Posts

গল্প

রাতের বাসে সেই মাথাহীন যাত্রী

August 14, 2025

liya lili

Translated by Liya

54
View

২০১৫ সালের শীতকাল। ডিসেম্বরের শেষ দিক। রাত প্রায় ১১টা নওগাঁ বাসস্ট্যান্ডে ঠান্ডা কুয়াশা এমনভাবে জমে আছে, যেন বাতাসে বরফ মিশে গেছে। রাস্তার লাইটগুলো কুয়াশার ভেতর দুর্বল হয়ে ঝাপসা আলো ছড়াচ্ছে। দোকানপাট প্রায় সব বন্ধ, শুধু দুই একটা চায়ের দোকানে কয়েকজন হিটার জ্বালিয়ে বসে আছে।

রায়হান অফিসের কাজে ঢাকা যাচ্ছিল।হাতে ছোট ব্যাগ, ক্লান্ত মুখে সে বাসস্ট্যান্ডে ঢুকলো। ঢাকার বাসটা প্রায় ছাড়তে তৈরি। টিকিট কাটলো শেষের দিকে—জানালার পাশে সিট। সিটের কভার পুরনো, কিন্তু জানালাটা বেশ বড় ছিল, তাই বসে বাইরে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছিল।

বাস ছাড়লো। ডিজেলের ধোঁয়া আর ঠান্ডা হাওয়া মিশে এক অদ্ভুত গন্ধে ভরে গেল ভেতরটা। যাত্রী তেমন বেশি ছিল না। রায়হান মোবাইল কানে দিয়ে গান চালালো, কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে বাসের ভেতরে হালকা কুয়াশা ঢুকে পড়তে লাগলো।


ঠিক তখনই, কোনো শব্দ ছাড়াই এক মহিলা উঠে এলেন। রায়হান খেয়াল করলো—বাস তো আগেই ছেড়ে দিয়েছে, মাঝপথে কেউ উঠতে পারে না। কিন্তু তবুও মহিলা ধীরে ধীরে হেঁটে আসছেন।সাদা শাড়ি, লম্বা ভেজা চুল, চুলের ডগা থেকে যেন পানির ফোঁটা পড়ছে। মাথায় পাতলা ওড়না টানা, মুখটা আধো অন্ধকারে ঢাকা, শুধু ঠোঁটের কোণে হালকা একরকম হাসি—কিন্তু সেই হাসিতে কোনো উষ্ণতা নেই।

মহিলা এসে রায়হানের পাশে বসলেন, কিছু বললেন না। জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলেন। রায়হান প্রথমে ভেবেছিল হয়তো তিনি কোনো গ্রামে নেমে যাবেন, কিন্তু এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, তিনি চুপচাপ বসে আছেন।

কন্ডাক্টর এসে সবার ভাড়া নিচ্ছিল, কিন্তু ওই মহিলার কাছে কিছু চাইলো না। আশেপাশের যাত্রীরাও যেন তাঁকে দেখছেই না।

রাত গভীর হলো। রাস্তার পাশে শুধু কুয়াশা, আর মাঝে মাঝে হাইওয়ের লাইটের ফিকে আলো। হঠাৎ বাস একদম ব্রেক কষলো, সবাই ঝাঁকুনি খেলো। রায়হানও সিট ধরে সামলে নিলো। কিন্তু পাশের দিকে তাকাতেই গা জমে গেল—সিট খালি। মহিলা নেই।

রায়হান বিস্মিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। তখন ড্রাইভার আয়নায় চোখ রেখে আস্তে বললো,
“ভাই, ওই সিটে বসছেন কেন? এই সিটে বসা এক মেয়ে পাঁচ বছর আগে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল। ঠিক এই হাইওয়েতে।”

ড্রাইভারের কণ্ঠ কাঁপছিল।
সেদিনও এমন শীত ছিল, আর কুয়াশা। মেয়েটা বাসের জানালা দিয়ে মাথা বের করে ফোনে কথা বলছিল। হঠাৎ সামনের দিক থেকে একটা ট্রাক… ধাক্কায় মাথাটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়। সিটে তখন শুধু রক্ত…”

ড্রাইভার থামলো। বাকিটা যেন বলার মতো সাহস পাচ্ছিল না।

রায়হানের বুক ধুকপুক করছিল। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল—কুয়াশার ভেতর সাদা শাড়ি পরা সেই মহিলা বাসের সমান গতিতে হেঁটে চলেছে। কিন্তু তার মাথাটা অস্বাভাবিকভাবে একপাশে বেঁকে আছে, আর চোখদুটো… সোজা রায়হানের দিকে তাকিয়ে।

রায়হান চিৎকার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।

ঢাকায় পৌঁছানোর পর ভোর হয়ে গিয়েছিল। বাস থেকে নেমে রায়হান যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি বাসা ফিরে এল। গরম পানি দিয়ে গোসল করলো, কিন্তু ঠান্ডা শীতেও তার শরীর কেমন ঘেমে যাচ্ছিল।

মনে হচ্ছিল—সবই হয়তো তার কল্পনা, ক্লান্তি আর রাত জাগার কারণে মাথা ঘুরে গেছে। কিন্তু… একবারও সে জানালার পাশের ওই খালি সিটটার কথা ভুলতে পারছিল না।


দুপুরের দিকে ঘুম থেকে উঠে রায়হান নিজের ব্যাগ খুললো। ব্যাগের ভেতরে রাখা পানির বোতল বের করতে গিয়ে দেখলো—ওই সাদা শাড়ির কোণার মতো একটা কাপড়ের টুকরো ভিতরে আটকে আছে, ভেজা… আর হালকা কাদা লেগে আছে তাতে।

তারপর হঠাৎ রান্নাঘরের জানালায় টক টক শব্দ হলো। রায়হান ভেবেছিল বাতাসে কিছু লেগেছে। কিন্তু যখন পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালো—

 

সাদা শাড়ি পরা সেই মহিলা দাঁড়িয়ে… মাথা বেঁকে… ঠোঁটের কোণে সেই একই হাসি…

Comments

    Please login to post comment. Login