ভাই বাড়ি ফিরল রাত দশটার পর। হাতে বাজারের থলে, চোখ-মুখে চাপা হাসি। সে বাজারের থলেটা মায়ের হাত দিয়ে বলল, “রুই মাছ কিনেছে। কেঁটে ধুয়ে মাছ ভাজা করে ফেলো। রাতে খাব।”
মা কিছু বললেন না। মাছের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মাছটা ভালো। পঁচা গন্ধ ছাড়ছে না। তীক্ষ্ণ গলায় বললাম, “তোর বউয়ের কপালে অশেষ দুঃখ আছে। মাঝরাতে বাজার নিয়ে এসে বলবি রান্না করে দাও। বড়ই আফসোসের ব্যাপার!”
ভাই তেঁতেঁ উঠল। বিরক্ত গলায় বলল, “মা তোমার মেয়েকে নিষেধ করো। ফাও কথা বলতে না পারলে ওর পেটের ভাত হজম হয় না।”
“ফাও কথা না। আমি খুবই প্রাকটিকাল কথা বললাম। তোর মাঝরাতে এটা ওটা নিয়ে আসার স্বভাব কখনো যাবে না। বরং অভ্যাস হয়ে যাবে। যখন মনে করবি আমি যা খুশি করতে পারি।”
“দেখেছ মা? কিসব বলছে! আমি কী রোজরোজ এমন করি। ভালো কথা বলছি– তোমার মেয়েকে বাজে কথা বলতে নিষেধ করো।”
মা একটু হাসলেন। নরম গলায় বললেন, “আমার মেয়ে তোর কী হয়?”
এ যেন আমার মোক্ষম সুযোগ। একদম ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
কিছু একটা বললেই সাথে সাথে তোমার মেয়ে বানিয়ে দিয়েছে। অথচ কাজের সময় আপু, আপু রে করতে থাকে। মাঝরাতে পানির পিপাসা পেলে আপু রে, একটু পানি দিয়ে যা। ঘুমনোর আগে বিছানা গুছিয়ে দে। কাপড় ধুয়ে দে। মাথা চেপে দে। এরপর যখন বলবি মাথা চেপে দে, সোজা গলা চে’পে ধরব।”
মা হাসলেন।
“তাই বোঝ। কাজের সময় হলে তখন ভালো কথা।”
ভাই বলল, “তা কাজের সময় কী বাজে কথা বলা যায় নাকি? এখন আমি যদি বলি ও মা, তোমার মেয়েকে আমার বিছানা গুছিয়ে দিতে বলো তাহলে কী দেবে? দেবে না। এইটা সবসময় মাথায় রাখতে হয়।”
আমি বললাম, “কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরালে পাঁজি। হ্যালো পাঁজি মানুষ।”
ভাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। মা বললেন, “আমার এক খালু ছিল। বাজারে যাবে। মাছ কিনে এনে দিয়ে পা ধুয়ে এসেই বলবে খেতে দাও। না দিলেই চিল্লাপাল্লা শুরু। তা আর কী করবে! আগে থেকে মশলা কষিয়ে রাখত। মাছ আনলে কে’টে কুটে কোন রকমে ধুয়ে জ্বাল করে দিতো। খা শালা। আধোয়া মাছ খা।”
তিনজনই হো হো করে হেসে উঠলাম। মা রাতের রান্না শেষ করে রেখেছিল। আলু সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ আর ভাত। নতুন করে মাছ ভাজা করা হলো। বাবা তখনও বাড়িতে ফেরেননি। কোথায় কোন কাজে ঘুরছেন সে ব্যাপারেও তেমন ধারনা নেই। দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন বোধহয়।
রান্না শেষ হওয়ার পরপরই বাবা ফিরলেন। সাড়ে এগারোটার মতো বাজে। আশেপাশের পরিবেশ শান্ত। বোধহয় সবাই ঘুমিয়ে পড়ছে। ভাত থালা সামনে নিয়ে বাবা বললেন, “মাছ কোথায় পেলে?”
মা বললেন, “তোমার ছেলে কিনে এনেছে। রাত দুপুরে মাছ এনে বলছে ভেজে দাও।”
“তা ভালো। মাছ কত করে নিলো? খুব তাজা মাছ মনে হচ্ছে। সচারাচর রাত দুপুরে এমন মাছ পাওয়া যায় না। দেখেশুনে কিনতে পেরেছিস তাহলে।
ভাইয়ের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সে বেশ গর্বিত গলায় বলল, “ভালো দেখেই তো নিয়ে এলাম। কেজি আড়াইশ টাকা। দুই কেজির একটু কম।”
আমি বললাম, “দাম বলে দিয়েছে। টাকা দিয়ে দেন আব্বা।”
ভাই চোখ মুখ কেমন করে ফেলল।
মা বললেন, “তুই সবসময় বেশি কথা বলিস। ও কী তোকে একবার বলেছে মাছের দাম দিতে হবে?”
