নিষিদ্ধ নরমপত্র
লেখনিতে-- জুঁই আক্তার
পর্ব - 1
রিয়ানা চিৎকার করে উঠল,
— “মামুনি! শুনছো?”
পাশের ঘর থেকে সাবিনার সাড়া আসে,
— “কি হয়েছে রিয়ানা?”
রিয়ানা নাচতে নাচতে সাবিনার সামনে এসে দাঁড়ায়।
চোখে যেন আগুনের মতো উচ্ছ্বাস।
“মামুনি, জানো কি হয়েছে?”
“আবার কী শুরু করলি?”
“বড় আব্বু কী বলেছেন জানো?”
“রহস্য করবি না, তুই বল! কী হয়েছে?”
রিয়ানা আচমকা ঘুরে সাবিনার পেছনে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— “আসছে... আনান ভাই আসছে!”
এই কথাটা যেন সাবিনার শরীরের প্রতিটা রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে।
তার চোখ ভিজে আসে, কণ্ঠ কেঁপে যায়,
— “আমার আনান! ছেলেটাকে বারোটা বছর পরে দেখতে পাব আমি... আমার আনান আসছে!”
ভূঁইয়া পরিবারের বড় ছেলে—আনান ভূঁইয়া।
বারো বছর আগে ফ্রান্সে পাড়ি দিয়েছিল পড়াশোনার জন্য।
তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় আনোয়ার ভূঁইয়া, তারপর আহমেদ ভূঁইয়া (রিয়ানার বাবা), আর ছোট আতিফ ভুঁইয়া।
সাবিনা আনানের কথায় ডুবে যেতে যেতে পিছনে রিয়ানার কণ্ঠ শোনা যায়,
— “এইবার তোমার ছেলেকে আমার হাতে তুলে দাও, মামুনি!”
সাবিনা তাকিয়ে বলে,
— “আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তোর তো একটা বড় বোনও আছে, ওর কী হবে?”
রিয়ানার চোখ রীতিমতো চেপে যায় রাগে,
— “মুড নষ্ট কোরো না মামুনি! সে আমার বোন না! বাড়ির কাজের মেয়ে! তাকে ‘বোন’ বলো না!”
সাবিনা কিছু বলতে যাবে, তখনই রিয়ানা রাগে জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
---
সাবিনা রান্নাঘরে গিয়ে গলা তুলে ডাকে,
— “নিঝুম! ওই নিঝুম!”
নিঝুম রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
তার মুখে শান্ত ভদ্র এক হাসি।
“জি বড় আম্মু, বলুন।”
“রিতাকে সবজি কাটতে সাহায্য কর।”
“করছি। রান্নাটাও করব?”
“না, আজ আমি নিজেই করব।”
“আমি কি কিছু ভুল করেছি?”
“না না... তুই কিছু করিসনি। আসলে... আনান আসছে।”
“কি... আনান ভাই?!”
“হ্যাঁ। তাই আর দেরি করিস না। যা যা, কাজ কর।”
---
নিঝুম—ভুঁইয়া পরিবারের মেজো ছেলে আহমেদের প্রথম স্ত্রী রৌশানার মেয়ে।
ছয় বছর বয়সে যখন রৌশানা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, নিঝুমের ছোট মনটাও যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
তারপর থেকেই এই বাড়িই তার আশ্রয়।
কিন্তু এরপরের কাহিনি যেন এক ঠান্ডা নীরব যুদ্ধ—নতুন মা, নতুন বোন, আর অনন্ত প্রমাণ করার চেষ্টা।
----
সবজি কেটে নিঝুম উটতে না উটতেই আবার চিৎকার শুনা যায় ,
“নিঝুম!”
“হ্যাঁ, বলো।”
“সারাদিন কোথায় থাকিস তুই? ডাকলেও তোর দেখা পাই না!”
“এইতো, কাজ করছিলাম। বল কী হয়েছে?”
“নাটক বাদ দে! যা, আমার কাপড় ইস্ত্রি কর আর ঘরটা পরিস্কার কর।”
“আচ্ছা।”
“আর বলিস, আমি পালারে যাচ্ছি। কাল যেন আমাকে পারফেক্ট দেখায়!”
