহস্যময় বাংলাদেশি-তুর্কি ব্যবসায়ীর সাথে। আদনানের হাসির আড়ালে যেন লুকিয়ে থাকে অদ্ভুত এক শূন্যতা।
মেহজাবিন জানতে পারে, আদনানের সাথে বাংলাদেশের এক পুরনো ঘটনা ও এক নিখোঁজ মানুষের গল্প জড়িয়ে আছে। কাগজ-কলমে সেই মানুষ মৃত, কিন্তু ইস্তানবুলের রাস্তায় তার ছায়া বারবার দেখা যায়।
তাদের সম্পর্ক যত গভীর হয়, রহস্যও তত বেড়ে চলে—বাংলাদেশের নদীতীর থেকে শুরু হয়ে ইউরোপের ঐতিহাসিক শহরে পৌঁছায় এক জটিল ভালোবাসা ও বিশ্বাসঘাতকতার গল্প।
প্রথম অধ্যায় – নীল আকাশের নিচে
ঢাকার গ্রীষ্মের এক বিকেল। রাস্তার ধুলো, রিকশার ঘণ্টা আর মানুষের ভিড়ে গরম যেন আঠার মতো লেগে আছে।
মেহজাবিনের হাতে তখন কালো রঙের একটি পুরনো চামড়ার ব্যাগ—যেটা তার সবচেয়ে প্রিয়। এই ব্যাগে থাকে নোটবুক, ক্যামেরা আর কিছু ব্যক্তিগত কাগজপত্র।
আজ তার অফিসে বিশেষ এক খবর এসেছে—ইস্তানবুলে অনুষ্ঠিত হবে আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলন। বাংলাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সে-ই যাচ্ছে সংবাদ কভার করতে।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে সহকর্মী রফিক হেসে বলল,
— "তুমি তো একেবারে বিদেশ ফেরত সাংবাদিক হতে চলেছো!"
মেহজাবিন ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি এনে বলল,
— "বিদেশ ফেরত না, রফিক ভাই… বিদেশে গিয়ে হয়তো এমন কিছু দেখব, যা সারা জীবনের জন্য বদলে দেবে আমাকে।"
ইস্তানবুলে পা রাখার মুহূর্তে মেহজাবিনের মনে হলো, শহরটা যেন ইতিহাসের বুক থেকে উঠে এসেছে—নীল মসজিদের মিনারগুলো আকাশ ছুঁয়ে আছে, বসফরাস নদীর জলে সূর্যের আলো নাচছে।
সম্মেলনের প্রথম দিনেই সে দেখল আদনানকে।
উঁচু দেহ, গাঢ় বাদামি চোখ, আর এক ধরনের অদ্ভুত শান্ত হাসি। কনফারেন্স হলে সে বাংলাদেশের স্টলে এসে দাঁড়ালো।
— "আপনি কি মেহজাবিন রহমান?"
গভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল সে।
— "জি… কিন্তু আপনি?"
— "আমি আদনান… হয়তো নামটা শুনে থাকবেন।"
মেহজাবিনের মনে পড়ল—ঢাকার এক বড় ব্যবসায়ীর ছেলে, যিনি কয়েক বছর আগে রহস্যজনকভাবে বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন। বলা হয়, তার পরিবারের সাথে জড়িয়ে ছিল এক অমীমাংসিত হত্যা মামলা।
তাদের কথা শেষ হওয়ার আগেই আদনান নিচু স্বরে বলল,
— "আপনার সাথে আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে… যা হয়তো আপনার সাংবাদিক জীবনের সবচেয়ে বড় গল্প হয়ে যাবে।"
তখনো মেহজাবিন জানত না—এই কথাই তার জীবনকে টেনে নিয়ে যাবে এক অদৃশ্য ছায়ার দিকে, যেখানে ভালোবাসা আর ভয় পাশাপাশি চলবে।
দ্বিতীয় অধ্যায় – অদৃশ্য ছায়ার ইঙ্গিত
ইস্তানবুলের বসফরাস ব্রিজের নিচে ছোট্ট এক ক্যাফেতে বসেছে মেহজাবিন আর আদনান। নদীর ওপরে বাতাসে লবণের গন্ধ, চারপাশে বিদেশি পর্যটকদের কোলাহল। কিন্তু তাদের দুজনের কথোপকথনের মধ্যে ছিল অন্যরকম এক নীরবতা।
আদনান প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর কফির কাপে আঙুল ছুঁয়ে বলল,
— “আপনি সাংবাদিক… তাই সত্যি কথা শুনতে সাহস আছে তো?”