“দিতে হবে না বলছে ও?”
ভাই বলল, “আপু মনে হয় নিজে দিতে চাইছে। দিয়ে দে আপু।”
“একটা মাছ কিনে এনে আবার টাকা চাইছিস?”
“তুই-ই তো বললি টাকা কথা। কেউ কিছু দিতে চাইলে আমি আবার না করতে পারি না।”
মা হাসলেন। বাবাও হাসছে। আমি চোখ মোটা করে ভাইয়ের দিকে তাকালাম। ভাই একমনে ভাত চিবুচ্ছে। তার চোখমুখে তৃপ্তির ছাপ। নিজের প্লেটে মনযোগী হলাম। গরম ভাতের সাথে মাছ ভাজা। লেবুর রস ছড়িয়ে খেতে বেশ ভালো লাগছে। ফাঁকে ফাঁকে বাবা ভাইয়ের মধ্যে বাজারের অবস্থা নিয়ে বিস্তার আলোচনা চলছে। ভাই বলছে, “মাছের দোকানের লোকটা আসলেই শ'য়'তা'ন। আমি তো মাছ চিনি না। রুই মাছের নাম করে গ্লাসকার্ফ ধরিয়ে দিচ্ছিল। বলে দাম কম নেবে।”
মা বললেন, “এজন্যই দেখেশুনে কিনতে হয়। নয়তো কম দামে ভুলভাল জিনিস ধরিয়ে দেয়।”
“মাছ কিনতে গিয়ে তো একজনের সাথে মা'রা’মা’রি লেগে গিয়েছিল প্রায়। ভালো চিংড়ি ওজন করছে তার মধ্যে নাকি পঁচা চিংড়ি দিয়ে দিয়েছে। এই নিয়ে তো চিল্লাপাল্লা। পরে হাটের লোকজন মিলে ছাড়িয়ে দিয়েছে। আবার এক জায়গায় মাছ কা'ট'ছে। গিয়ে দেখি তিনটে ক্যামেরা লাগালো। মানুষের কথা আর কী বলব!”
আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভালো না। নিম্ন-মধ্যবিত্ত বলা চলে। মাস শেষে বাবার পকেটের শেষ টাকাও যেন গরম দেখিয়ে বলে– মাসের এখনও চার দিন বাকি। এই টাকায় চলতে হবে। গোটা বর্ষা পেরিয়ে গেলেও বাড়িতে একটা ইলিশ মাছ ঢোকে না। মায়ের নিষেধই কেনা হয় না। মা বলে, ‘একটা মাছ দু'বেলা খেয়ে শেষ। ওই টাকায় অন্য মাছ কিনলে দুই সপ্তাহ চলে যাবে।’
বাবা অবশ্য মায়ের কথা তেমন গায়ে মাখে না। চেষ্টা করে ঠিকই। চড়া দামের বাজারে তার পকেটে পড়ে থাকা কাগজের নোটগুলোর সাথে পেরে ওঠে না। কোথায় যেন হাঁপিয়ে যায়। ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে চারজনের খাওয়ার খরচ নেহাৎ কম নয়। মাঝেমধ্যে বাবাকে দেখে বেশ ক্লান্ত মনে হয়। নুয়ে পড়া কাঁধে বাজারের ব্যাগের ভার বেশ শক্ত। বাবার নিজের তেমন শখ আহ্লাদ নেই। বছর দু'বছরেও নিজের জন্য কিছু কেনে না। কাপড়চোপড়, জামা জুতো কোন কিছুই তাকে কিনতে দেখা যায় না। এই নিয়ে অবশ্য তার কোন অভিযোগ নেই। অভিমানও খুব বেশি লক্ষ্য করা যায় না। মায়ের অবস্থাও তেমন। তিনিও কিছু কিনতে চান না। সংসারের জিনিসপত্রের নাম ধরে নিজের চাহিদা গোপন করে রাখেন। দিন চলে যায়, মাস পেরিয়ে বছর কেটে যায়।
খাওয়া শেষ হতে রাত বারোটার মতে বাজল। মশারী খাটিয়ে বিছানায় পিঠ এগিয়ে দিলাম। ভালো লাগছে। মনটা কেমন ফুরফুরে হয়ে আছে। আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ। সুখের সংজ্ঞাও সাধারণ। আমার কাছে সুখ মানে পরিবারের সবাই একসাথে বসে একবেলা খাবার খাওয়া। কারোর চেহারায় মলিনতা নেই, দুশ্চিন্তার ছাপ নেই। তৃপ্তির ছাপ ছড়িয়ে আছে মুখে। ঠোঁটে কোণে চাপা হাসি। আমার চোখে এমন দৃশ্য বড়ই শান্তি, প্রাপ্তির। গোটা জীবনই এমন একটা দৃশ্য দেখার জন্য অপেক্ষা করা যায়।