“ঠিক আছে।”
নিঝুম কিছু না বলেই মাথা নিচু করে কাজ করতে থাকে।
তার প্রতিটি পা যেন ধীরে ধীরে পাথরে পরিণত হচ্ছে।
কিন্তু তাও, সে জানে এখনই শেষ সময় আসেনি !
কাজ শেষ করে রান্নাঘরে গেলে সাবিনা আরো কিছু কাজ ধরিয়ে দেন।
নিঝুম মাথা নিচু করে করে কাজ করে যায়। হঠাৎ করে নিঝুমের মনে পড়ে ,সে যখন ছয় বছরের ছিল তখন আনান ভাই ছিল । নিঝুমের একমাত্র খেলার সাথী ,কিন্তু আজ বারো বছরে একবার ও সে তাকে দেখে নি ! আচ্ছা তিনি দেখতে কেমন হবেন?
এক সময় সাবিনার চোখ পড়ে—
নিঝুম টেস্ট করছে রান্না।
হঠাৎ থমকে যান তিনি।
সে যেন তার অতীতের কোনো ছায়া দেখে ফেলেছে।
সেই চোখ, সেই পাপড়ি, সেই চেহারা—এ যেন রৌশানা নিজেই!
মেয়েটা ঘেমে গেছে। চিকন শরীরে পরিশ্রমের ছাপ, কিন্তু তার মাঝে এক অপার্থিব সৌন্দর্য।
সাবিনার বুকের ভেতর কাঁপে। ভয় আর মায়ার মিশেলে যেন ছায়া ভাঙে।
— “নিঝুম।”
নিঝুম হালকা হেসে বলল,
“জি বড়মা? রান্নাগুলো অনেক ভালো হয়েছে... !
"একটা কথা শুন।”
“জ্বী বলেন।”
“আনান কাল আসছে। তুই রুম থেকে বের হবি না। তোর খাবার আমি পাঠিয়ে দেব।”
নিঝুম না চাইতেও অনেকটা কষ্ট পায় ,
" ঠিক আছে, বড়মা ।"
" যা অনেক কাজ করেছিস ,হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয় ।"
" ঠিক আছে! "
নিঝুম আর কিছু না বলে নিজের রুমে চলে যায় । দরজা লাগাতেই তার চোখে পানি টলটল করছে,
সে আয়নার সামনে দাঁড়ায় ,
" আচ্ছা ,আমি কি এতই খারাপ যে বিনা কারণে আমাকে কষ্ট দেবে ! আমি বুঝি না ,আমি কি বলেছি ,যে আনান ভাইয়া আসলে আমি তার সামনে যাবো । যাবো না কোনো দিন যাবো না ! ওনার সামনে আমি কোনো দিন যাবো না ! "
সারাদিন কাজ করায় বেশ খিদে ছিল কিন্তু সাবিনার কথায় খিদে শেষ ! রাতে নানা কথা ভাবতে ভাবতে নিঝুম ঘুমিয়ে পড়ে ।
---
সকাল ঠিক দশটা।
ভেতরের দরজা দুটো স্লাইড হয়ে খুলতেই ভীড়ের ভেতর এক মুহূর্তের জন্য যেন সময়টা থমকে দাঁড়ায়।
বহিরাগত ভিড়ের মাঝখান দিয়ে
একজন উচ্চতাপূর্ণ, মুগ্ধ করা পুরুষ ধীরে ধীরে সামনে আসে।
কালো ফিটেড কোর্ট, ইনসাইডে হালকা ধূসর শার্ট, গলায় পাতলা স্কার্ফ।
চোখে সানগ্লাস, পায়ে চকচকে কালো বুট জুতা।
তাঁর চালচলন একেবারে ধীরস্থির, আত্মবিশ্বাসে ভরা।
তার লম্বা শরীরটা যেন একদম ছাঁচে গড়া—
প্রায় ৬ ফুট উচ্চতা, কাঁধ দুটো প্রশস্ত, কোমরের নিচ থেকে শরীরের প্রতিটি বাঁক শক্ত আর সুশৃঙ্খল।
চোখের পেছনে দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি থাকলেও
চোখজোড়া যেন ছায়া ঢাকা গভীরতা—যেখানে কিছু লুকানো আছে।