— “সত্যি কথার জন্যই তো আমি এখানে,” মেহজাবিন চোখে চোখ রেখে বলল।
আদনান নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
— “তিন বছর আগে ঢাকায় এক ঘটনা ঘটে—একজন যুবক, নাম আরিব হোসেন। অফিসিয়ালি সে মারা গেছে বলে ঘোষণা হয়েছিল… কিন্তু আমি জানি, সে এখনো বেঁচে আছে।”
মেহজাবিন ভ্রু কুঁচকালো।
— “আপনি নিশ্চিত? কাগজপত্র, পুলিশের রিপোর্ট—সব তো বলে সে মারা গেছে।”
— “ওগুলো শুধু কাগজের কথা। আসল সত্যি অন্য। আরিব ছিল আমার শৈশবের বন্ধু… কিন্তু সে এক গোপন ফাইলের জন্য খুন হওয়ার কথা ছিল।”
মেহজাবিন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
— “কেমন ফাইল?”
আদনান নিচু স্বরে বলল,
— “এক আন্তর্জাতিক চক্রের ডকুমেন্ট—যেটা প্রমাণ করে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অবৈধ অস্ত্র পাচার হচ্ছিল, আর সেই চক্রে কিছু প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের নাম আছে।”
মেহজাবিনের বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল।
— “আপনি কি বলতে চাইছেন, এই পুরো বিষয়টা এখনো সক্রিয়?”
আদনান তার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বলল,
— “হ্যাঁ। আরিবকে বাঁচানোর জন্যই আমি বাংলাদেশ ছেড়েছিলাম। কিন্তু এখন সে… এই শহরেই আছে।”
মুহূর্তের জন্য মেহজাবিনের মনে হলো, কেউ যেন দূর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে চোখ ঘুরিয়ে দেখল—একজন মধ্যবয়সী মানুষ, কালো কোট আর টুপি পরে, রাস্তার অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
আদনান ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
— “দেখলেন? ওরা আমাদের নজরে রেখেছে।”
তৃতীয় অধ্যায় – অনুসরণকারীর ছায়া
রাস্তার ওপাশে দাঁড়ানো লোকটা তাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তার চোখে ছিল না কোনো স্বাভাবিক কৌতূহল, বরং এক অদ্ভুত হুমকি। মেহজাবিন গলায় কাঁপন লুকাতে চাইলেও পারল না।
আদনান দ্রুত ওয়েটারের বিল মিটিয়ে বলল,
— “চলুন, এখানে বেশি থাকা ঠিক হবে না।”
তারা ক্যাফে থেকে বেরিয়ে ব্যস্ত রাস্তায় মিশে গেল। কিন্তু কয়েক পা পরেই মেহজাবিন অনুভব করল—লোকটা তাদের পিছু নিয়েছে।
— “ওই লোকটা কে?”
