শীতের এক বিকেল। পুরনো ঢাকার সরু গলির ভেতর, মোড়ের কাছে ছোট্ট এক বইয়ের দোকান—“স্মৃতিঘর”। দোকানটির মালিক রুদ্র, বয়স ছত্রিশ, চোখে চশমা, আচরণে নীরব। আজকাল তার দিন কাটে বইয়ের গন্ধে আর কফির কাপে। দোকানের এক কোণে, কাঠের আলমারিতে সে পুরনো চিঠি, ডায়েরি আর পোস্টকার্ড জমিয়ে রাখে—কেউ পুরনো বই বিক্রি করলে সঙ্গে পাওয়া যায় এসব।
সেদিনও রুদ্র এক বালতি পুরনো বই ঘাঁটছিল। বইগুলোর পাতায় ধুলো, কিছু মলাট ভাঙা। হঠাৎ এক উপন্যাসের ভেতরে লুকানো খামে তার চোখ আটকে গেল। খামটা হলদেটে হয়ে গেছে, কিন্তু ওপরের হাতের লেখাটি যেন চেনা…
খামের ওপর লেখা—
"রুদ্রর জন্য… যদি কখনো পড়ো, জানবে, আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি।"
তার নামের পাশে ছোট্ট এক গোলাপ আঁকা।
রুদ্রের বুকের ভেতর কেমন একটা ধাক্কা লাগল। এত বছর পরও এই হাতের লেখা ভুলতে পারেনি। তানিয়া… কলেজ জীবনের প্রথম প্রেম, যে হঠাৎ একদিন তার জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল।
খাম খুলে ভেতরের পাতাগুলো পড়তে শুরু করল—
"রুদ্র,
আমি জানি, আমার চলে যাওয়া তোমাকে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে তোমার থেকে দূরে নিয়ে গেছে। আমি কখনো বলতে পারিনি, তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়। হয়তো আমরা একসাথে থাকতে পারব না, কিন্তু আমার ভালোবাসা সময়ের সঙ্গেও মরবে না। যদি ভাগ্য আমাদের আবার মেলায়, আমি বলব—আমি অপেক্ষা করেছিলাম… শুধু তোমার জন্য।"
পাতার ভেতর একটা শুকনো গোলাপ চেপে রাখা। ফুলটি নিস্তেজ, কিন্তু তার সুবাস যেন রুদ্রকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল বারো বছর আগের সেই বিকেলে—কলেজের লাইব্রেরির আঙিনায়, যেখানে তানিয়া তাকে প্রথম গোলাপ দিয়েছিল।
অতীতের ছোঁয়া
রুদ্রর মনে পড়ল, তানিয়ার হাসি ছিল একেবারে রোদের মতো—উজ্জ্বল, উষ্ণ, অথচ কোমল। তারা একসাথে বই পড়ত, কবিতা লিখত। স্বপ্ন ছিল ছোট্ট একটা জীবন সাজানোর, যেখানে বই, কফি আর একে অপরের উপস্থিতি থাকবে।
কিন্তু হঠাৎ একদিন, তানিয়া জানাল সে বিদেশে চলে যাচ্ছে পরিবারের সাথে। তখনকার বয়সে রুদ্রর সাহস হয়নি কিছু বলার, শুধু দেখেছিল মেয়েটি ধীরে ধীরে ভিড়ের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছে। এরপর কোনো চিঠি, কোনো ফোন—কিছুই না।
আর আজ, এত বছর পরে, সে চিঠি তার হাতে।
খোঁজের শুরু
চিঠি পড়া শেষ করেই রুদ্র সিদ্ধান্ত নিল—তানিয়াকে খুঁজে বের করবে। পুরনো পরিচিতদের ফোন করল, ফেসবুকে খুঁজল, কলেজের বন্ধুদের মেসেজ দিল। কেউ সঠিক খবর দিতে পারল না। কেউ বলল তানিয়া নাকি চট্টগ্রামে বিয়ে করেছে, কেউ বলল সে বিদেশেই আছে।
তবুও রুদ্র হাল ছাড়ল না। চিঠির খামে একটি পুরনো মোবাইল নম্বর লেখা ছিল। অনেকবার চেষ্টা করার পর একদিন, সেই নম্বর থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এল—
"হ্যালো?"
রুদ্রর বুকের ধকধক যেন কান ভেদ করে শোনা যাচ্ছিল। "তানিয়া?"
দীর্ঘ নীরবতার পর উত্তর এল, "রুদ্র… তুমি?"
ওই মুহূর্তে সময় যেন থমকে গেল।
পুনর্মিলন
তারা দেখা করল পুরনো ঢাকার একটি কফি শপে। তানিয়া বদলে গেছে—চুলে সামান্য সাদা, চোখের কোণে হাসির রেখা, কিন্তু সেই হাসি এখনো একইরকম উষ্ণ।
প্রথমে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর রুদ্র বলল, "তুমি চিঠি পাঠাওনি কেন?"
তানিয়া চোখ নামিয়ে বলল, "তখন বাবা-মা ঠিক করেছিল আমার বিয়ে হবে। আমি চিঠি লিখেছিলাম, কিন্তু সাহস পাইনি পাঠাতে। ভেবেছিলাম, তুমি ভুলে যাবে।"
"কিন্তু আমি ভুলিনি," রুদ্র বলল। "প্রতিদিন মনে পড়ত।"
তারা অনেকক্ষণ কথা বলল—হারানো সময়, জীবনের উত্থান-পতন, আর অপূর্ণ স্বপ্ন নিয়ে। তানিয়া জানাল, তার বিয়ে হয়নি, সে একাই থেকেছে বিদেশে, কাজ করেছে, কিন্তু কখনো ভালোবাসতে পারেনি আর কাউকে।
নতুন শুরু
সেই সন্ধ্যায়, তারা পুরনো ঢাকার সরু গলিতে হাঁটতে লাগল। রুদ্রর দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। তানিয়া তাকিয়ে দেখল—দেয়ালে ঝুলছে পুরনো ছবিগুলো, আর এক কোণে সাজানো আছে কিছু শুকনো ফুল।
রুদ্র একটা ছোট্ট জার বের করল—তার ভেতরে রাখা আছে পুরনো গোলাপটি, যা তানিয়া আজ থেকে বারো বছর আগে দিয়েছিল।
"আমি রেখেছিলাম," রুদ্র বলল, "কারণ বিশ্বাস করতাম, তুমি একদিন ফিরে আসবে।"
তানিয়ার চোখ ভিজে গেল। সে ধীরে ধীরে রুদ্রর হাত ধরল। "আমি এসেছি, আর এবার কোথাও যাচ্ছি না।"
চিঠির সুবাস
তারপরের দিনগুলো যেন স্বপ্নের মতো কাটতে লাগল। তারা একসাথে বই পড়ত, দোকান সাজাত, পুরনো গান শুনত। তানিয়া বলল, "তুমি জানো, আমি এখনো চিঠি লিখি?"
"আমার জন্য?" রুদ্র জিজ্ঞাসা করল।
তানিয়া মুচকি হেসে বলল, "হ্যাঁ। আর এবার পাঠাবো, কারণ এখন তোমাকে হারানোর ভয় নেই।"
রুদ্র চিঠিটা নিল, খুলল, আর প্রথম লাইন পড়ল—
"আমাদের গল্পে আর কোনো শেষ নেই, আছে শুধু শুরু।"
দোকানের ভেতর গোলাপের হালকা সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছিল। রুদ্র জানত, এই সুবাস আর কোনোদিন ম্লান হবে না।