হাতে এক হাতলওয়ালা ট্রলিব্যাগ, অন্য হাতে পাসপোর্ট আর ফোন।
এয়ারপোর্টের ভিড়ে তার দিকে চোখ পড়লে দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে থাকা অসম্ভব।
আনানকে নিতে আনোয়ার ভুঁইয়া আর আতিফ ভুঁইয়া এয়ারপোর্টে যায় । আনান এর সাথে দেখা হওয়ার পর দুই ভাই রওনা দেয় বাড়ির পথে ! পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটা ধীরে ধীরে থামে।
জন্মভূমির বাতাসে একধরনের অন্যরকম গন্ধ—চেনা, অথচ দূরের।
আনান ভূঁইয়া চোখ তুলে তাকায় পুরোনো বাড়ির দিকে।
কখন যেন অনেক কিছু বদলে গেছে।
আগে যেটা ছিল একতলা ছোট্ট ঘর, এখন সেটা যেন এক রাজপ্রাসাদ!
চকমকে সাদা রঙের নতুন পেইন্টে মোড়ানো বাড়িটা এখন এক ডুপ্লেক্স হাউস।
উঁচু করে বানানো ছাদ, মার্বেল সিঁড়ি, বড় বড় জানালা—যেগুলো দিয়ে সূর্যের আলো একরকম রাজকীয় ঢঙে ভেতরে ঢোকে।
বাড়ির মূল গেটটা এখন রিমোটচালিত—লোহার গেটে ফ্যামিলির নাম ফলক খোদাই করা:
"Bhuiya Residence - Since 1980"
সামনের বাগানে পাথরের বেন্চ, গোলাপ গাছের সারি, আর ছোট্ট একটা ঝর্ণা বসানো হয়েছে।
সব মিলিয়ে যেন ফ্রান্সের কোনো ক্লাসিক ভিলার ছায়া।
আনান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে—এই বাড়ির প্রতিটা ইট, প্রতিটা কোণা তার শৈশবের সাক্ষী।
তবু আজ সবকিছু নতুন, ঝাঁ চকচকে... শুধু এক জায়গায় কোনো পরিবর্তন নেই।
সে দরজার সামনে গিয়ে কলিং বেল বাজায়।
দরজা খুলতেই এক অমোঘ মুহূর্ত এসে দাঁড়ায়—মা।
সাবিনা ভুঁইয়া।
ছেলের মুখ দেখেই তাঁর চোখ জলে ভরে ওঠে।
কিন্তু কান্না চাপা দিয়ে তিনি শুধু বলেন,
— “আনান... ।
আনান আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তার মাকে জড়িয়ে ধরে।
দুই হাতের মধ্যে মায়ের মাথাটা টেনে নেয় বুকে, চোখ বন্ধ করে ফেলে।
— “মা... আমি চলে এসেছি... "
সাবিনা হেসে ফেলেন, কিন্তু সেই হাসিতে লুকানো থাকে হাজারটা অশ্রু।
— “তুই অনেক দেরি করলি রে... এতদিন পর তোর আসতে ইচ্ছা হলো ।”
মায়ের কপালে চুমু খেয়ে আনান বলেন,
— “এবার আর ফেলে যাব না মা। এবার সব ছেড়ে এসেছি। শুধু তোমাদের জন্য...”
সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কাজের মেয়েরা চুপচাপ এই দৃশ্য দেখে—সেই আনান ভাই, যার গল্প শুধু শোনা গেছে এতদিন।
এদের কথার মাঝে হুট করে রিয়ানা আসে ,
একনজর তাকিয়ে হাসে ,
আনান জিজ্ঞাসু সুরে,
" রিয়ানা ...? "
" হুম ,চিনলে দেখি ! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ভুলে গেছো ?"