— “চক্রের একজন। ওরা মনে করে, আমার কাছে সেই ফাইলের কপি আছে।”
ইস্তানবুলের সরু গলিপথে তারা ঢুকে পড়ল। পুরনো পাথরের দেয়ালে সেঁটে থাকা ইতিহাসের গন্ধের মধ্যে একটা অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। শেষমেশ এক পুরনো বইয়ের দোকানে ঢুকে তারা লুকিয়ে পড়ল।
দোকানদার, একজন দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ, নিচু স্বরে আদনানকে কিছু বলল তুর্কি ভাষায়। তারপর দোকানের পেছনের একটি গোপন দরজা খুলে দিল।
— “এখানে নিরাপদে কিছুক্ষণ থাকতে পারবেন,” আদনান ফিসফিস করে বলল।
মেহজাবিন বুঝতে পারল—আদনান শুধু রহস্যে ভরা মানুষ নয়, তার সাথে এমন কিছু সম্পর্ক আছে যা তাকে আন্তর্জাতিক ছায়া-চক্রের মুখোমুখি করেছে।
চতুর্থ অধ্যায় – গোপন বার্তা
দোকানের পেছনের ছোট্ট কক্ষে, ধুলো জমা টেবিলের উপর রাখা ছিল কয়েকটা পুরনো বই। আদনান একটি বই খুলে ভেতরে থেকে বের করল একটি ছোট মেমোরি কার্ড।
— “এটাই সেই ফাইলের অংশ।”
মেহজাবিন অবাক হয়ে তাকাল।
— “তাহলে পুরো ফাইল কোথায়?”
— “অন্য অর্ধেক বাংলাদেশে আছে… আরিবের কাছে।”
ঠিক তখনই, বাইরে গুলির শব্দ শোনা গেল। দোকানদার তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিলেন।
আদনান বলল,
— “ওরা এখানে পৌঁছে গেছে।”
পঞ্চম অধ্যায় – ঢাকা ফিরে আসা
কয়েক দিনের মধ্যেই মেহজাবিন ঢাকায় ফিরে এল, কিন্তু তার মন পড়ে রইল ইস্তানবুলে। সে জানত, আরিবকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু আরিব যেন শহরের বাতাসে মিলিয়ে গেছে—কোথাও কোনো খোঁজ নেই।
একদিন সন্ধ্যায়, বৃষ্টি পড়ছিল টিপটিপ করে। সেই সময় তার অফিসের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল একজন—ভেজা চুল, ক্লান্ত চোখ, কিন্তু ঠোঁটে হালকা হাসি।
— “তুমি আমাকে খুঁজছিলে?”
মেহজাবিন বুঝে গেল—সে আরিব।
ষষ্ঠ অধ্যায় – সত্যের মুখোমুখি
আরিব জানাল, সে আসলেই মারা যায়নি। ইস্তানবুলে যাওয়ার আগেই তাকে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু সে অল্পের জন্য বেঁচে যায় এবং লুকিয়ে থাকতে শুরু করে।
মেমোরি কার্ডের দুই অংশ মিলিয়ে দিলে যে তথ্য বেরোবে, তা শুধু চক্রটিকে ধ্বংস করবে না—বরং কয়েকজন আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিদের আসল মুখোশ খুলে দেবে।
কিন্তু এক বিপদ আছে—ফাইল মিললেই আরিব, আদনান, এমনকি মেহজাবিনও আর নিরাপদ থাকবে না।
সপ্তম অধ্যায় – শেষ খেলা
ঢাকার বাইরে এক নদীতীরের পুরনো গুদামঘরে তারা ফাইল মিলিয়ে নিল। কিন্তু ঠিক তখনই অস্ত্রধারী কয়েকজন লোক গুদাম ঘিরে ফেলল।
গুলির লড়াই শুরু হলো। আদনান আর মেহজাবিন অল্পের জন্য বেঁচে গেল, কিন্তু আরিব গুলিবিদ্ধ হয়ে নদীতে পড়ে গেল।
পরে জানা গেল—আন্তর্জাতিক পুলিশ চক্রটিকে ধ্বংস করেছে, কিন্তু আরিবের দেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
শেষ অধ্যায় – অদৃশ্য ছায়ার ফেরা
এক বছর পরে, প্যারিসের একটি ছোট গলিতে মেহজাবিন হাঁটছিল। হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে একজনকে দেখল—কালো কোট, পরিচিত হাসি, আর চোখে সেই গভীর দৃষ্টি।
মেহজাবিন দৌড়ে গেল… কিন্তু লোকটা ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
তার মনে হলো—অদৃশ্য ছায়ারা হয়তো কখনোই হারিয়ে যায় না, শুধু অন্য আকাশে ভেসে বেড়ায়।