প্রফেসর হুমায়ুন আজাদ, 'ধর্মানুভূতির উপকথা' প্রবন্ধে বলেছেন, মানুষ খুবই কোমল স্পর্শকাতর জীব, তার রয়েছে ফুলের পাপড়ির মতো অজস্র অনুভূতি; স্বর্গচ্যুত মানুষেরা বাস করছে নরকের থেকেও নির্মম পৃথিবীতে, যেখানে নিষ্ঠুরতা আর অপবিত্রতা সীমাহীন; তাই তার বিচিত্র ধরনের কোমল অনুভূতি যে প্রতিমুহূর্তে আহত রক্তাক্ত হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যখন সুদিন আসবে, সে আবার স্বর্গে ফিরে যাবে, তখন ওই বিশুদ্ধ জগতে সে পাবে বিশুদ্ধ শান্তি; সেখানে তার কোনো অনুভূতি আহত হবে না, ফুলের টোকাটিও লাগবে না তার কোনো শুদ্ধ অনুভূতির গায়ে। অনন্ত শান্তির মধ্যে সেখানে সে বিলাস করতে থাকবে। কিন্তু পৃথিবী অশুদ্ধ এলাকা, এখানে আহত হচ্ছে, আঘাত পাচ্ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে তার নানা অনুভূতি-এটা খুবই বেদনার কথা; এবং সবচেয়ে আহত হচ্ছে একটি অনুভূতি, যেটি পুরোপুরি পৌরাণিক উপকথার মতো, তার নাম ধর্মানুভূতি।'
আমাদের দৃষ্টিতে এরচেয়ে বড় অনুভূতি এখন political sentiment তথা রাজনৈতিক অনুভূতি। লাস্ট রেজিম একটা আইন করেছিল 'সাইবার নিরাপত্তা আইন' নামে। আইনের একটি ধারা ইন্টেরিম গভমেন্ট রহিত করেছে। তবে আইনটি যত্ন করে রেখে দিয়েছে। ওই আইনের রহিত করা ধারা ২১(১) ও (২)-এ বলা হয়েছিল,
(১) যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা চালান বা উহাতে মদদ প্রদান করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১ (এক) কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
এখন ধরেন একজন দিনমজুর মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালিয়েছেন, অপরাধ প্রমাণের পর উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হলেন; তিনি ১ কোটি টাকা কোথা থেকে পরিশোধ করবেন?
ধারণা করি ভবিষ্যতেও হয়ত ওই আইনে এমন একটা ধারা সন্নিবেশিত হবে যে, জুলাই আন্দোলন ও ওই আন্দোলনের নেতা নাহিদ-হাসনাত-সারজিসকে নিয়ে যারা বিরূপ মন্তব্য করবে তাদের বেলাতেও রহিত করা ওই সাজাই প্রযুক্ত হবে।
বিস্ময়কর সত্য হলো, আপনি আইন ও এর প্রয়োগ দিয়ে কখনোই ব্যক্তির মান মর্যাদা ও ব্যক্তির ফিলোসফির সুরক্ষা দিতে পারবেন না। তাই যদি হতো শেখ মুজিবকে এখন এতটা হেয় হতে হতো না। তারচেয়ে বরং ব্যক্তির চেতনাকে বিক্রি করে যদি কোনো দল বা নেতা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে না চায়, দুর্নীতিবাজ না হয়, সুশাসন নিশ্চিত করে, বিশুদ্ধ গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেয় -সেটি হতে পারে কার্যকরি কোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।
কে বলেছে শেখ মুজিবের সমালোচনা করা যাবে না? কেন মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর নিয়ে কাটাছেঁড়া করা যাবে না? প্রাণপ্রদীপ সূর্যেরও বদনাম আছে। পৃথিবী নয় কেবল এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে স্বতঃসিদ্ধ সত্য ও অমর-অক্ষয় বলে কয়টা জিনিস আছে? খুব হাতে গোনা তাই না? তাহলে নশ্বর পৃথিবী অথবা মানবজীবন নিয়ে কীসের এত বড়াই? কীসের এত গৌরব আর অহংকার?
এইসময় ক্ষমতাবান বিএনপির উচিত হবে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বীর উত্তম জিয়াউর রহমান কিংবা তদীয় পুত্র তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সকল সমালোচনাকে সহাস্যবদনে গ্রহণ করবার মানসিকতা অর্জন করা। একই কথা খাটে জামায়াত তথা এর আমির ডা. শফিকুর রহমান কিংবা এনসিপি তথা এর প্রধান নাহিদ ইসলাম গংদের ক্ষেত্রেও।
আপনি যখন জনতাকে প্রাণখুলে কথা বলতে দেবেন আপনি নিজেই নিজের অবস্থান ঠিকঠাক ঠাওর করতে পারবেন। এবং আপনার মধ্যে যদি এতটুকু নৈতিকতা ও বিবেকবোধ বলে কিছু থাকে পাবলিক ওপিনিয়নের বিরুদ্ধে গিয়ে এক সেকেন্ডও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখবার বাহানা তৈরি করবেন না। বোধের জগতে এটা একটা বিরাট প্যারামিটার।
আইন করে জনতার মুখ বন্ধ করে দিয়ে আয়রন লেডি শেখ হাসিনা টেকেন নাই। একই কাজ করলে আপনারা যদি Titanium manও হন, টিকবেন না। ব্যাস।
মানবসমাজ টিকতে হলে লোভ সংবরণ করবার ক্ষমতা, হিংসা দূরীভূত করবার পদ্ধতি, নিখাদ ভালোবাসার তরিকা রপ্ত করতেই হবে। অন্যথায় এই সুন্দর পৃথিবীতে আপনার অমূল্য পদচিহ্ন রেখে যেতে পারবেন না। আঘাতপ্রাপ্ত অনুভূতি অসার, সেখানে সৃষ্টিশীল কিছুই থাকে না।
লেখক: সাংবাদিক
১৩ আগস্ট ২০২৫
104
View