" না ,ভুলবো কেনো ?ছোট মা কই ? "
হাসনা ভুঁইয়া তখনই বলে ওঠেন ,
" কিরে ,আনান কেমন আছিস বাবা ?"
আনান হাসি দিয়ে,
" এইতো ভালো? আপনি ? "
হে , ভালো ! হাসনা ভুঁইয়া রেগে বলেন,
" ভাবি আপনার কি হইলো , ছেলেকে পেয়ে কি সব বুদ্ধি হারালেন! ছেলেটা এত দূর থেকে এলো আর আপনি এখানে ও দাঁড় করিয়ে রাখছেন ! যা বাবা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয় ।"
" আচ্ছা ,ছোট কাকি কই ? "
" সে তো বাপের বাড়ী,তুই যা ফ্রেশ হ গিয়ে ! "
আনান যাওয়ার সময় দুইটা লাকেজ সাবিনার হাতে দিয়ে বলে ,
" এখানে সবার জন্য কিছু জিনিস আছে । সবার নাম লেখা আছে! "
রিয়ানা সামনে গিয়ে বলে ,
" তোমার কাছে ওই দুটি লাকেজ এ কি ?"
" আমার কিছু ইম্পর্ট্যান্ট জিনিস !"
রিয়ানা আনানের দিকে তাকিয়ে থাকে!
আনান রুমে যেতে যেতে চারি দিকে চোখ বুলায় ,কিন্তু সে যা খোঁজে টা ঠিক পেলো না ! দ্বিতীয় তলার করিডোরে পৌঁছে সে চারপাশে চোখ বুলায়—বাড়ির প্রতিটি রঙ, ডিজাইন, সাজসজ্জা বদলে গেছে।
আলোর রঙ বদলে গেছে, দেয়ালের ফ্রেমগুলো নতুন হয়েছে, ফ্লোরিংয়ে এখন কাঠের স্পর্শ, আগে যা ছিল সিমেন্টের সরলতা।
তার চোখ বার বার কিছু খোঁজছে কিন্তু তা পায় না আনান !
মাথা ঘুরিয়ে বার বার আশেপাশে দেখে, যেন কোনো অদৃশ্য পরিচিত গন্ধ বা চিহ্নকে ধরতে চাইছে।
শেষে করিডোরের এক কোণে এসে দাঁড়ায় সে। নিজের রুমে ঢুকতেই অবাক হয় সে ,
আগের সেই নীল পর্দা নেই, দেয়ালে থাকা শৈশবের ছবি নেই, জানালার পাশে থাকা ছোট টেবিলটা পর্যন্ত নেই যেখানে সে বসে গল্প লিখত।
এ রুমে তার গন্ধ নেই।
এ রুমে এখন নতুন রঙ, নতুন ফার্নিচার, নতুন আবহ...
আনান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে।
তার চোখে ভেসে ওঠে পুরোনো রুমের কোণা, দেয়ালে তার প্রিয় পোস্টার, আর জানালার পাশে বসে চুপ করে বই পড়ার দিনগুলো।
কিন্তু সেই রুম, সেই দিন, আর নেই।
আস্তে করে সে ওয়াশরুমে চলে যায়।
জলের নিচে নিজেকে একটু শান্ত করে আনে, যেন অতীত আর বর্তমানের মাঝের দূরত্বটুকু ধুয়ে ফেলতে চায়।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে সে—
গায়ে কালো রঙের সাদামাটা টি-শার্ট, সাথে সাদা টাউজার।
চোখে অদ্ভুত এক নিরবতা আর অস্থিরতা।
রুম থেকে বেরিয়ে আনান আবার করিডোরে দাঁড়ায়...
