ময়মনসিংহ চরিতাভিধানে তাঁর পরিচয়—
“শিক্ষাবিদ, সাম্যবাদী রাজনীতিক, সংস্কৃতি সংগঠক ও লেখক। সমাজতত্ত্বের সত্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণে পারদর্শী। সমাজ, সংস্কৃতি ও দেশের মৌলিক ঐতিহ্যের প্রতি গভীর মমত্ববোধ। সত্যভাষণ ও বাগ্মিতার জন্য প্রসিদ্ধ।”
‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’-গ্রন্থের অমর রচয়িতা যতীন সরকার ৮৯ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন শেষে মহাকালে নিজেকে সমর্পণ করলেন। মননশীল এই ব্যক্তিত্বের পুণ্যস্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দ্রপাড়ায় জন্মগ্রহণ করা এই মনীষীর সত্যনিষ্ঠ শিক্ষকতা, প্রগতিবাদী চিন্তাধারা ও দেশজ সাংস্কৃতিক আন্দোলন তাঁকে আর সবার চেয়ে আলাদা করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে এম.এ. করার পর শিক্ষকতাকে তিনি তাঁর জীবনের ব্রত করেছিলেন। নিজের গ্রামীণ বাড়ি 'বানপ্রস্থ'কেই করে নিয়েছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক শুদ্ধচিন্তার আঁতুরঘর।
প্রথম আলো লিখেছে, ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক এই শিক্ষক সুদীর্ঘকাল মননশীল সাহিত্যচর্চা, বাম রাজনীতি ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দুই মেয়াদে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল অসামান্য।
লেখক হিসেবে যতীন সরকার ২০১০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার, ২০০৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৫ সালে পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন গ্রন্থের জন্য প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার, মনিরুদ্দীন ইউসুফ সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
৪২ বছরের বেশি সময় শিক্ষকতা করে ২০০২ সালে অবসর নিয়ে তিনি স্ত্রী কানন সরকারকে নিয়ে শিকড়ের টানে ফিরে যান নিজ জেলা নেত্রকোনায়। শহরের সাতপাই এলাকার নিজ বাড়িতেই ছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত। রেখে গেছেন ছেলে সুমন সরকার, মেয়ে সুদীপ্তা সরকারসহ অসংখ্য স্বজন ও গুণগ্রাহী।
ছাত্রজীবনে লেখালেখি শুরু হলেও প্রথম গ্রন্থ সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে, ৫০ বছর বয়সে। এরপর প্রকাশিত হয় একের পর এক চিন্তাপ্রসূত ও গবেষণাধর্মী গ্রন্থ—বাংলাদেশের কবি গান, বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সংগ্রাম, গল্পে গল্পে ব্যাকরণ, মানবমন মানব ধর্ম ও সমাজ বিপ্লব, পাকিস্তানের ভূত দর্শন, দ্বিজাতিতত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞানচেতনা, ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূতভবিষ্যৎ, বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি, প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন, ভাবনার মুক্ত বাতায়ন—অর্ধশতাধিক গ্রন্থ। সম্পাদনা করেছেন বহু গ্রন্থ ও সমাজ অর্থনীতি ও রাষ্ট্র নামে একটি তত্ত্বমূলক ত্রৈমাসিক পত্রিকা।
ছড়াকার ও গবেষক স্বপন ধরের সম্পাদনায় প্রকাশিত নব্বইয়ের পথে যতীন সরকার গ্রন্থে আনিসুজ্জামান লিখেছেন—“যতীন সরকার নানা কারণে আমাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। অধ্যয়ন-অধ্যাপনায় তাঁর নিষ্ঠা সুবিদিত। আদর্শবাদের প্রতি পক্ষপাত ছাড়া অন্য কোনো পক্ষপাতে তিনি দুষ্ট নন। সর্ববিধ বিচারে জীবনের প্রতি গভীর আসক্তির পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর মধ্যে। তত্ত্বের সঙ্গে জীবনানন্দের এই যোগ আমাদের জন্য বড় প্রাপ্তি।”
‘বাঙালির লৌকিক ধর্মের মর্মান্বেষণ’ প্রবন্ধে যতীন সরকার লিখেছেন—“কোনো শাস্ত্রীয় ধর্মের আশ্রয়ে আদি বাঙালি জনগোষ্ঠীর যাত্রা শুরু হয়নি। তারা তখন হিন্দুও ছিল না, বৌদ্ধও ছিল না। ক্রমে বাইরে থেকে হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম তাদের ভেতরে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। এরপর এসেছে ইসলাম। অর্থাৎ লৌকিক ধর্মই ছিল বাঙালির স্বাভাবিক ধর্ম, পরে শাস্ত্রীয় ধর্ম তার উপর আরোপিত হয়েছে। তবুও বাঙালি তার স্বাভাবিক লৌকিক ধর্ম ত্যাগ করেনি। বরং শাস্ত্রীয় ধর্মকেও লৌকিক ধর্মের জারক রসে মিশিয়ে নিয়েছে। এভাবেই বাংলার মাটিতে লৌকিক হিন্দু, লৌকিক বৌদ্ধ ও লৌকিক ইসলামের প্রসার ঘটেছে।”
পিতার মৃত্যুর পর যতীন সরকারের ছেলে সুমন সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাপি এভাবে চলে যাবে বুঝতে পারিনি। তার চলে যাওয়া দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। পরিবার নিয়ে না ভাবলেও তিনি সবসময় দেশ নিয়ে ভাবতেন। বাপির শূন্যস্থান দেশ পূরণ করতে পারবে না। সারাটা জীবন তিনি দেশকে নিয়ে ভেবে গেছেন। বাপির মনন, চিন্তা, কর্ম এই দেশ এবং দেশের গণমানুষকে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। তিনি ছিলেন প্রকৃত বাঙালি। সবাই তার জন্য প্রার্থনা করবেন।”
আজকের দিনে, যখন বাঙালিয়ানার আধুনিক কাল ক্রমে অতীত ভুলতে বসেছে, আর মানুষের স্বভাবজাত মনন আত্মকেন্দ্রিকতায় ডুবছে, তখন নিজেদের স্বাজাত্যবোধ ও সাংস্কৃতিক শিকড় চিনতে যতীন সরকারকে পড়া জরুরি। তাঁর পাঠ আমাদের আত্মপরিচয়ের দর্পণ ও বোধের মুক্তবাতায়ন।
লেখক: সাংবাদিক
১৩ আগস্ট ২০২৫
264
View