কিন্তু এবার তার দৃষ্টি যেন আর অতীত খোঁজে না, বরং ভবিষ্যতের কোনো ইশারা খোঁজে।
---
নিঝুম সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে । আজ হাতে অনেক সময় ,তাই অনেকদিন পরে কোরআন শরীফ নিয়ে বসে । পড়তে পড়তে সকালে নাস্তা দিয়ে যায় তাকে । সব কিছু শেষ করে দেখে মাত্র 12 টা বাজে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে দেখতে পায় শিউলি গাছটাকে ! এটা তার মা নিজে লাগিয়ে ছিল। নিঝুম রোজ গাছটার খেয়াল রাখে ,কিন্তু কালকে কাজের চাপে আর আজ তো বেরই হতে পারবে না । গাছটা যেন তার মায়ের অভাব পূরণ করে । সারাদিন কেউ তার কথা না শুনলেও কিন্তু এই কাজটা তার জীবনের সব সমস্যা যেন এক মিনিটে সমাধান করে দেয়। তাই নিঝুম ভাবে রাতে সবাই ঘুমালে সে গাছটার কাছে যাবে !
তখনই সে ভাবে ,
" আনান ভাইয়া কি চলে এসেছে ? "
---
আনান ফ্রেশ হয়ে নিচে নামছে , সাবিনা আর হাসনা খাবার টেবিলে রাখায় ব্যস্ত । অনানকে কে দেখে রিয়ানা সোফায় ঠিকঠাক হয়ে বসে । আনান এসে রোজা চেয়ারে বসে,শেষে রিয়ানা ও অনানের পাশে এসে বসে। আনান ফোনে কিছু একটা দেখছে , পাশে তার বাবাও এসে বসে ।
সাথে তার দুই কাকা এসে বসে । সবাই খেতে বসেছে কিন্তু আনান তাও ও বসে আছে ।হাসনা ভুঁইয়া তখনই জিজ্ঞেসা করেন ,
" কি হলো , আনান ! খাচ্ছো না কেন ? "
" সবাই আসলে এক সাথেই খাই !"
" কি বলো ! সবাই তো আছেই !"
আনান বিস্ময় নিয়ে বলে ,
" নিঝুম কই .... ?"
হাসনা ভুঁইয়া চুপ করে আহাম্মেদ ভুঁইয়ার দিকে তাকায় । আহমেদ ভূইয়া কিছু বলতে যাবে এর আগেই সাবিনা বলে ওঠেন ,
" নিঝুম একটু অসুস্থ তাই আমি খাবার আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি ! "
আনানের কাছে ব্যাপারটাও একটু অন্যরকম লাগে তাও সে কিছু বলে না । আনান খেয়ে রুমে চলে যায়।রুমে গিয়ে আনানের মাথায় একটা কথাই ঘুরছে ,
নিঝুম যদি অসুস্থ হয় তাহলে তো একবার হলেও সে শুনতো , কিন্তু কেউ তো কিছু বলল না! এই বাড়িতে যে নিঝুম বলতে কেউ আছে তাই তো বুঝা যাচ্ছে না ।ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত !
অন্যদিকে...যোহরের নামাজ পড়ে নিঝুম হালকা একটু শুয়ে ছিল।
সেই শোয়াই কখন যে ঘুমে ডুবে গেছে, টের পায়নি।
চোখ খুলতেই অবাক হয়ে দেখে, বাইরে সকাল না—রাত!
এক লাফে উঠে ঘড়ির দিকে তাকায়—১১টা ২৬ মিনিট!
মনটা কেমন ধড়ফড় করে ওঠে। এতটা সময় সে ঘুমিয়ে থাকল কীভাবে?
বাড়ির এই নিয়মেই সে অভ্যস্ত—সবাই জেগে থাকে, কিন্তু রাতের এই গভীরে সবাই থাকে নিজের রুমের মধ্যে নিঃশব্দে।
আর আনান ভাই তো মাত্র এসেছে, এত জার্নি করে এসে নিশ্চয় এখন ঘুমাচ্ছেন। এখন আর কোন টেনশন নেই !
পেটটা কেমন কাঁপছে।
শরীরটা দুর্বল হয়ে গেছে। সে উঠে যায়, হালকা পানি দিয়ে হাত-পা ধুয়ে ফিরে আসে।
চোখে ঘুম আর ক্ষুধা দুই মিলে মাথা ঘুরছে।
নিজেকে শান্ত করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
চুপি চুপি, যেন কারও পায়ের শব্দ না হয়।
রান্নাঘরে ঢুকেই দেখে—সব রান্না ফ্রিজে ঢোকানো।
কারও খাওয়ার বাকি নেই, সব কিছু একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে।
গরম দিতে হবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
নিঝুম জানে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করবেন না !তাও কেন বারবার সে ভাবে!
চোখের পানি মুছে নিয়ে রান্না গরম বসিয়ে দিয়ে ভাবে,
"এই গরম হতেই তো সময় লাগবে... একটু বাইরে গাছটা দেখে আসি।"
রান্নাঘরের পাশের দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে আসে সে।
এখনও গেট বন্ধ করা হয়নি।
বেরিয়েই অবাক হয়ে যায়—বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে।
আর পুরো উঠোন জুড়ে এক মাদক শিউলি ফুলের গন্ধ, যেন হঠাৎ করে শরৎ রাত এসে হাজির হয়েছে।
নিঝুম ধীরে ধীরে পেছনের দিকের বাগানে এগিয়ে যায়।
শিউলির গাছটার নিচে সাদা ফুল পড়ে আছে, সে নিচু হয়ে একটাকে তুলতে যাবে...
ঠিক তখনই!
এক অদ্ভুত অনুভূতি।
পেছনে কেমন এক অচেনা উপস্থিতি...
সে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতেই এক লম্বা ছায়া ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
চিৎকার করার আগেই, এক শক্ত হাত তার মুখ চেপে ধরে!
— “ম্মম্...!!” নিঝুম আঁতকে উঠে আপ্রাণ ছাড়ানোর চেষ্টা করে।
সে হাত-পা ছুঁড়ে মারের মতো কাঁপে। কিন্তু ছেলেটার হাত যেন পাথরের মতো শক্ত!
— “ছেড়ে দিন! প্লিজ…!” তার চোখে জল এসে যায়।
ঠিক তখনই সেই অন্ধকারে কানে আসে এক কণ্ঠ...
গভীর, ভারী, তীক্ষ্ণ, অথচ যেন পরিচিত।
— “নিঝুম...”
নিঝুম থমকে যায়।
তার দেহের সব আন্দোলন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়।
শব্দটা, কণ্ঠটা, নামটা... এইভাবে কেউ ডাকে না তাকে !
মুখের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে নেয় আগন্তুক।
তারপর এক হাতে নিঝুমকে ধরে সে বাড়ির দিকে হাঁটে।
নিঝুম বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে।
হাতের সেই স্পর্শে কেমন কাঁপে সে... ভয় আর চেনা স্পর্শের এক অদ্ভুত মিশ্রণ।লাইটের আলোয় দু’জন একে অপরকে দেখে।
১২ বছর পর।
শিশু মুখে যে স্মৃতি রয়ে গিয়েছিল, সেই মুখ আজ অন্য এক রূপে ফুটে উঠেছে।
নিঝুমের চোখ বড় হয়ে যায়।
এই সেই আনান ভাই—ছেলেবেলায় যার ছায়ার পেছনে সে হাঁটত, যার গল্প শুনে রাত্রি কাটত।
আজ সেই ছেলেটি সামনে দাঁড়িয়ে—পুরুষ হয়ে।
আনান তাকিয়ে থাকে নিঝুমের দিকে।
এত বছর পরেও সেই চোখ...
তবে এখন তাতে শৈশবের সরলতা নেই, আছে একধরনের ক্লান্ত শোক, অব্যক্ত লজ্জা, আর অসীম সহ্য।
তার পরনে কালো টি-শার্ট, সাদা ট্রাউজার, হাত পকেটে।
চোখের নিচে হালকা কালি, ভ্রু জোড়া একটু কুঁচকে আছে।
চোখ সরিয়ে না নিয়েই,
একটা গভীর কণ্ঠে বলে ওঠে—
— “সারাদিন কোথায় ছিলি?”
— “এত রাতে বাইরে কেন?”
চলবে ...
(যদি উপন্যাসটি ভালো লাগে তাহলে তাহলে কমেন্ট করে জানান তাহলে তাড়াতাড়ি পরের পার্ট টি দেবো!)